মুশরিকদের সাথে ইবরাহিম (আঃ)-এর যুক্তিতর্ক এবং আমাদের জন্য শিক্ষাসমূহ
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তাঁর
কওমের মানুষেরা মূর্তি পূজায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। তাঁর বাবাও মুর্তি পূজারিদের দলে।
এসব দেখে তিনি মানসিকভাবে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লেন । তাদেরকে এর অসরতা নিয়ে নিয়মিত
বুঝিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু কেউ কোনো পাত্তা দিচ্ছেনা।
তারা তাঁর সাথে বিবাদ-বিস্বাদ এবং
ঝগড়াঝাঁটিতে জড়িয়ে পড়লো। তারা যখন তাঁর সাথে এসব নিয়ে তর্ক করতে এগিয়ে এলো, তখন তিনি তাদেরকে সুস্পষ্টরূপে জানিয়ে দিলেন—
“আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা কি আমার সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও? অথচ তিনি আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। আমাদের কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্য; আর আমরা তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ।”
তিনি তাঁর বাবাকেও এ বিষয়ে সরাসরি বললেন— “বাবা, আপনি কি ওই মূর্তিগুলোকে রব্ব মানেন? আমি তো দেখছি, আপনি এবং আপনার জাতির লোকেরা সুস্পষ্ট ভুলের মধ্যে আছেন।”
দিনের পর দিন এভাবে তিনি বুঝিয়ে
যেতে লাগলেন। তাদের অসরতা-অকর্মণ্যতা প্রকাশ করে যেতে লাগলেন। অতঃপর আরেকদিন তিনি
পুনরায় নিজ পিতাকে বললেন—
“বাবা আপনি কেনো সেসব জিনিসের ইবাদাত করেন? যেগুলো কানে শুনেনা, চোখে দেখেনা এবং আপনার কোন উপকার করতে পারেনা। বাবা আমি সত্য জ্ঞান লাভ করেছি, যা আপনি লাভ করেননি। আমার দেখানো পথে চলুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবো। আপনি কেনো শয়তানের দাসত্ব করছেন? শয়তান তো দয়াময় মহান আল্লাহর অবাধ্য।”
কিন্তু অন্ধভক্তিতে তাঁর বাবা
তখনও আকণ্ঠ নিমজ্জিত। নিজ সন্তানের তাওহিদি আহ্বানকে তিনি পাত্তা দিলেন না। উল্টো
সন্তানকে আরো শাসিয়ে দিলেন। বললেন—
“ইবরাহিম, তুমি কি আমার খোদাদের থেকে দূরে সরে গেলা ? জেনে রাখো, এই পথ থেকে ফেরত না এলে, আমি তোমাকে পাথর মেরে হত্যা করবো।”
সাঈয়িদুনা ইবরাহিম মনোবল ভাঙলেন না। তিনি মনে মনে ভাবলেন এমন কোনো কাজ করা দরকার, যাতে পুরোটা সমাজের ভিত নড়ে ওঠে। তাদের হারানো হুঁশ ফিরে আসে। একই সাথে যেনো তাদের অন্তরের অভ্যন্তরেও একাত্ববাদের যে চেতনা, সে চেতনার যেনো উন্মেষ ঘটে। আর সে কারণেই তিনি একদিন ঘোষণা করলেন; তোমাদের অনুপস্থিতিতে একদিন তোমাদের এই মিথ্যে খোদাদের বিরুদ্ধে একটা চাল চালবো। কিন্তু ইবরাহিমের কথায় তারা কোনো গুরুত্ব দিলোনা।
ইবরাহিম (আঃ)-এর সম্প্রদায় বছরের
একটা বিশেষ দিনে উৎসব পালন করতো। এবারও তারা সকলেই সে উৎসবে যোগদান করলো। লোকেরা
তাঁকেও সে উৎসবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালো। অনেক চাপাচাপির পরও তিনি গেলেন না।
একপর্যায়ে তাঁর পিতা এসে নিয়ে যেতে চাইলেন। পিতার সাথে তিনি কিছু দূর গেলেনও, অতঃপর একটা জায়গায় এসে তিনি বললেন, ‘আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমি আপনার সাথে যেতে পারবোনা। এরপর
তাঁর বাবা তাঁকে রেখেই চলে গেলেন। লোকজন
তাঁকে পথে দেখে জিজ্ঞেস করলো কী ইবরাহিম, এখানে কেনো? চলো আমাদের সাথে।
তিনি যাবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। যখন তারা অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে লাগলো তার ওপর, তখন তিনি বললেন আমি অসুস্থ। একপর্যায়ে
সকলেই চলে গেলো উৎসবে। গোটা শহরে রয়ে গেলেন শুধু ইবরাহিম আলাইহিস সালাম।
তিনি মনে মনে নিয়ত করলেন যে, এই সুযোগে তিনি তাদের ঠাকুর ঘরে প্রবেশ করবেন। মূর্তিগুলোকে
ভেঙ্গে চুরচুর করে ফেলবেন। যাতে তাদের বোধদয় ঘটে। তারা যাতে এমন ঘৃণিত কাজ থেকে, মিথ্যে প্রভুর উপাসনা থেকে ফিরে আসে। নিজ চোখেই তারা যেনো
নিজেদের বাতিল উপাস্যদের নির্মম অসহায়ত্বের সকরুণ দৃশ্য অবলোকন করতে পারে। তিনি
ভেবেছিলেন হয়তো এর মাধ্যমে তাঁর গোত্রের কিছু লোকের অন্তরেও ঈমান ফয়দা হবে। ঈমানী
চেতনা জাগ্রত হবে। তারা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে এবং শিরক থেকে পবিত্র হয়ে তওবা
করবে। এরপর সে চিন্তা হতে একপর্যায়ে তিনি মন্দিরে ঢুকে পড়লেন। দেখলেন সারিবদ্ধভাবে
দাঁড়িয়ে আছে তাদের তৈরি মূর্তিগুলো। এবং সে মূর্তিগুলোর সামনে রয়েছে হরেক রকম
খাবার-দাবার এবং সুস্বাদু ফলফলাদি।
তিনি নীরব নেত্রে সেসব চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলেন। একে একে সবকিছু অবলোকন করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন মূর্তিগুলোর দিকে । সেগুলোকে লক্ষ্য করে বললেন— তোমাদের সামনে এতো বাহারি রকমের উপঢৌকন আর খানাপিনা রয়েছে, কিন্তু সেসব ‘তোমরা তা খাচ্ছো না কেনো? তারা চুপ। নিষ্প্রাণ পাথরের মূর্তি কী আর কথা বলার ক্ষমতা রাখে? এবার তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন— কী ব্যাপার তোমরা কথা বলছ না কেনো? কুড়াল দিয়ে কষে আঘাত করলেন মুর্তিগুলোকে। আঘাতে আঘাতে সবগুলোকে গুঁড়িয়ে দিলেন। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো যেটা, ওটাকে কিছু করলেন না। সেটাকে আগের মতোই স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে দিলেন।
তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের পরে তারা যথারীতি ফিরে এলো এবং মন্দিরে গিয়ে
মূর্তিগুলোর এমন বেহাল অবস্থা দেখে তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। তারা নিজেদের
মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো, এটা নিশ্চয়ই
ইবরাহিমের কাজ হবে। কারণ, আমরা তাকে এদের
সমালোচনা করতে দেখেছি। তাদের নেতারা রাগে-গোস্বায় গরগর করে কাঁপছে। নেতারা আদেশ
করলো ইবরাহিমকে যেনো নিয়ে আসা হয়। অতঃপর ইবরাহিমকে ডেকে আনা হলো।
যুবক ইবরাহিম হাজির তাদের সামনে।
তারা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। তিনিও যথেষ্ঠ কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তাদের
প্রশ্নের জবাব দিলেন। পবিত্র কুরানুল কারিমে সে জিজ্ঞাসাবাদ ও জবাবের বিষয়টি
এভাবেই এসেছে,
‘হে ইবরাহিম! আমাদের উপাস্যদের সাথে এমন আচরণ কি তুমিই করেছো’?
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাদেরকে
যথাযথ জবাব দেয়ার একটা মহা মওকা পেয়ে গেলেন। তিনি বললেন —
এসব আমাকেই কেনো জিজ্ঞেস করছো? ‘ আমি না, তাদের মধ্যে এই যে বড়োটা, সে-ই এসব করেছে, তারা যদি কথা বলতে পারে তবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখো।’
তারা এই জবাব শুনে লজ্জায় মাথা
অবনত করে ফেললো এবং বললো—
‘ইবরাহিম ! তুমি তো জানো, এরা কথা বলতে পারেনা।’ ‘ তখন তাদের কথার প্রতিউত্তরে ইবরাহিম আলাইহিস সালাতু আসসালাম বললেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত করো, যা তোমাদের কোনো ধরনের উপকারও করতে পারেনা, এবং ক্ষতিও করতে পারেনা। তোমাদের এবং তোমাদের দেবতাদের জন্য আফসোস, তোমরা কি বোঝোনা’?
ইবরাহিমের এমন কথাবার্তা শুনে তারা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। তারা তেড়ে আসলো তাঁর দিকে। তিনি বিন্দুমাত্রও ভয় পেলেন না। বরং আগের চেয়ে আরো দ্বিগুণ সাহস-শক্তিসহ বলে উঠলেন— ‘তোমরা এমন জিনিসের দাসত্ব করো , যা তোমরা নিজেরাই নিজেদের হাতে তৈরি করো। ‘অথচ আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন’
যুক্তি-বুদ্ধি-বাস্তবতার কাছে
হেরে গিয়ে তারা শক্তি প্রয়োগের সীদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। তাদের অহংকার এমন পর্যায়ে
পৌঁছে গিয়েছে যে, সত্যকে কাছ থেকে
দখেও সেই সত্যের প্রতি তারা আত্মসমর্পিত হলো না। এবং তারা নিজেদের পরামর্শ সভায়
ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ব্যাপারে এমন হটকারী সীদ্ধান্ত গ্রহণ যে, এর বিষয়টি রাজদরবারে উপস্থাপন করতে হবে। রাজাকে ভালোভাবে
বুঝিয়ে তাকে হত্যা করতে হবে। যেইভাবা সেইকাজ। তারা রাজার কাছে গেলো। রাজাকে বুঝালো
যে,
এই ছেলেকে কোনোক্রমেই বাঁচতে দেওয়া যাবেনা। একে বাঁচিয়ে
রাখা হলে সে আরো ক্ষতি করবে আমাদের বাপ-দাদার ধর্মের। অবশেষে রাজ দরবার থেকে তাঁকে
এক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে মারার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলো। সেই শাস্তিটা কি
জানেন ?
সেটা হলো সাঈয়েদুনা ইবরাহিমকে তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার
শাস্তি। এমন বর্বর পৈশাচিক শাস্তি দেওয়ার সীদ্ধান্ত শুধু একটি মাত্র কারণেই নিলো, সেটা হলো অসংখ্য দেবদেবির পূজা-অর্চনা না করে শুধু এক ইলাহ
আল্লাহর দাসত্ব করার দাওয়াত পেশ করা।
রাজার মন্ত্রী ও দেশের প্রধান পুরোহিতের ছেলে ইবরাহিমকে রাজ দরবারে আনা হলো। যে রাজার কাছে আনা হলো, সে নিজেও ছিলো এক পাক্কা জালিম। টানা চারশো বছর ধরে সে রাজত্ব করে যেতে লাগলো। তাই সে নিজেও সীমাহীন অহংকারী এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। নিজেকেই উপাস্য হিসেবে ভেবে বসে আছে। তা-ও একমাত্র আরাধনারযোগ্য উপাস্য।
সেও যথারীতি ইবরাহিমকে প্রশ্ন করা
শুরু করলো। প্রথম প্রশ্নটাই হলো যে এমন, ‘বলো তোমার উপাস্য কে’?
তিনিও দৃঢ় অথচ শীতল কণ্ঠে জবাব দিলেন যে, ‘আমার রব তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যুও প্রদান করেন। এবার রাজা মৃত্যদণ্ড প্রাপ্ত দু’জন কয়েদীকে ধরে এনে সকলের
সামনে একজনকে হত্যা করলো, আর একজনকে ছেড়ে
দিলো। এবং ইবরাহিম আলাইহিস সালাতু আসসালামকে জবাব দিলো , ‘আমিও তো জীবন দান করতে পারি এবং মৃত্যু ঘটাই’।
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এবার ভীত
হলেন না। তাঁর ভেতর ছিলো দাওয়াতি মনোভাব। তাই তো তিনি জনতার সামনে নির্ভিক চিত্তে
উত্তর দিলেন—
‘আমার আল্লাহ তো
সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদয় ঘটান, তুমি তাকে
পশ্চিম দিক হতে উদিত করো তো দেখি’। এই
যুক্তিপূর্ণ জবাব শুনেই সে পুরোপুরি নির্বাক ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। কিন্তু তবুও সত্যের কাছে মাথা নতো
করেনি। মেনে নেয়নি সত্যকে। তাওহিদকে। আল্লাহর একত্ববাদকে। যেভাবে তাঁর নিজ কওমের
নেতারাও মানেনি।
জালিম বাদশা তখন নির্দেশ জারি করলেন যে, সাঈয়েদুনা ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে জ্বলন্ত আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার। সেই সাথে সাথে রাজা তার প্রজাদেরকেও মিথ্যে প্রভু দেবদেবিদের দোহাই দিয়ে বললো, ‘তোমরা একে পুড়িয়ে মারো এবং তোমাদের সাহায্য করো উপাস্যদের, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’ ।
যুক্তিতর্কে হেরে গিয়ে নমরূদ
ইবরাহিম (আঃ)-কে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুকুম দিলো। আর তা বাস্তবায়নের জন্য বিশাল এক
আগুনের কুণ্ডলী তৈরি করা হলো। তিনি তাঁকে
পুড়িয়ে ছারখার করে মারার এতোসব আয়োজন দেখেও বিন্দুমাত্র ঈমান থেকে দূরে
সরেননি। তিনি শান্ত-স্থির। তাঁর মাঝে কোনো ভয়-শঙ্কা নেই। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও নেই।
জালিম-আল্লাহদ্রোহী বাদশাহ অনেক
শ্রমিক দিয়ে বিশাল বড়ো একটা গর্ত বানিয়ে সে গর্তে সম্রাজ্যের বড়ো বড়ো গাছগুলো
দিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ রকমের আগুনের লেলিহান তৈরি করেছিলো। সে লেলিহান আগুনের
কুণ্ডলীতে নিয়ে আসা হলো সাম্রাজ্যের
একমাত্র তাওহিদবাদী যুবক ইবরাহিমকে। গর্তের আগুনের বিশালতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়্লো।
আগুনের লেলিহান শিখা এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে,
কোনো মানুষ গর্তের ধারে-কাছেও
যেতে পারে না।
যেহেতু গর্তের দ্বারে-কাছেও যাওয়া যায় না, তাই তারা যুবক ইবরাহিমকে আগুনে কোন উপায়ে আগুনে ফেলবেন, সেটা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। অবশেষে সে উপায় বের করেও ফেললো। অনেক উঁচু একটি লোহার দোলনা তৈরি করা হলো। ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে সেখানে উঠিয়ে দেওয়া হলো। তিনি আগুনে দগ্ধ হয়ে কীভাবে ছাই হয়ে মারা যায়, রাজা ও তার মন্ত্রীপরিষদ গর্তের কিছুটা দূরে একটি উঁচু মঞ্চ তৈরি করেছে তা দেখার জন্য। তারা এমন ঘটা করেই ইবরাহিম আলিহিস সালামকে পোড়াবার মনস্থির করেছে যে, তাদের অসহায় রুগ্না নারীরা পর্যন্ত মানত করলো; তারা যদি সুস্থ হয়ে যায়, তাহলে তারাও ইবরাহিমকে পোড়াবার জন্যে খড়-লাকড়ি যোগাড় করবে।
একপর্যায়ে তাঁকে গর্তে নিক্ষেপ করা হলো। তবুও তিনি নির্ভিক। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাননি তিনি। ভেঙেও পড়েননি। যে সময় তাঁকে দোলনায় উঠিয়ে ঘুরপাক দিয়ে ফেলে দিবে, ঠিক সেই মুহূর্তেও তাঁর ঈমান টলেনি আল্লাহর থেকে। তাঁকে আগুনের কুণ্ডলীতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। আর সে সময়ও তিনি এক্ত্ববাদের সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মুখ থেকে সে সময় উচ্চারিত হচ্ছিলো এই দু’আটি — حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ ‘আমার জন্য আমার আল্লাহই যথেষ্ট। তিনিই উত্তম অভিভাবক’।
আল্লাহর ওপর যাঁর পূর্ণ ভরসা, সারা দুনিয়ায় এমন কী আছে বা কে আছে যা দিয়ে তাকে ভীত-বিহ্ববল করা যাবে? আর যাকে স্বয়ং আল্লাহই রক্ষা করবেন বা করেন, তাবৎ
দুনিয়ায় এমন কে এবং কী আছে যে জিনিস বা যে ব্যক্তি তার ক্ষতি করবে? যুবক ইবরাহিমেরও
আল্লাহতে ছিলো পরিপূর্ণ দৃঢ়তর আস্থা ও ঈমান। আল্লাহও সেই আস্থা আর ঈমানের প্রতিদান
দিলেন। তাঁকে আগুনে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ আগুনকে আদেশ করলেন—
‘হে আগুন, আমার ইবরাহিমের
জন্য তুমি শান্তিদায়ক হয়ে যাও’। ইবরাহিম (আঃ) আগুনের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হলেন; কিন্তু একটু পুড়ছেন না, বরং তিনি
সুস্থ্-সুন্দর আছেন। বেশ ভালোই আছেন। স্বাভাবিক আছেন। শুধু কপাল থেকে সামান্য একটু
ঘাম ঝরেছিলো একবার। আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলার পবিত্র কালামে পাকে বিষয়টি এভাবেই
এসেছে—
‘তারা ইবরাহীমের বিরুদ্ধে মহা ফন্দি আঁটতে চাইলো। অতঃপর আমরা তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম’। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আমরা তাদেরকে পরাভূত করে দিলাম।
আমরা যারা দ্বীনের পথে চলতে
চেষ্টা করি, আমরাও এভাবে ইবরাহিম আলাইহিস
সালামের মতো আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থাও বিশ্বাস রাখতে পারি। তিনি যেভাবে আল্লাহর
একত্ববাদের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার চিন্তায় বিভোর ছিলেন, তাঁর
মতো আমরাও আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত, তাঁর একত্ববাদের দাওয়াত
পৌঁছে দেয়ার মতো চিন্তায় মুখিয়ে থাকতে হবে। আর যাঁরা ইতোমধ্যে আমাদের রব্ব আল্লাহর
দ্বীনের দাওয়াত মানুষের ধারে ধারে পৌঁছে দেয়ার কাজ করি, আমাদের
ওপরও বিপদের বিমান ক্রাশ হতে পারে। নানান ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার সমূহ সম্ভবনা আছে,
সে সময় আমরাও যেনো তাঁর মতো আমাদের ঈমানের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
হতে পারি, আমাদের যেনো সে প্রচেষ্টাটা থাকে সর্বোত্তমভাবে!
এছাড়া আমরাও জীবনের পরতে পরতে সংকটে আর সংগ্রামে
নিপতিত হয়ে পড়ি। আমরাও যদি এই অনুভূতিটা হৃদয়ে বদ্ধমূল রাখতে পারি যে, আমার সাহায্যকারী হিসেবে, আমার অভিভাবক হিসেবে,
সর্বাবস্থায় আমার আল্লাহই আমার জন্যে যথেষ্ট।
আমরা যদি আমাদের অন্তরে
লুকানো ব্যথাগুলোকে,
কলিজার কষ্টগুলোকে। আমাদের সর্বপ্রকার অশান্তিগুলোকে, আমাদেরর অসুস্থতাকে, রোগ-শোক আর বিপদ-আপদকে, আমাদের বুকজুড়ে বেড়ে ওঠা বিষণ্ণতা আর যন্ত্রণাগুলোকে, আমাদেরর দুঃখ-যাতনাগুলোকে আমরা যদি তাঁর স্বকাশেই পেশ করি। তাঁর কাছেই
উপস্থাপন করি। তাঁর কাছেই নিবেদন করি; তাহলে তিনিই আমাদেরকে
শান্তি দিতে পারেন। তিনিই আমাদেরকে স্বস্তি আর মুক্তি দিতে পারেন। তিনিই করে তুলতে
পারেন সুস্থ ও শক্তিমান! তিনিই দূর করতে পারেন বিপদ-মুসিবত আর দুর্বলতাগুলোকে।
কারণ, আমরা জানি, আমরা বিশ্বাস করি
নিশ্চয়ই তিনিই সর্বোত্তম ফায়সালাকারী। সাহায্যকারী আর অভিভাবক হিসেবেও তাঁর মতো
কেউ নেই! কেউ নেই! সুতরাং আমাদের জন্যে তিনিই যথেষ্ট। শুধুই তিনি। আর কারোই প্রয়োজন
নেই। কখনোই না! কেউই না...
হুবহু এই কথাটিই পবিত্র
কালামুল্লাহ মাজিদে সূরা নিসার ৪৫ নং আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন।
আমাদের হৃদয়-মন এবং মুখেও এই আয়াতটি সদা-সর্বদা ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত হওয়া উচিত।
আয়াতটি বা দু’আটি সম্মানিত পাঠক সমাজ
এখুনি মুখস্থ করে রাখতে পারেন। ও কাফা বিল্লাহি ওলিয়্যা, ও কাফা বিল্লাহি নাসিরা... وَ
کَفٰی
بِاللّٰهِ
وَلِیًّا
وَّ
کَفٰی
بِاللّٰهِ
نَصِیۡرًا ... কিংবা মনের গোপণ কোণে জমিয়ে রাখতে পারি হাসবুনাল্লাহু
নি’মাল ওকীল...
حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ এই দু’আটিও। কারণ, এটা শুধু ইবরাহিম আলাইহিস সালাম নয়, আমাদের প্রিয় নবিও একই প্রার্থনা করেছিলেন। উহুদ যুদ্ধে আহত মুজাহিদগণ যখন শুনতে পেলেন যে, আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে না গিয়ে পুনরায় মদিনায় ফিরে এসেছে মুসলিমদেরকে, আল্লাহর দ্বীনের পক্ষের মুজাহিদদেরকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যখন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, সে সময় কাফিরদের পক্ষ হয়ে যখন কিছু গুজব রটনাকারী মুসলমানদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্যে বলেছিলো যে, তোমাদের বিরুদ্ধে কাফিররা বিরাট সাজ-সরঞ্জামের সমাবেশ করেছে, সুতরাং তোমরা তাদের ভয় করো। তাদের এমন কথাবার্তায় মু’মিনরা কর্ণপাত না করে , ভয় না পেয়ে উল্টো আরো সাহসের সাথে তাঁরা রাসুলে আকরাম স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের নেতৃত্বে ঘোষণা দিয়ে উঠলেন যে— حَسْبُنَا اللّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ، ‘আমার জন্য আমার আল্লাহই যথেষ্ট। তিনিই উত্তম অভিভাবক। শুধু এইটুকুই নয়। বরং এটা পবিত্র কুরআনুল কারিমেরও আয়াত।
// ইবরাহিম (আঃ)-এর জীবনী এবং আমাদের জন্য শিক্ষা//
~রেদওয়ান রাওয়াহা
Comments
Post a Comment