“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”
“আমি যখন ছোট ছিলাম তখনো শবে বরাত উৎসব হতো, এখনো হচ্ছে। তবে উৎসব পালন প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। একালের ছেলেমেয়েদের আমাদের সময়কার উৎসবটির কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
আজ আইন করে পটকা ফুটানো নিষেধ করা হচ্ছে। আমাদের সময়ে এই আইনের প্রয়োজন হয়নি। এক সপ্তাহ আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় পটকার দোকান। ছোটদের প্রিয় ছিল তারাবাতি, কাঠির আগায় পটকা, মার্বেল পটকা। একটু বখাটে ধরনের ছেলেদের জন্যে মরিচ বাতি। কাঁচা মরিচ সাইজের হাউই। দেয়াশলাই-এ আগুন লাগাতে হয়—আগুন লাগানোমাত্র শাঁ করে আকাশে উড়ে যায়।
সে সময় ছেলেমেয়েদের বাবারা পটকা কিনে দিতেন। কিছু তারাবাতি, কিছু লাঠিপটকা, কিছু মার্বেল পটকা। মনে আছে, কাঠি-পটকা হাতে আমরা গম্ভীর ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুক্ষণ পর পর গোণা হতো-মোট কয়টা পটকা আছে। তারাবাতির প্যাকেট থাকত বুক পকেটে। যখন-তখন পকেট থেকে তারাবাতির প্যাকেট বের করে বাতির সংখ্যা গোণা ছিল অবশ্যকর্তব্যের একটি।
পটকার দোকানে মোমবাতিও বিক্রি হত। শবে বরাতের সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা। হালুয়ার ব্যাপারটা ছিল কিনা মনে পড়ছে না, হয়তো ছিল। তবে গোশত-রুটির কথা মনে আছে। চালের আটার রুটি এবং প্রচুর ঝাল দিয়ে রাধা গরুর মাংস। ঝোলে কব্জি পর্যন্ত ডুবিয়ে রুটি খাওয়া শবে বরাতের অবশ্য করণীয় কর্মকাণ্ডের একটি।
রাতের খাওয়ার পরই গোসল। হাড় কনকনে শীতে গোসল সারতে হতো। গরম পানি না, পুকুরে। কারণ গোসল করে পাড়ে উঠার পর গা থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে যত ঘাস ভিজত তত সোয়াব। সোয়াব বাড়ানোর জন্যে ভেজা গায়ে ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে থাকা হত।” [ বই : সকল কাঁটা ধন্য করে]
ওপরের লেখাটি পড়ে একটি চিত্র আশা করি স্পষ্টভাবেই ধরতে পেরেছেন। এবং বড়োসড়ো একটি সাংস্কৃতিক চিত্র বুঝতে পেরেছেন। তো এই যে এমন উৎসবমুখর পরিবেশ বা এই জৌলুশপূর্ণ উৎসব হারানোই যদি উম্মাহর পতনের অন্যতম একটি কারণ হয়ে থাকে, আমাদের আত্মপরিচয় বিস্মৃত হবার উপাদান হয়ে থাকে, তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে— আমরা সেই জৌলুশ থাকাবস্থাতেই কেন আমাদের পতনের সাক্ষী হয়েছি? আবার অন্যদিকে আসহাবে রাসুল সা. কোন উৎসবের শক্তিতে আধা জাহান জয় করেছেন? কোন জৌলুশের জোরে পারস্য এবং রোমান সভ্যতার মতো শক্তিশালী সভ্যতার পতন ঘটিয়ে ইসলামের বিজয় কেতন আধা জাহানে উড়িয়েছেন? হুমায়ুন আহমেদের বাবারা তাদেরকে এরকম জৌলুশপূর্ণ পরিবেশে বড়ো করার পরেও কেন তারা দীনের নিশানাবরদার হিসেবে গড়ে ওঠেনি? কেন তাহলে তাঁর (হুমায়ুন আহমেদের বাবার) ঘর থেকে সুকৌশলে নাস্তিকতা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবাদ-প্রতিম পুরুষ জাফর ইকবাল পয়দা হয়েছে? শুধু হুমায়ন আহমেদ আর জাফর ইকবালই নয়, আপনি প্রত্যেকটি বঙ্গীয় সেকুলার বুদ্ধিজীবী-চিন্তক-সাহিত্যিকদের হিস্ট্রি ও পারিবারিক ঐতিহ্য ঘেঁটে দেখুন, প্রত্যেকেই তাদের শৈশব-কৈশোরে এমন উৎসবমুখর-জৌলুশপূর্ণ শবে বরাত পালনের মাধ্যমেই বড়ো হয়েছেন। তবুও তারা আল্লাহর দীন থেকে বিচ্ছুত। এখন যদি তারা এটাকে আল্লাহর দরবারে ধরনা দেওয়ার মাধ্যম তথা ইবাদাত হিসেবে শিখতো-জানতো, এর মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে মজবুত শিক্ষা পেত, তাহলে হয়তো এরকম না-ও হতে পারতো। আমরা এখন আবার এসব বলে (শবে-বরাতকে কথিত সংস্কৃতি বলে) কি ইসলামের মূল প্রাণসত্তাকেই হারিয়ে ফেলছি না? দীনের প্রাণ সত্তা বুঝি উম্মাহর শ্রেষ্ট প্রজন্মরা যা করেনি তার মধ্যেই নিহিত?
০২. আমার অনেক শ্রদ্ধেয় এবং স্নেহপরায়ন আদর্শিক-সহবস্থান সম্পন্ন ভাইয়েরাও দেখি ইদানীং এসব নিয়ে অতি আবেগধর্মী লেখালেখি করছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাঁরা বলছেন বা বলতে চাচ্ছেন, এটা হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, ইবাদাত না। শ্লোগান দিচ্ছেন এরকম— ‘শবে বরাত, আমাদের সংস্কৃতি।’ আমার কথা হচ্ছে শবে বরাত কোন দৃষ্টিতে সংস্কৃতি হতে যাবে? শবে-বরাত মুবারাক বলে আবার নতুন করে সম্ভোধন প্রক্রিয়া চালু হচ্ছে, এটা কোন ধরনের সংস্কৃতি? শবে-বরাত কি আসলেই উৎসব-উদ্দীপনার দিবস? নাকি এটা হলে ইবাদাতেরই মানে আল্লাহর দরবারে ধরনা দেওয়ার দিবসই হতে পারে?
এক ধরনের সালাফি বিদ্বেষ থেকে, সালাফি-ব্যাশিং করে এটাকে কালচার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়াটা আসলে কতোটা কল্যাণকর মুসলিম উম্মাহর জন্যে? আমাদের প্রিয় নবী সা., সাহাবায়ে আজমাইন এবং সালাফুস সালেহিনগণ কি আসলেই এটাকে সংস্কৃতি হিসেবে দেখত? না-কি, যারা দেখত, এটাকে ইবাদাত হিসেবেই দেখত? এই প্রশ্নটা নিজে নিজে একটু ভেবে দেখবেন।
শবে-বরাত বা নিসফি মিন শাবান নিয়ে যদিও অনেকেই অনেক প্রান্তিকতার আশ্রয় নেয়, কিন্তু আমি এসব প্রান্তিকতার (যেমন এটা কী আমলের রাত না প্রত্যাখ্যান করার রাত, এ রাতে ইবাদাত করা কি সহিহ না বিদ’আত ইত্যদি) ধারেকাছেও কখনো ঘেঁসতে চাই না। যদিও মানবিক দুর্বলতার কারণে আমার ভেতরেও মাঝেমধ্যে প্রান্তিকতা চলে আসে, এবং সেটা অনেকটা প্রকাশও হয়ে যায়! তবে এক্ষেত্রে আমার কথা হচ্ছে, শবে বরাত সহিহ কী বিদ’আত; সেটার বিতর্কে না গিয়ে আমি মনে করি— যে সব সাধারণ মানুষ এ রাতকে কেন্দ্র করে মসজিদে আসছে বা আসে, সে সব মানুষকে মসজিদে আসার পরে পরিকল্পিতভাবে টার্গেট নিয়ে কুরআন-সুন্নাহর বাণী শোনানোর কাজ আন্তরিকতার সাথেই করা উচিৎ। অন্যান্য সময় যেখানে তাদেরকে ডেকেও মসজিদে আনা যায় না, এখন তাঁরা যেহেতু নিজ উদ্যোগেই মসজিদে এসেছে, তাই মানুষের মসজিদে থাকার এই সময়টুকুকে পরিকল্পিতভাবেই দীনের দা’ঈদের কাজে লাগানো উচিৎ।
কিন্তু, একে বিদ’আত বলে পুরোদমে এগ্রেসিভলি ডিনাই করা, কিংবা একে ধর্মীয় দৃষ্টিতে বৈধতা দিতে না পেরে সংস্কৃতির নামে আরেকাট জাহিলিয়াতের পথকে প্রশস্ত করা; এগুলো কখনোই কল্যাণ বয়ে আনবে না। আপনি যদি একে সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করেন, তবে এই সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কার্যক্রমকেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর এসব করা মানেই দীনের প্রাণ সত্তাকে ধীরে ধীরে খুইয়ে ফেলা। ইসলামকেও হিন্দু-খৃস্টান ধর্মের মতো অনেকটা উৎসব-সর্বস্ব ধর্মে পরিণত করে ফেলা।
আবারও বলি, শবে-বরাতকে কেন্দ্র করে যে উৎসব-জৌলুশ-সংস্কৃতি ইত্যাদি বলা এবং প্রচার করা হয়ে থাকে, এই কথিত উৎসব উদযাপনের পেছনে “খাইরুল কুরূন” তথা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম সাহাবাদের থেকে শুরু করে তাবে’ঈ কিংবা তাবেতাবেঈ পর্যন্ত কারোই কোনো কর্ম বা সমর্থন নেই। এমনকী তাঁরা কেউ কাউকে দেখে এদিনে কোনো সম্ভোধন (শবে বরাত মোবারক বা এমন কিছু) করেছেন বলে প্রমাণের ছিঁটেফোটাও নেই। যদি থেকে থাকে, তাহলে জানাবেন।
তবে হ্যাঁ, তাঁরা ঈদ উপলক্ষ্যে একে অন্যকে সম্ভোধন করতেন, কিন্তু শবে বরাত বা নিসফি মিন শাবান উপলক্ষ্যে নয়। কিন্তু এই রাতে আল্লাহর ইবাদাতে মগ্ন থাকার নজির আমাদের পূর্ববর্তী বহু ওলামায়ে কেরাম ও মুজতাহিদ ইমামদের থেকে প্রমাণিত। কিন্তু আপনারা এটাকে ইবাদাতের সময়, আল্লাহর দরবারে ধর্না দেওয়ার রাত বানানোর পরিবর্তে সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে একটা সেকুলার কৃষ্টি চালু করার কাজ করছেন। আপনারা যারা এটা করেন, তাদের প্রতি আমার বিনীত নিবেদন হচ্ছে, আপনারা মেহেরবানী করে পূর্বের সেই জাহিলিপূর্ণ কর্মগুলো বা বিকৃতিগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে দীনকে আরো বেশি বিকৃতির দিকে ঠেলে দেবেন না। আপনারা হয়তো ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই করেছেন বা বলছেন এসব, কিন্তু এর চূড়ান্ত ফলাফল ভালো হবে না।
আর মূলত এটা করে আপনারা সেকুলাদের বয়ানকেই বৈধতা দিচ্ছন। তাদের বেঁধে দেওয়া ফ্রেইরমে থেকেই চিন্তা করছেন। প্রশ্ন হতে পারে সেটা কীভাবে? বিষয়টা হচ্ছে এরকম— সেকুলাররা হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি নামে রমনার বটমূলে যায়, পান্তা-ইলিশ খায়, মঙ্গল-শোভাযাত্রার মতো হরেক রকম অপকর্ম করে।
আপনারাও সেকুলারদের মুখ আর মগজ থেকে বের হওয়া বাঙালি সংস্কৃতির বিকল্প হিসেবেই তাদের উসুল ফলো করে বা তাদের মগজে, তাদের বেঁধে দেওয়া কাঠামোতেই চিন্তা করে বলে যাচ্ছেন যে, ওরা যেহেতু হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির নাম দিয়ে এটা-ওটা করে; আমাদেরও তাহলে আরো কিছু উৎসব লাগবে, আমাদেরও কিছু সংস্কৃতি লাগবে, আমাদেরও কিছু আয়োজন লাগবে, যেটার নাম হবে বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি!
ক্যান ভাই, কমিউনিস্ট-লিবারেল-সেকুলার ও অমুসলিমদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমাদেরকেও “বাঙালি মুসলিমদের সংস্কৃতি” নাম দিয়ে এমন একটা জিনিস বের করতে হবে কী কারণে, যেখানে আবার ইসলামের বাতাবরণে অনৈসলামিক, পারতপক্ষে ইসলাম পছন্দ করে না, এমন কার্যকলাপ চর্চা হবে? একজন নিখাঁদ মুসলিমের জন্যে আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসুলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম প্রদর্শিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রমই কি যথেষ্ট নয়?
০৩ আপনারা যারা বলেন যে, শবে বরাতকে বিদ‘আত বলায় বাংলাদেশের যুবকদের জন্য দুর্গাপূজা, হোলি উৎসব ছাড়া আর কোনো উৎসবই অবশিষ্ট থাকল না। তাদের উদ্দেশ্যে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, একজন সচেতন মুসলিম ছেলে-মেয়ে কি কখনো দুর্গোৎসবে শামিল হয় বা হয়েছে? হোলি উৎসবে কি এমন কোনো তরুণ-তরুণী অংশ নিয়েছে, যাদের দীনের সঠিক বুঝ ও তাওহিদের জ্ঞান রয়েছে?
যদি সত্যিই এমন কেউ না থেকে থাকে, তাহলে আমাদের প্রকৃত করণীয় কী? আমাদের কি এসবই করা উচিৎ, না-কি সমস্যার মূলেই হাত দেওয়া উচিৎ?
কিন্তু আমরা সেই মূলে হাত দেওয়ার কাজ না করে কেন সেকুলার, লিবারেল, কমিউনিস্ট ও অমুসলিমদের চিন্তাধারার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছি? কেন একটার পর একটা কপি-পেস্ট ভাবনা প্রয়োগ করছি?
আমাদের কি উচিৎ নয়— ইসলাম সম্পর্কে, দীনের বিধান নিয়ে, তাওহিদ আর শিরক বিষয়ে যুবকদের জ্ঞান দান করা, সচেতন করা? আমাদের এসব সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক উৎসব তো পতনকালে আরো বেশিই ছিলো, সেটা কি ইসলামের জন্যে উপকারী ছিলো? সেই উৎসবের বদৌলতে কি আমরা আমাদের বিজয় আর গৌরব ফিরিয়ে আনতে পেরেছি?
ইতিহাস সাক্ষী, যতদিন মুসলিম সমাজে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পরিবর্তে তাওহিদ ও বিশুদ্ধ বিশ্বাসের চর্চা ছিল, ততদিন তারা বিজয়ী ছিল। কিন্তু যখন থেকে বাহ্যিক উৎসব-আয়োজনই মুখ্য হয়ে উঠল, তখনই পতন ত্বরান্বিত হলো।
এই যে, যেসব ভাইয়েরা শবে-বরাতকে সংস্কৃতি বা কালচার বানাতে সোৎসাহে আর সাগ্রহে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, এতে করে তাঁরা দুটো জিনিসই স্পষ্ট করেন এবং মনের অজান্তেই স্বীকৃতি দেন—
১. শবে বরাত পালনের কোনো ভ্যালিডিটি নেই। অর্থাৎ ধর্মীয়ভাবে এটি স্বীকৃত নয়। ২. আমরা আল্লাহর দাসত্বের পরিবর্তে সংস্কৃতি, জৌলুসময় উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতার দাসত্ব করছি। অথচ আমাদের কর্তব্য ছিল কালচার,জৌলুশময় উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতারপরিবর্তে আল্লাহর দাসত্বকে-ই বরণ করে নেওয়া। এ ছাড়া এর দ্বারা আরও একটি বাড়াবাড়িকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়— অনেককেই দেখা যায়, সারা বছর সালাত-সিয়াম পালন করে না, হালাল-হারামের তোয়াক্কা করে না; কিন্তু একটি বিশেষ রাতকে কেন্দ্র করে অতিরঞ্জিত আমলে লিপ্ত হয়। যেমন, নিচের কথোপকথনটি লক্ষ করুন— একজন মৌসুমী ইবাদতকারী আরেকজন নিয়মিত সালাত আদায়কারী ভাইকে জিজ্ঞেস করল— — শবে বরাত নিয়ে আপনার মতামত কী? — আমার কোনো মতামত নেই। — আজকের রাত তো ভাগ্য নির্ধারণের রাত! — আচ্ছা, এটা পরে, আগে আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিন… আপনি আজ ফজরের নামাজ পড়েছেন? — না। জোহর-আসর? — না। মাগরিব তো অবশ্যই পড়েছেন… — না। — কেন? — একটু সমস্যা ছিল। — এশা তো অবশ্যই পড়বেন? — হ্যাঁ, অবশ্যই! — কেন? — শবে বরাতের নামাজ পড়তে হবে তো, তাই! — তাহলে ফরজ থেকেও আপনার কাছে নফলের গুরুত্ব বেশি? ব্যক্তিটি এবার চুপ হয়ে গেল। এটি কোনো কল্পিত গল্প নয়। বাস্তবতা এমনই। এরকম অজস্র উদাহরণ আপনার আশেপাশে অহরহই পাবেন। আমরা ফরজকে অবহেলা করে নফলকে ফরজের সমতুল্য করে তুলছি। কখনো কখনো ফরজের চেয়েও বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি নফলকে। নফল ইবাদতকে কেন্দ্র করে মসজিদে ভিড় জমাচ্ছি, অথচ ফরজকে অবহেলা করছি।
দেখুন, আমি কিন্তু শবে-বরাত নিয়ে একদেশদর্শী কথা না বলে এইটুকুন বলতে চাই— আমাদের তো ফরজকে কেন্দ্র করেই নফল ইবাদাত করার কথা ছিলো। কিন্তু নাহ, সেটা না। বরং আমরা নফলকেই ফরজের সমতুল্য গণ্য করছি,
০৪. এই যে যারা আজকে ‘শবে-বরাত আমাদের সংস্কৃতি’ বলে শ্লোগান তুলছে, তাদের অধিকাংশই স্রেফ নিজেকে একটু আলাদা, একটু ক্রিটিকাল থিংকার, একটু ইন্টালেকচুয়াল, একটু সুক্ষ্ম বুঝওয়ালা হিসেবে প্রদর্শন করার জন্যেই তা করছে। এরাই এক সময় শবে-বরাতকে বিদ’আত বিদ’আত বলে শোরগোল করতো। আমাদের দেশের দেওবন্দি আলিমদের সাথে এসব নিয়ে টক্কর ধরতো। কিছু সালাফি আলিমদের ভিডিয়ো-বক্তব্য দিয়ে তাদেরকে এই বলে ব্যাশিং করত—মদিনায় পড়নেওয়ালা আলিমরা দীন-শরিয়ত বুঝে না, শুধু কওমি-দেওবন্দিরাই বুঝে! এরা সংকীর্ণমনা। কুয়োর ব্যাঙ, মূর্খ ইত্যাদি। এরকম নানাবিধ কথাবার্তা বলে তাদেরকে ছোটো করতো। তাচ্ছিল্য করতো। মক করতো। ট্রল করতো। ব্যাশিং করতো। হেয় করতো। অপমান অপদস্ত করতে চেষ্টা করতো।
এখন যখন দেখেছে এভাবে আর নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা প্রদর্শন করা যায় না, শবে-বরাত না পালন করার মধ্যেও একটু মোল্লা মোল্লা ভাব আছে, তাই এখন নফসের খায়েশ বা প্রবৃত্তির পূজা থেকেই আবার পল্টি নিয়ে সালাফি-ব্যাশিং করার জন্যে বলছে, ‘এইটা আমাদের বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতি। সালাফিজম ইসলামটারে নীরস-বিবশ কইরা দিছে। এরা আরবের সংস্কৃতি বাঙালি মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে’, ইত্যাদি।
দেখুন, একই ব্যক্তির দুই দিকে একই পদ্ধতিতে ইউটার্ন— আলিম ব্যাশিং! আরো কথা বলার পদ্ধতি হচ্ছে শাহবাগীদের মতো। তারা যেমন ইসলামকে আরবের সংস্কৃতি, মরুচারী বেদুঈনদের সংস্কৃতি বলে প্রত্যখ্যান করে, তুচ্ছজ্ঞান করে; এরাও তেমনটাই করে। মানে আল্টিমেটলি তারা তাদের নফসের সাথে যা যায়, বিশাল এক অংশ আলিমদের ব্যাশিং করতে যখন যার থেকে যেটুকু প্রয়োজন, তখন তারা তার থেকে সেটুকুই নেন। আগে ফতোয়া নিয়েছেন সালাফি আলিমদের থেকে, তাও কোন ফতোয়া নিয়েছে দেখুন— যে ফতোয়ায় ইবাদাত ছিলো না। ইবাদাত করলে বিদ’আত হবার ফতোয়া নিয়েছে। সোজা কথায় ইবাদাত মুক্ত হবার ফতোয়া নিয়ে আমল করেছে। এখনো যেই ফতোয়া বা দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিয়ে তারা কথা বলে— সেটাতেও দীন নেই। ইবাদাত নেই। সেটা তাদের কাছে কেবলই সংস্কৃতি। তারা সব সময়ই আল্লাহর দাসত্বের চেয়ে যুগের দাসত্ব, নফসের দাসত্ব, মানুষের দাসত্ব করতেই বেশি ভালোবাসে। এ কারণেই দেখবেন তাদের এই উভয় ইউটার্নে কোনো রিচুয়াল এপ্রোচ ছিলো না। আগেরটায় ফতোয়া দিয়ে রিচুয়াল ইবাদাত মুক্ত হয়েছে। এখন আবার যে এটার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, সেখানেও কোনো রিচুয়াল প্রভাব নেই। সম্পূর্ণ রিচুয়াল প্রভাব মুক্ত হয়ে নিজের ইন্টালেকচুয়ালিটি দিয়ে একে জাস্টিফাই করা হয়/হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা এমন আচরণের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন, এমন এক দীনের আইডিয়া আমাদেরকে দিচ্ছেন, যে দীন হচ্ছে সেকুলার দীন। যে দীনে আবার সংস্কৃতি খুঁজতে হয় ইসলামের বাহিরে গিয়ে। ব্যাপারটা আসলেই দুঃখজনক!
০৫.একজন মুসলিম হিসেবে আমরা যদি এটাকে (শবে-বরাতের বাড়াবাড়িকে) কালচারাল-ওয়ার হিসেবেও নিই, তাহলেও উক্ত ভাইদের এই এপ্রোচটা ধোপে টিকে না। কারণ, মুসলমানদের নিকট সংস্কৃতি হচ্ছে এক সার্বিক ব্যবস্থাপনার নাম। ঈমানদারদের কাছে সংস্কৃতি মানে হচ্ছে মানুষকে গাইরুল্লাহর দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে এক আল্লাহ’র দাস হিসেবে বাঁচার আয়োজন শেখানো। সকল কিছুর দাসত্বকে পরিহার করে মানুষকে আজাদ দাস হয়ে চলতে শেখানো। ঈমানদেরদের সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক কাজ হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহের সাজে নিজে সজ্জিত হওয়া এবং এই জমিনের মানুষকেও সজ্জিত করা। এছাড়া সংস্কৃতির ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে যা-ই হোক, যা-ই আসুক, সেগুলো আদতে ইসলামি সাংস্কৃতি নয়। ইসলামি সাংস্কৃতি মানুষকে মুক্তির বারতা দেয়, কল্যাণের পথযাত্রী করে, মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে, আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অথচ তাদের এসব কথিত সংস্কৃতিতে না আছে আল্লাহর ভয়, না আছে পরকালের ভাবনা যোগানোর উপাদান, আর না আছে কোনো আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস। যারা কালচারাল-ওয়ারের কথা বলে, তাদের আলোচনায়, তাদের কথাবার্তায়-কাজেকর্মে এসব যদি সম্পূর্ণ অনুপস্থিতই থাকে, তাহলে কোন শক্তি দিয়ে তারা এই অসম ময়দানে বিজয়ী হবেন বলে আশা করেন?
তারা যদি সত্যিই সাংস্কৃতিক বিজয় চাইতো, তাহলে তো তাদের উচিৎ ছিলো শিরকের বিপরীত তাওহিদকে, জাহিলিয়াতের বিপরীত ইসলামকে, ইসলামের মূল স্প্রিরিট ধারণ করে এবং গুরুত্ব দিয়ে আমাদের সংস্কৃতিকে বিশুদ্ধ তাওহিদী সংস্কৃতি বানানোর কাজ করা! অথচ তারা করছে ঠিক উল্টোটা......! ফলাফল, ইসলামি চেতনা সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর রাম-বামদের মগজ থেকে বের হওয়া কপি-পেস্ট চিন্তার আলোকে কথিত বাঙালি মুসলিমদের সংস্কৃতি একই বিন্দুতে এসে মিলিত হচ্ছে। এটাকে আমি অবশ্য সেকুলার দীনই বলি। কারণ, তাদের আবিষ্কৃত এ সংস্কৃতি এমন এক সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতিতে পড়ে মুসলমান যুবকেরা তাদের মৌলিক মিশন-ভিশনকে চেপে রেখে এমন এক ধরনের জৌলুশপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায় মজে থাকে, যা তাদেরকে তাদের মূল লড়াই (খোদাদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে জয়ী হবার জন্যে ঈমান ও তাকওয়ার পারদ বৃদ্ধি করে বাতিলের জন্যে ত্রাশ হয়ে ওঠা) থেকে এক প্রকার দূরেই সরিয়ে রাখে বলা চলা।
সে কারণেই আমি মনে করি ঈমানদারদের কাছে সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক কাজ কখনোই হালুয়া-রুটি খাওয়ার উৎসবকে ইসলামি সংস্কৃতি বানানো নয়। মুসলমানদের জীবন-উদ্দেশ্যের মধ্যেই তার সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক কাজ স্পষ্ট হয়ে আছে। এটাকে শুধু খুঁজে বের করে যথাযথভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু তারা এটাকে খুঁজতে রাজি নয়। বরং তারা সেকুলার কৃষ্টির ইসলামাইজেশন করতেই ব্যতিব্যস্ত। এবং মুসলমানদের ভুল-শুদ্ধ সব কাজকর্মকে সেকুলারদের ভাষায় বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি নাম দিয়ে জায়েজ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত তারা। শুধু জায়েজ করার অপচেষ্টাতেই লিপ্ত নয়, বরং সেগুলোকে মহৎকর্ম হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার এক অস্বাভাবিক অপচেষ্টাও লক্ষণীয়।
০৬. হাজার বছর যাবত বলুন কিংবা যুগ যুগ ধরে বলুন, এই হাজার বছর ধরে তো বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক ভুল কাজও প্রচলিত ছিলো এবং আছে। যেমন ধরুন, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে মাজারে মান্নত করা, ফিরনী-পায়েশ দেওয়া, নারী পুরুষ একসাথে সম্মিলিতভাবে জিকিরের আড্ডা দেওয়া, মাজারে সিজদা দেওয়া, টাকার বিনিময়ে হুজুর ভাড়া নিয়ে কুরআন খতম করা, পীর বাবার কদমবুসি করা, রমাদানে খতমে তারাবিহর নামাজ ফাইভ-জি গতিতে আদায় করা, গ্রামে-গঞ্জে অশুদ্ধ ভাষায় আলিফ বে তে চে পড়ে কুরআন তিলাওয়াত করা বা এরকম অগণিত বিষয় আশয়ের প্রচলন ছিলো। এখন আপনি কি যুগ যুগ ধরে বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতির নামে সেগুলোকেও কি হালাল বা সহিহ বলে চালিয়ে দেবেন? যদি না দিতে চান, তাহলে তা কেন দেবেন না? এগুলোও তো এ মাটির সংস্কৃতি ছিলো! আপনি কেন সেগুলোকে উপড়ে ফেললেন বা ফেলতে চেয়েছেন? নিশ্চয়ই এজন্যই চেয়েছেন যে, স্থানীয় কালচার হবার পরেও তা ইসলামের শিক্ষার ওপর আঘাত হেনেছে। ইসলামের শিক্ষাকে বিকৃত করেছে।
এছাড়া, মূল বিষয় হচ্ছে যুগ যুগ ধরে মানুষ তো ভুল করে যেতেই পারে। কিন্তু ইসলাম তো গতিশীল। ইসলামের শক্তি, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তো এটাই যে, ইসলাম তার আপন শক্তিতে সে-সবকে সংশোধন করে এক বিশুদ্ধ অবয়ব দান করতে পারে। ইসলাম এসেছেই সকল কালচারের আলসার দূর করে মানুষের আকিদা-বিশ্বাসকে ইসলামের বিশুদ্ধ চেতনায় উদ্ভাসিত করার জন্য। বিশ্ববাসীকে তাওহিদের পতাকাতলে একীভূত করার জন্য।
সে কারণে ইসলামি আদর্শের একজন একনিষ্ঠ অনুগামী হিসেবে, একজন নিখাঁদ আন্তরিকতা সম্পন্ন মুসলিম হিসেবে আমাদের ঈমান এবং ইলমের দাবি কি পূর্বসূরীদের ভুলগুলোকে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোটায় হালাল, সহীহ এবং ইসলামি সংস্কৃতি হিসেবেই চালিয়ে দেওয়া? নাকি ভুল যা, বিচ্যুতি যেটুকু, সেটুকুকে শ্রদ্ধার সাথে এড়িয়ে যাওয়াটাই উচিৎ আমাদের জন্য?
[সর্বশেষ আবারও উল্লেখ করতে চাই, আমি শবে বরাতের গুরুত্ব স্বীকার করি এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই যে, এটা হলে ইবাদতের রাতই হতে পারে। হ্যাঁ, ফরজ ইবাদতের মতো গুরুত্বপূর্ণ তো নয়-ই, বরং এর ধারেকাছের গুরুত্বও নেই। তবে মানুষ বাহিরে, দোকানে, রাস্তাঘাটে, ফোনে-মোবাইলে থাকার তুলনায় এই রাতের উছিলায় হলেও মসজিদে আসা, ইমাম সাহেব বা আলিমদের দীনি আলোচনার মজলিশে বসা, দুই রাকাআত নফল আদায় করা, তিলাওয়াত করা অবশ্যই ভালো এবং উত্তম। কিন্তু সেটাকে কেবলই একটা সাংস্কৃতিক বিষয়, আমাদের কথিত হাজার বছরের সংস্কৃতির কথা বলে চটুল আলাপের পক্ষে না।
আমি মনে করি মুসলমানদের জীবনে তাদের দীনই তাদের সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতি দীন সাপোর্ট করে না, সেটা মুসলমানদের জন্য কোনো ধরনের সংস্কৃতির মধ্যেই পড়ে না। হ্যাঁ, সেটা স্রেফ সেকুলার কৃষ্টিই হতে পারে।
এখন শবে বরাতকে এক সময় এক ঘরানার আলিমদের বিদ্বেষ থেকে (হানাফি দেওবন্দি আলিমদেরকে ঘৃণা বা বিদ্বেষ থেকে) কিছু সালাফি শাইখদের বক্তব্যকে পুজি করে পরিহার করে এখন আবার সালাফি বিদ্বেষের জায়গা থেকে স্রেফ “হাজার বছরের সংস্কৃতি” নামে ইবাদাতহীন বা আল্লাহর ভয় ও আনুগত্যহীন যে বয়ান তৈরি; আমি কেবল কঠিনভাবে সেটারই বিপক্ষে। আমি মনে করি কেবলই সাংস্কৃতিক কথা বলে এই ইবাদাতকেও সেক্যুলারাইজেশন করা হচ্ছে।]
~রেদওয়ান রাওয়াহা
তাং : ২০.০৩.২২ ইং
Comments
Post a Comment