~বদলে যাওয়া বদলে দেওয়া-৭ম পর্ব

 



অসাধারণ স্মার্ট আবু যার আল গিফারী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) । কোনো একটা কাজ করতেছিলেন। কিংবা যেকোনো কারণেই হোক একজন গরিব-দাসের সাথে কথা বলছিলেন। কথা বলা অবস্থায় তিনি তাকে গালি দিলেন। তার মা ছিলো অনারবি। তাকেও গালি দেন। কেউ কেউ বলেন তিনি গরিবদের মধ্যে সম্পদ বন্টন করছিলেন ; এমনই সময় সে লোকটি বললো হে আবু যার ! আপনি এভাবে বন্টন না করে ওভাবে করলে ভালো হয়। তখন আবু যার (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কিছুটা ক্ষেপে উঠলেন। বলে ওঠলো—তোর মত দাস, নিকৃষ্ট আর কুচকুচে কালো মায়ের সন্তান আমার মুখের ওপর কথা বলিস ? এত্তো বড় সাহস তোর!! এই শুনে সে মানুষটি রাসূল স্বল্লালাহু আলাহি ওসাল্লামের কাছে আবু যার আল-গিফারির বিরুদ্ধে নালিশ করলেন।



প্রিয় নবিজির জীবনে রাগ তো ওরকম ছিলো না। কিন্তু তিনি জীবনে যেই সময়গুলোতে অধিক রাগান্বিত হয়েছেন তার মধ্যে এইদিন একটি। তিনি এতটা বেশিই রাগান্বিত হয়েছেন যে তার সফেদ শরীর টুকটুকে লাল হয়ে শরীরের নীল রঙের রগ পর্যন্ত বের হয়ে এসেছিলো। তিনি দৌড়ে এসে আবু যার গিফারিকে কলার জিজ্ঞেস করলেন—
হে আবুযার! তুমি কি অমুককে গালি দিয়েছো? আবু যার বললেন হ্যাঁ।
তিনি বললেন : তুমি কি তার মা তুলে গালি দিয়েছো? আবু যার বললেন হ্যাঁ।
রাসুলুল্লাহ স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম বললেন : তোমার জন্যে আফসোস আবু যার! আইয়ামে জাহেলিয়াতের মূর্খতা ও জাহালাত এখনো তোমার মনে বাসা বেধে আছে ! জাহিলি যুগের স্বভাব-চরিত্র তোমার ভেতর এখনো বিদ্যমান !!
আবুযার আল গিফারি রাসুলে কারিম স্বল্লল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লামকে বললেন এই বৃদ্ধ বয়সে এখনো আমার মধ্যে জাহিলিয়াতের স্বভাব বিদ্যমান?
রাসুলুল্লাহ স্বল্লাল্লাহু আলিহি ও’সাল্লাম জবাব দিলেন ; হ্যাঁ। এখনো বিদ্যমান। তুমি তার মা তুলে গালি দিয়েছো । গায়ের রঙ নিয়ে খোঁটা দিয়েছো।


এর পর আবুযার আল গিফারি (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) কী করলো জানেন ? আমাদের মতো অধিক আত্মসম্মান নিয়ে বসে ছিলেন ? মনে মনে কি এই ভেবেছেন যে; এর সমুখে আর যাবো না, তার সাথে কথা বলবো না, সারাজীবন তার খুত খুঁজে বেড়াবো, তাকে কষ্ট দেবো, দোষ ধরবো, গীবত করবো ? নাহ!
এরপর আবুযার গিফারি রাদ্বিয়াল্লাহু নিজেকে পরিপূর্ণভাবেই বদলে ফেলেছেন। নিজের এই ভুল উপলব্ধির পরে সারাজীবন আর কাউকে তিনি রঙ নিয়ে বর্ণ নিয়ে খোঁটা দেননি। গালাগাল করেননি। অধীনস্থদের সাথে যথেষ্ট উন্নত আচরণ করেছেন। নিজে যেমন পোষাক পরতেন, তাদেরকেও সে একই ধরনের পোষাক পরাতেন। রাজকীয়ভাবেই রাখতেন দাসদের। নিজে যে চাদর গায়ে দিতেন, সে একই চাদর গোলামের গায়েও দিতেন। কুফার অধিবাসী বিশিষ্ট তাবেয়ী মা‘রূর ইবনে সুয়াইদ রাহ.ও আবু যার আল-গিফারির এমন আচরণের সাক্ষী। তিনি বলেন, আমি রাবাযায় আবু যর গিফারী রা.-এর সাথে সাক্ষাৎ করি। দেখলাম, তাঁর পরনে যে পোশাক তাঁর গোলামের পরনেও সেই পোশাক।

এই হলো বদলে দাও বদলে যাওয়ের নমুনা। তাঁরা বদলে গিয়ে সবকিছুর বড়াই, বাড়াবাড়ি আর অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। হোক তা ধন-দৌলত, রূপ-সৌন্দর্য বা বংশের গৌরব। আর এই হোলো প্রিয় নবিজির সহচর। তাঁরাও মানুষ ছিলো। ভুল করতো। বিচ্যুত্যি তাদেরও হতো, যেহেতু মানুষ। কিন্তু ভুলকে ফুল মনে করে আত্মঅহংকারে পড়ে আঁটকে ধরে সেটার উপর অটল থাকতো না তাঁরা।


আল্লাহর রাসুলের কাছে বিচার দেওয়ার পরে তিনি ইচ্ছে করলে তাঁকে আচ্ছামত শাসাতে পারতেন। বিরূপ আচরণ করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। তিনি নিজেকেই বদলে ফেলেছেন।

একটা বিষয় কি জানেন? কে এই আবু যার, যার সম্পর্কে আল্লাহর নবির কাছে অভিযোগ উত্থাপন করা হলো? এই আবু যার হলো সেই আবু যার, উম্মাতের মধ্যে সর্বপ্রথম যিনি রাসুলে আকরাম স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামকে সালাম করেছেন। এই আবু যার হলো সেই আবু যার, যিনি ‘সাবিকীনে আওয়ালীনে’ তথা ইসলামের প্রথমদিকে ঈমান আনয়নকারী একজন ছিলেন। এই আবু যাওর হলেন সেই আবু যার, যাঁর সম্পর্কে আল্লাহর হাবিব মুহাম্মাদ স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম বলেছেন—এই ধুসর মাটির উপরে, এই সবুজ আকাশের নিচে আবু যরের চেয়ে বেশি সত্যভাষী আর কেউ নেই।’ আর একজন দাস কিনা এমন একজন মানুষের সম্পর্কে আল্লাহর রাসুলের কাছে অভিযোগ করেছেন। তিনিও কী অদ্ভুত সুন্দরভাবে নিজকে সংশোধন করে নিয়েছেন। এই হচ্ছে তাঁদের বৈশিষ্ট্য। দোষ-ত্রুটি সামনে আসার পর তাঁরা অনুতপ্ত হয়েছেন এবং নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছেন। দোষ-ত্রুটিকে অবহেলার বিষয় মনে করেননি। আর এভাবেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা গ্রহণের মাধ্যমে তাঁরা পরিশুদ্ধ হয়েছেন ও পরবর্তীদের জন্য উত্তম আদর্শে পরিণত হয়েছেন।

~বদলে যাওয়া বদলে দেওয়া-৭ম পর্ব
~রেদওয়ান রাওয়াহা

Comments

Popular posts from this blog

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

গণতন্ত্র, শত্রুতা ও পারস্পরিক বিরোধিতা

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ