//বদলে যাওয়া বদলে দেওয়া-২য় পর্ব //
গায়ে চাদর জড়ানো, উস্কুখুস্কো-এলোমেলো চুল মাথায় এবং বেঁটেও। তবে বলিষ্ঠ ও
সুঠামদেহের অধিকারী মানুষটি। আসলাম গোত্রের মানুষ সেই লোক। মাসজিদে এসেই তিনি
চিৎকার জুড়ে দিলো। চিৎকার করে বলতে লাগলো ইয়া রাসুলাল্লাহ ( স্বল্লাল্লাহু আলাইহি
ওসাল্লাম )! আমাকে পরিশুদ্ধ করুন। আমাকে পবিত্র করুন। আমাকে শাস্তি দিন।
রাসুলুল্লাহ স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম তখন মসজিদে বসে আছেন। আল্লাহর রাসুল
বললেন আমি তোমাকে কী শাস্তি দেবো ? কী থেকে পবিত্র করবো? তুমি আল্লাহর
কাছে ক্ষমা চায়। তাঁর কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করো এবং মাগফিরাত চাও। এসব বলেই
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এভাবে
একবার না দু’বার না চারবার সে একই কথা বলছিলো আল্লাহর হাবীবও ততোবারই তার
থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
অতঃপর আল্লাহর রাসুল তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন— কীসের থেকে আমি তোমাকে পবিত্র করবো?কী করেছো তুমি ?
লোকটি বললো ইয়া রাসুলাল্লাহ স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম আমি জিনা করে ফেলেছি। আমি আমার নফসের কাছে পরাজিত হয়ে গিয়েছি। আমি ব্যভিচারী। আমার ওপর হদ্দ প্রয়োগ করুন !
তখনো আল্লাহর রাসুল বললেন যে, নাহ! তুমি জিনা করোনি। ব্যভিচার করোনি। হয়তো তুমি স্পর্শ করেছো কিংবা চুমো খেয়োছো !
লোকটি বললো—নাহ, ইয়া রাসুলাল্লাহ ! এই হতভাগাটি সরাসরি ব্যভিচারই করেছে।
প্লিজ আপনি আমকে শাস্তি দিন ! আমাকে পবিত্র করুন !
আল্লাহর রাসুল সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ডাকলেন। বললেন দেখো; এর মাথা কি ঠিক আছে কিনা? এ-কি সুস্থ? নাকি পাগল? সকলেই সমস্বরে বলে ওঠলো হে আল্লাহর নবি, এ-পরিপূর্ণ সুস্থ মানুষ। পাগল নয়।
আল্লাহর নবি আবার জিজ্ঞেস করলেন— সে কি মদ্যপ কিনা? মাতাল হয়ে, নেশাগ্রস্ত হয়ে এসব কথা বলছে কিনা?
অতঃপর সাহাবিদের মধ্য থেকে কিছু লোক তার মুখ শুকে দেখলো। সাথে সাথে আল্লাহর
রাসুলের কাছে তাঁরা প্রতিবেদন জমা দিলো; বললো ইয়া রাসুলাল্লাহ ! নাহ। এ-তো মদ্যপ কিংবা মাতালও নয় ।
এরপর আল্লাহর রাসুল সে লোকের
গোত্রের কিছু মানুষকে জিজ্ঞেস করলেন; এ-কেমন ধরনের মানুষ? সকলে তাঁর
সম্পর্কে ভালো রিপোর্ট দিলো। তারা তাঁকে বললো যে, আমরা তার
সম্পর্কে খারাপ কোনো কিছুই জানি না।
রাসুলে আকরাম স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম তাঁকে তখন জিজ্ঞেস করলো তুমি কি বিবাহিত নাকি অবিবাহিত?
লোকটি জবাব দিলেন— হে আল্লাহর রাসুল আমি বিবাহিত !
অতঃঅপর আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ
স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম তার প্রতি ব্যভিচারের শাস্তি প্রদানের নির্দেশ প্রদান
করলেন। খোলা ঈদের মাঠে মানুষটিকে নিয়ে আসা হলো। এরপর পাথর নিক্ষেপ করে শাস্তি কার্যকর
করা হলো। দুনিয়া হতে চির বিদায় নিলো লোকটি।
হ্যাঁ, যাঁর কথা বলছিলাম তিনি হলেন মাইয ইবনু মালিক আসলামী ( রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু )।
মানুষ তো মন্তব্য প্রিয়। খুব সহজেই অন্যকে জাজ করে ফেলার মন-মানসিকতা সম্পন্ন । ওনার মৃত্যুর পরও তাই হলো। মানুষগুলো মন্তব্য আর বিচার-বিশ্লেষণ করা শুরু করলো। তবে তারা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। একদল বলতে লাগলো— নিশ্চয় মাইয ধ্বংস হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই তার পাপ কার্যত তাকে ঘিরে ফেলেছে।
দ্বিতীয় দল ছিলো এমন কটুমন্তব্যের ঊর্ধ্বে। এই
দলের লোকেরা বলতে লাগলো— মাইযের তাওবা ও
অনুসূচনার চেয়ে উত্তম তাওবা ও অনুশোচনা আর হয় না। হতে পারে না। কেননা সে
রাসুলে কারিম স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আগমন করলো এবং নিজ থেকেই নিজের অপরাধের স্বীকৃতি দিলো। এবং বললো, আমাকে পাথর
দ্বারা হত্যা করুন। দু'তিন দিন পর্যন্ত
মানুষ শুধু এ-কথাগুলোই বলাবলি করছিলো একে অপরের সাথে।
দেখুন, এ-বিষয়টি থেকে আমরা যেসব বিষয় শিখতে পারি, তা হলো— এই যে মাইয ইবনু মালিক আসলামী; তিনি কিন্তু পাপ করেছেন তা কেউ-ই জানতোনা। তাবৎ পৃথিবীর কেউই তা টের পায়নি !
কিন্তু ওনার ভেতর আল্লাহ ভীতি ছিলো। আল্লাহ তো দেখেছেন, ফেরেশতাগণ লিপিবদ্ধ করেছেন—এই ছিলো তাঁর অনুভব, এই ছিলো তাঁর উপলব্ধি। আর সেই অনুভব
থেকেই অন্যদের চোখের আড়ালে হয়ে যাওয়া পাপকর্মের ফলে মনে আনন্দানুভূতি জাগার পরিবর্তে
দুঃখ আর অপরাধবোধ ওনাকে জর্জরিত করে ফেলেছে। এই অপরাধ তাঁর উপলব্ধিতে এসে
বারবাংবার-ই যেনো ধাক্কা মেরে গেলো ওনার ক্বলবে। যার কারণে তিনি পরকালে আল্লাহর
ভীষণ দুঃসহ আজাবে তাড়িত হওয়া থেকে বাঁচতে দুনিয়ায় থাকতেই সে শাস্তি ভোগ করে যেতে
চেয়েছিলেন। এবং গিয়েছেনও!
এই যে মাইয ইবনু মালিক আসলামী, তাঁরা
ভুলক্রমে ভুল করে ফেললেও সেটার প্রায়শ্চিত্ত না করা অবধি শান্তি ও স্বস্তি পেতেন
না ! আর আমরা সারাদিন অপরাধ করেও গালভরা তৃপ্তির হাসি দিয়ে দিন পার করি। রাতে আরাম
করি। তিনি শুধু জীবনে একবার যিনা করেছেন, আর এতেই তিনি অপরাধবোধে আজাবের ভয়ে
বিগলিত হয়ে পড়েছেন। আমরা তো প্রতিটি সেকেণ্ডেই গুনাহ করি। পাপাচারে জড়িয়ে থাকি।
অন্যের অধিকার হরণ করি। যিনা-ব্যভিচার-লুটতরাজ-সালাত আদায় না করা— কোনটা
থেকে মুক্ত আমরা?
পুলিশ-আইন-আদালত; কিছুই আমাদের অপরাধের মাত্রাকে কমাতে পারেনা।
আমাদের অন্যায়ের লাগাম টেনে ধরতে পারেনা। কিন্তু তাদের অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করতে
পুলিশের প্রয়োজন পড়তোনা। নিজেদের বিবেক-তাক্বওয়াটাই ছিলো আসল পুলিশ। যার কারণে
তাদের দ্বারা তেমন একটা গুনাহ কিংবা অপরাধ-ই সংঘটিত হতো না !
//বদলে যাওয়া বদলে দেওয়া -২য় পর্ব//
~রেদওয়ান রাওয়াহা

Comments
Post a Comment