পাকিস্তানিরা কি সত্যিই আমাদের মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চেয়েছিলো?
যা বলার ছিলো
ইউটিউবে দেখলাম সাবেক শাহবাগী-কমিউনিস্ট নেতা, আজ্ঞেয়বাদী, পিনাকী ভট্টাচার্য দাদা একটা ভিডিও আপলোড করেছেন। ভিডিওটির শিরোনাম কিছুটা আমার এই লেখাটার শিরোনামের মতোই ছিলো। তবে ভেতরে তিনি এরকম একটা কথা লিখেছেন— “একুশের ল্যাদল্যাদে আবেগের ব্যবচ্ছেদ”। কিন্তু সেই ল্যাদল্যাদে আবেগের যথেষ্ট ব্যবচ্ছেদ পিনাকীদা করেছেন বলে মনে হয়নি আমার কাছে। বরং মনে হয়েছে/দেখা গেছে তিনি নিজেও সেই আবেগের ফাঁদে আঁটকে আছেন।
সে যাই হোক, তিনি এক সময় সিপিবির পদধ্বারী নেতা ছিলেন, কঠিন শাহবাগী ছিলেন, সে হিসেবে তাঁর কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা করাটাও ঠিক না। তবে এতোটুকু সঠিক— তিনি কথিত প্রগতিশীলদের তুলনায় যথেষ্ট সৎ, ভালো এবং বায়াস মুক্ত। বঙ্গীয় নামধারী প্রগতিশীলরা যেখানে সার্বক্ষণিক বাংলাদেশের গণমানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, যেকোনো মূল্যে ইসলাম কোপানোর মিশনে লেগেই থাকে, সেখানে অন্তত বাহ্যিকভাবে হলেও পিনাকীদা গণমানুষের ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করেন এবং বলেনও বটে। অন্যদের মতো ইসলাম কোপানোর কাজে লেগে থাকেন না। এই হচ্ছে মোটামুটি তাঁর বাহ্যিক চিত্র। অন্তরের অভ্যন্তরে কী আছে সেটা তো আর আমাদের জানা সম্ভব নয়; তাই সুধারণা করাটাই উত্তম। তবে, কিছু বিষয় মনে রাখা উচিৎ আমাদের। সেগুলো হচ্ছে— একজন মানুষ পরিপূর্ণভাবে পক্ষপাতহীন হতে পারে না, কখনো সম্ভবও নয়। আর অন্যটা হচ্ছে— তাঁর মন-মানসিকতা, শিক্ষাদীক্ষা, বেড়ে উঠা; সবই হয়েছে অমুসলিম পরিবার ও পরিসরে। রাজনীতিও করেছেন ইসলামের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে, খেয়ে না খেয়ে লেগে থাকা একটা ইসলাম বিদ্বেষী সংগঠনের। তাই তাঁর সবকিছুই সেসব চিন্তাধারা ও প্রভাব থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্ত থাকবে, এটা আশা করা ঠিক না। যাই হোক, তাঁর ভিডিওর সূত্রধরে আমি 'মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চাওয়ার বিষয়টা নিয়েই আমি বিষয়টা আরেকটু ক্লিয়ার করে আলোচনা করতে চাই। চলুন, শুরু করি।
আমরা যা শুনে এসেছি
সেই ছোট্টকাল থেকেই আমরা শুনে এসেছি এবং শুনে যাচ্ছি যে, পাকিস্তানিরা “আমাদের মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চেয়েছিলো।” এবং এমন একটা চরম জনপ্রিয় গানও আছে। যে গানে বলা হয়— ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়....। এই যে 'মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চাওয়া', বলা হচ্ছে এই কাইড়া নিতে চাওয়ার কারণেই আমরা রক্ত দিয়েছি। রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা আদায় করেছি। কিন্তু আসলেই কি এই দাবিটা সত্য?
মূলত আমাদের এই উপমহাদেশে ইংরেজরা অব্যাহতভাবে লুন্ঠন-দস্যুতা চালিয়ে গেছে প্রায় দুইশো বছর। দীর্ঘ এই দুইশো বছর যাবৎ অনেক লড়াই-সংগ্রাম করার পরে তারা আমাদেরকে বাহ্যিক-স্বাধীনতা দিয়েছে। আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়ে উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যাবার সময় আমাদের মুসলমান নেতৃবৃন্দের দাবি ও আন্দোলনের ফলে মুসলমানদের জন্য আলাদা একটা আজাদ ভূখণ্ড দিয়ে গেছে। (যদিও সেখানে অগণিত ঝামেলা পাকিয়ে গিয়েছে)। যার ফলাফল হলো আজকের বাংলাদেশ। মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে আন্দোলন করার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে :
ক) ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের তুলনায় হিন্দু ধর্মের মানুষ বেশি। হিন্দু-মুসলমান মিলে কেবল একটা রাষ্ট্র হলে স্বভাবতই হিন্দুদের স্বার্থ বেশি প্রাধান্য পাবে, মুসলিমরা উপেক্ষিত থাকবে।
খ) হিন্দুধর্মের অনুসারী এবং হিন্দু নেতৃবৃন্দ বিগত দুইশো বছর ইংরেজদের সাথে তাল মিলিয়ে মুসলমানদের ওপর নানাবিধ জুলুম-অত্যাচার করেছে, ইংরেজদের নিপীড়নে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে, এবং মুসলমানদেরকে নানাভাবে অবমূল্যায়ন করেছে।
এতোসব তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের জন্য আলাদা ও স্বাধীন রাষ্ট্র তথা পৃথক আবাসভূমি দাবি করেন। আজকের আওয়ামী লীগের জাতির পিতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরব ছিলেন, আন্দোলন করেছিলেন।
একটা সময় সেই মোতাবেক ইংরেজ শাসক নামক ডাকাতরা যাবার সময় হিন্দু ও মুসলিম এই দুই ধর্মের ওপর ভিত্তি করে মানুষদের জন্য পৃথক দুটো রাষ্ট্র করে দিয়ে যায়। আমাদের আজকের বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত হবার কারণে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে আবির্ভূত হয় তখন। যদি এটি মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ড না হতো, তাহলে আজকে এটি ভারতের স্রেফ একটি অঙ্গরাজ্যই হতো। এরচেয়ে বেশি কিছু না। সবকিছু মিলিয়ে এখন যেহেতু পাকিস্তান হয়েছে, এবং ইসলামকে ভিত্তি করেই পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু এখানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামই হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইসলামের বিধিবিধান শাসক শ্রেণি প্রতিষ্ঠা করেনি। যাই হোক, এটা ভিন্ন আলাপ। এই আলাপ অন্য একদিন করা যাবে। আলাপটা মূলত রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। তো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এটা নিয়েও খুব বেশি কথাবার্তার কিছু ছিলো না। কারণ, ভারতের কংগ্রেস-নেতৃবৃন্দ হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে একমত ছিলেন, এবং অধিকাংশ হিন্দুই এটাকে সমর্থন করতেন। বিপরীতে মুসলিম নেতৃবৃন্দও (এমনকী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নেতারাও) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকেই গ্রহণ করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন বা এ ব্যাপারে একমত হলেন। তবে হুট করেই আবার সামান্য কিছু অংশ বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে দাবি তুলে বসলেন। এদের অধিকাংশই হচ্ছে বামপন্থী। তবে খেয়াল করুন— এটা রাষ্ট্রভাষা, মাতৃভাষা নয় কিন্তু। যিনি প্রথম দাবি তুললেন, তিনি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি তৎকালীন আমাদের দেশের তথা পাকিস্তানের গণপরিষদেই এই দাবি উত্থাপন করলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন তখন দুর্ভাগা। ভাগ্য তাঁর সহায় ছিলো না। কেউই তখন তাঁর এই দাবি সমর্থন করেনি।
এই যে, গণপরিষদে তাঁর দাবি উত্থাপন, সেই দাবি কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত গণপরিষদের বাঙালি সদস্যরাও না সমর্থন করেননি। কেবল তিনজন অমুসলিম সদস্য এই দাবিটার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলেন। যে তিনজন অমুসলিম গণপরিষদ-সদস্য সমর্থন দিলেন সেই দাবির প্রতি, তাঁরা হলেন— প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তান সফর
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের ১৮ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ (রহ.)। ২১ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে,“উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”। আবার খেয়াল করুন, এটা মাতৃভাষা নয়— রাষ্ট্রভাষা। এখানে কিন্তু বাংলায় কথা বলা যাবে না, বাংলায় লেখা যাবে না, পড়া যাবে না; এরকম কোনো ঘোষণা কখনোই ছিলো না। তিনি সারা পাকিস্তানের জন্যই কেবল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন।
এর কয়েকদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সামনে তিনি আরো একটি ভাষণ প্রদান করেন। সেখানেও তিনি রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বললেন, পাকিস্তানের প্রদেশগুলো নিজেদের সরকারি কাজে যে কোনো ভাষা ব্যবহার করতে পারে, তবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে একটিই এবং তা হবে উর্দু। (পলক গুপ্ত, বিবিসি নিউজ বাংলা, লন্ডন। প্রকাশের তারিখ : ১৯.০২.২১)।
মাতৃভাষা বনাম রাষ্ট্রভাষা
দেখুনতো, ওখানে কি তিনি মাতৃভাষা বা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কিছু বলেছেন? পুরো পাকিস্তানের সব মানুষেরই কোনো একটা সুনির্দিষ্ট ভাষা ছিলো না, মানে একটা কমন ভাষা ছিলো না। তারা কেউ-ই তাদের আঞ্চলিক ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন, মিছিল-মিটিং, দাবি কিছুই করেনি। সেই পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচ, পশতু, কাশ্মীর— কেউই না। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালি নেতাদের অধিকাংশও সেই দাবি করেননি। তাঁরা কেবল রাষ্ট্রের একতা ও সংহতির লক্ষ্যেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছেন। যেমন কেউ একজন নোয়াখালীর ছেলে। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা তার মাতৃভাষা। কিন্তু সে যখন ঢাকায় বা অন্য কোনো জায়গায় যায় বা অবস্থান করে, অথবা অন্য মাতৃভাষার কারো সাথে কথা বলে, তখন কিন্তু তিনি চেষ্টা করে প্রমিত বাংলাতেই কথা বলতে। একইভাবে একজন সিলেটি বা চট্টগ্রামের মানুষও তা-ই করে। এখন এই যে সবাই প্রমিত ভাষায় কথা বলে নিজ অঞ্চলের বাহিরে গেলে, সেই প্রমিত ভাষা ঠিক করেছে বাংলা একাডেমি। কিন্তু আমরা প্রমিত ভাষায় কথা বলি বলে, “আমার মুখের ভাষা কাইড়া নেওয়া হয়েছে”, আমার মাতৃভাষা হারিয়ে গেছে; বিষয়টা এমনও নয়। তদ্রূপ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ উর্দুকেই ঠিক করেছেন। এই যে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছে, এটা যে পাকিস্তানের নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার কারণে করেছে, সেটাও না। যেটা অবশ্য পাকিস্তান সৃষ্টির প্রেক্ষাপটের ওপর আলোচনার অংশ থেকে সবারই বুঝে আসার কথা।
মুখের ভাষা কাইড়া নেওয়ার দাবি কখন গ্রহণযোগ্য হতো?“
মুখের ভাষা কাইড়া” নেওয়ার এই যে বায়বীয় আবেগী গল্প, এই বায়বীয় আবেগী গালগল্প তখন কিছুটা হলেও হালে পানি পেতো আমাদের কাছে, যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সবাই উর্দুভাষী হতো। কারণ, তখন আমি বা আমরা এই টাইপের একটা গল্প ফেঁদে বসে থাকতাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সবাই উর্দুভাষী, আর পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ তাদেরকে (পশ্চিম পাকিস্তানিদের) বেশি মূল্যায়ন করতে গিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করেছে। কিন্তু না! এই গপ্পো-ফেঁদে বসারও সুযোগ নেই। বরং পুরো পাকিস্তানের ২/৩ বা ৬/৭ ভাগ মানুষেরই মাতৃভাষা কেবল উর্দু ছিলো।
এমনকী পূর্ব-পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের কোনো নেতার মাতৃভাষা কেবলই উর্দু ছিলো বলে অন্তত আমার জানা নেই। বড়ো একটা অংশের মাতৃভাষা উর্দু থাকলে হয়তো এটাকে কেন্দ্র করেও পিনাকীর ভাষায় ‘ল্যাদল্যাদে একটা আবেগী গপ্পো’ জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। তবুও পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মাতৃভাষার বিষয়টা যদি কারো জানা থাকে, তাহলে আমাকে জানালে আমি অবশ্যই সংশোধন করে নেবো, ইন শা আল্লাহ।
এখানে একটা কথা, সে সময় অভিজাত মুসলিম পরিবারের সদস্যরা প্রায় সবাই কমবেশি উর্দু ভাষা-ই বেশি ব্যবহার করতেন। অধিকাংশ মুসলমানই উর্দু পারতেন। সে হিসেবে আবার মাতৃভাষা উর্দু হতে পারে। যেমন বাঙালি মুসলিম নেতারাও উর্দুতে কথা বলতেন।
পাকিস্তানের বাঙালি নেতাদের অবস্থান
পাকিস্তানের বাঙালি নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক থেকে শুরু করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমীন— কেউ-ই এই রাষ্ট্রভাষা বাংলা করতেই হবে, এই নিয়ে কোনো ধরনের ক্যাঁচালে জড়াননি। বরং তাঁরাও উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে একমত ছিলেন। এবং তাঁদের কেউ কেউ দৃঢ়তার সাথেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন। যেমন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী— তিনিও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। (বই: পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-৩য় খণ্ড, লেখক বদরুদ্দিন উমর। একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই বদরুদ্দিন উমরও কিন্তু বামপন্থী। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দোসর)।
আবার দেখুন, ঢাকার নেতা খাজা নাজিমুদ্দিনও কিন্তু পল্টনে এক সমাবেশে বলেছিলেন— উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। (বই: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন)।
দেখুন, এটা কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো নেতা বলেননি। আমাদের বাংলার নেতারাই বলেছেন। কিন্তু যদি ‘মুখের ভাষা কাইড়া’ নিয়ে আমাদের তৎকালীন পুরো পাকিস্তানের মানুষের ওপর মাতৃভাষা হিসেবে উর্দুকেই চাপিয়ে দেওয়া হতো— বাংলা, বেলুচ, পশতু ইত্যাদি ভাষায় যোগাযোগ করা, সাহিত্য সৃষ্টি করা, সাংস্কৃতিক কাজ করা নিষিদ্ধ করা হতো, তাহলে এটা অবশ্যই বলা যেতো যে, “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়”। আর যদি এটা করাও হতো, তাহলে কি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো পূর্ব-পাকিস্তানের বাঘা বাঘা বাঙালি নেতারা এটা মেনে নিয়ে চুপ করে বসে থাকতেন বলে মনে হয় আপনার কাছে?
মাতৃভাষা ও বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা
আমরা যদি আমাদের দেশের দিকেই আরেকটু সচেতনভাবে খেয়াল করি, তাহলে দেখবো যে— আমাদের দেশে যারা বাংলার আঞ্চলিকরূপ ছাড়াও অন্যান্য ভাষায় কথা বলেন, তাদের নিজস্ব সেসব ভাষাও কিন্তু হুমকির মুখে নেই। তাদের নিজস্ব ভাষায় তারা সংস্কৃতি চর্চা করেন, আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ করেন, বইপত্র লেখেন। গান-কবিতা লেখেন, সুর করেন, চর্চা করেন। নিজেদের মধ্যে নিজেরা সেসব ভাষাতেই কাজকর্ম করেন। যেমন: চাকমা ভাষা, মারমা ভাষা বা গারোদের আচিক ভাষা ইত্যাদি। তাদের এই ভাষাগুলো কিন্তু তাদের মাতৃভাষা। তবে তাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা আবার অন্যটা— বাংলা। তারা বাংলায় পড়াশোনাও করেন। রাষ্ট্রের অফিসিয়াল কাজকর্মও করেন এই বাংলাতেই।
অন্যান্য দেশের অবস্থা
চলুন, এবার আমরা আমাদের দেশের বাহিরেও একটু ঘুরে আসি। আমরা যদি ভারতের দিকেও খেয়াল করি, সেখানেও দেখবো যে, তাদের সংবিধান অনুযায়ী তাদের সরকারের দাপ্তরিক ভাষা দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দি এবং ইংরেজি। কিন্তু সেখানে তো অন্যান্য ভাষাও আছে। বাংলা ভাষার অনেকগুলো, বলতে গেলে অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ কর্মগুলো (গল্প উপন্যাস কবিতা) তো ভারতের কলকাতার বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যিকদেরই সৃষ্ট। তাদের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি আর ইংরেজি হওয়ায় সেখানের গুজরাটি, তেলুগু, তামিল, অসমিয়া, বাংলা ইত্যাদি ভাষাগুলো কি ধ্বংস হয়ে গেছে? হিন্দি আর ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা হওয়ায় তাদের কি নিজস্ব মাতৃভাষা নষ্ট হয়ে গেছে? এতে করে কি তাদের ‘মুখের ভাষা কাইড়া নেওয়া’ হয়েছে? নাহ, কিচ্ছু হয়নি। সবার সবকিছুই আছে। সবকিছু ঠিকঠাকমতোই চলছে। এছাড়াও আপনি পৃথিবীর অন্যান্য সব রাষ্ট্রের দিকেও যদি তাকান, দেখবেন সবার নিজেদের মাতৃভাষা কিন্তু রাষ্ট্রভাষা না।
চীন-আমেরিকা-রাশিয়া ইত্যদির মতো বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোরও একই অবস্থা। চীনে মোট ৫৬ ধরনের জাতির বসবাস আছে। কিন্তু তাদের সবার মাতৃভাষাই কি রাষ্ট্রভাষা? নাহ, কেবল মান্দারিন ভাষাটাই রাষ্ট্রভাষা। আবার ইন্দোনেশিয়ার দিকে লক্ষ্য করুন, সেখানের রাষ্ট্রভাষা কিন্তু ‘বাহাসা ইন্দোনেশিয়া’। এখন আপনাদেরকে জাফর ইকবালের ভাষায় একটা বাক্য বলি— আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রভাষা ‘বাহাসা ইন্দোনেশিয়া’ হলেও এটি কিন্তু তাদের সবার মাতৃভাষা নয়। বরং তা কেবল ৪-৫% মানুষের মাতৃভাষা। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রভাষাটি মালয় ভাষার একটি প্রমিত রূপ। আর এটা সুদীর্ঘকাল থেকেই তাদের লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাদের দেশে ৩০০+ ভাষা আছে। সবচেয়ে বেশি মাতৃভাষা যেটা, সেটা হচ্ছে ‘জাভাই’ ভাষা ৷ এই ভাষাতে কথা বলে অন্তত ৫০% মানুষ। তবুও তাঁরা আমাদের মতো একটা বায়বীয় আবেগী গল্প ফেঁদে বসেনি যে, “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়”। বরং তাদের অর্ধেক জনঘোষ্ঠির ভাষা ‘জাভাই’ হওয়ার পরেও তারা মালয় ভাষার একটা উপভাষা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
কেন করেছে এটা? এটা করেছে তারা নিজেদের দেশের সব নাগরিকদের মধ্যে ইনসাফ করার জন্যে, এতো ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে সমতা বিধান করে বৈষম্যরোধ করার লক্ষ্যে।মাতৃভাষা তাদের যা-ই হোক, তারা যোগাযোগ-শিক্ষাদীক্ষা ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ‘বাহাসা ইন্দোনেশিয়া’কে স্বাচ্ছ্যন্দের সাথে গ্রহণ করেছে। কারণ, স্বাভাবিকভাবেই যদি সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা জাভাইকে রাষ্ট্রভাষা করা হতো, তবে অন্যান্য ভাষাভাষীর মানুষেরা বৈষম্যের শিকার হতো। তাদের মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষা হবার কারণে তারা অন্যদের তুলনায় স্বভাবতই বেশি সুযোগ-সুবিধা পেতো।
উর্দুকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কারণ
আমাদের আজকের বাংলাদেশ এবং তৎকালীন পাকিস্তানেও পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ উর্দুকে এ কারণেই রাষ্ট্রভাষা করেছেন যে, এটি (উর্দু) একটা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা ভাষা। এবং যে কয়েকজন ব্যক্তি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছিলো, কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাদেরকে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারেও এটা বুঝিয়েছেন যে, পাকিস্তান সবে মাত্র কায়েম হয়েছে। এখানে অনেক ভাষাভাষী আছে, সবাই যদি সবার মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করে, তাহলে রাষ্ট্রের সংহতি হুমকির মুখে পড়বে। ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাঙ্গালিদের ওপর দীর্ঘদিন যাবৎ ইংরেজ এবং তাদের দোসর মূর্তিপূজকরা যেভাবে শোষণ করেছে, এতে বাঙ্গালিরা ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিক্ষা-দীক্ষায় আরো পিছিয়ে পড়বে। কিন্তু মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার ওপর না শুধু, পাকিস্তানের অন্যকোনো ভাষাতেই তিনি হস্তক্ষেপ করেননি। অথচ এ দেশের কিছু মানুষ, বিশেষত বামপন্থীরা রাষ্ট্রভাষা উর্দু করায় রটিয়ে দিয়েছে— ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়! এরচেয়ে হাস্যকর এবং আজগুবি আবেগি মিথ্যাচার আর কী হতে পারে?
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় কী জানেন? তা হলো স্বয়ং মোহম্মদ আলী জিন্নাহর মাতৃভাষাও উর্দু ছিলো না। ছিলো গুজরাটি। কিন্তু তিনি গুজরাটি ভাষাকে আমাদের মাতৃভাষা করতে চাননি। তিনি শুধু একটা কমন ভাষায় পাকিস্তানের মানুষদেরকে আনতে এবং রাখতে চেয়েছেন। সেই চাওয়াটা ভুল না শুদ্ধ, তা হতে পারে ভিন্ন আলাপ। এটা নিয়ে বহু আলোচনা করতে পারি আমরা। এটার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে পারি আমরা। কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে অযথা একটা মিথ তৈরি করা, মুখের ভাষা কাইড়া নেওয়ার নামে একটা বায়বীয় গল্প তৈরি করা কখনোই উচিৎ নয়।
চেতনা প্রদর্শনকারীদের ভণ্ডামি ও হীনমন্যতা
যারা ভাষা আন্দোলন নিয়ে আজগুবি চেতনা দেখায়, এদের অধিকাংশই কথায় কথায় ইংরেজি ছাড়া কোনো বক্তৃতাই করে না। ইংলিশ মিডিয়াম ছাড়া নিজেদের সন্তানদের পড়াশোনাই করায় না। দেখবেন তাদের বাচ্চারাই অনর্গল হিন্দি ভাষায়ও কথা বলে। তাদের ঘরে অবিরত হিন্দি সিরিয়ালগুলো চলতেই থাকে। এমনকি তারা বাংলা ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার্থে কোনো উদ্যোগও নেয়নি বা নেয় না। জায়গায় বেজায়গায় অশুদ্ধ বানান, এলোমেলো বাক্যগঠন-শব্দচয়ন, আর অপ্রয়োজনীয় ইংরেজির মিশ্রণে বাংলা ভাষাকে এরাই বীভৎসরূপ দিয়ে রাখে।
সারাবছর শহীদ মিনারে নেচে-কুঁদে একাকার হয়ে থাকে। জুতো নিয়ে হাঁটা-হাঁটি, চলাফেরা সবই করে। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি নামক দিনটি আসলে হুট করেই সেটাতে জুতো নিয়ে উঠা যাবে না বলে ফতোয়া জারি করে। বাংলা নিয়ে আবেগের বহিঃপ্রকাশ করলেও উদযাপন করে ইংরেজি মাসে এবং ইংরেজি তারিখেই। এগুলোর চেয়ে ভণ্ডামি এবং হীনমন্যতা আর কী হতে পারে?
ভুল বোঝার অবকাশ নেই
যাই হোক, আমার এই লেখাটা পড়ে এটা বুঝার সুযোগ নেই যে, আমি বাংলা ভাষার বিরোধী। বরং আমি সবচেয়ে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করি, পছন্দ করি বাংলা ভাষাকেই। আরবি এবং বাংলা— এই দুটো ভাষাই আমার সর্বাধিক প্রিয় ভাষা। আমি মনে করি আমার আদর্শ প্রচারের জন্যেই বাংলার চর্চা এবং বাংলায় পারদর্শী হওয়া উচিৎ। বাংলা ভাষা নিয়ে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম, গত শতাব্দীর অন্যতম একজন মুফাক্কিরে ইসলাম, ইমাম আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) এর একটা পরামর্শ আছে, তাঁর সেই পরামর্শ হচ্ছে এই— আলিম সমাজ এবং ইসলামপন্থীরা যেনো বাংলা ভাষার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
হ্যাঁ, আমিও চাই বাংলা ভষার নেতৃত্ব ইসলামন্থীরা গ্রহণ করুক। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসুক। এর মাধ্যমে সাহিত্য চর্চা করুক। গবেষণা করুক। চিন্তা চর্চা করুক। কিন্তু, এই ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে অযথা যেসব বাড়াবাড়ি আর ঘৃণার চর্চা করা হয়, রাষ্ট্রভাষা আর মাতৃভাষাকে যে একই ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়, আমি কেবল সেগুলোকেই অপছন্দ করি। আর সর্বোপরি পিনাকীদা যে একুশের ল্যাদল্যাদে আবেগের ব্যবচ্ছেদ করতে এসেছেন, আমার কাছে মনে হয়েছে এই ব্যবচ্ছেদটা যথোপযুক্ত হয়নি। সে কারণেই ওনার আলোচনার সূত্র ধরে আমার অগোছালো-এলোমেলো কিছু কথা হাজির করেছি । জানি না মনের ভাব কতোটুকু সুন্দর আর সাবলীলভাবে প্রকাশ করতে পেরেছি, আর যা বুঝাতে চেয়েছি, সেটার কতোটুকুই-বা প্রকাশ করতে পেরছি। আশা করি আমার লেখার অক্ষমতাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে পাঠকবৃন্দ মূলপাঠটা উপলব্ধি করবেন ইন শা আল্লাহ।
|| রাষ্ট্রভাষা বনাম মাতৃভাষা : প্রচলিত বয়ান ও বাস্তবতা||
~রেদওয়ান রাওয়াহা
২২.০২.২২ ইং
Comments
Post a Comment