জিহাদ-ভ্রাতৃত্ব এবং আনাস বিন নাদর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।
১.
আকাবার তিনটে শপথ হয়। তিনি ইসলাম
গ্রহণ করেন শেষ শপথে। জিহাদের জজবা আর শাহাদাতের উচ্ছ্বসিত আকাঙ্ক্ষা ছিলো তাঁর
শিরা-উপশিরায়। প্রতিটি ধমনীতে। তবুও তিনি ইসলামের প্রথম জিহাদে অংশগ্রহণ করতে
পারেননি।
তবে তিনি অংশগ্রহণ করতে না পারলেও
আল্লাহর রাসুলের নেতৃত্বে গুটিকয়েক মু'মিন জিহাদের ময়দানে কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আল্লাহর অবারিত
রহমতে মুমিনগণ একচ্ছত্রভাবে বিজয়ী হয়। জয়ের মালা পরিধান করেন তাঁরা।
অতঃপর যুদ্ধ শেষ করে আল্লাহর
রাসুল মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। যখনই রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
ফিরে এলেন, তখনই তিনি রাসুল সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে অসীম অনুতাপ নিয়ে উপস্থিত হলেন, আর প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেন যে, সামনে যদি কখনো খোদাদ্রহী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক আসে, তখন তিনি সেই ডাকে সাড়া প্রদান করে আল্লাহর রাহে প্রাণপণে লড়াই
করে যাবেন। জিহাদ করে যাবেন।
২.
বদরের প্রান্তরে পরাজিত হয়েছে
মুশরিক বাহিনী। কিন্তু পরাজিত শক্তি মুশরিকদের অন্তরের অন্তস্থলে হিংসার উত্তাল
দাবানল দাঊদাঊ করে জ্বলতেই লাগলো। মুমিনদের বিরুদ্ধে, রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে
পরাজিত মুশরিকরা ষড়যন্ত্র আর কূটকৌশল এঁটে যেতে লাগলো। নিয়মিত। নিয়ম করে।
মুমিনদেরকে, আল্লাহর সৈনিকদেরকে, আল্লাহর নবী এবং তার উম্মাতদেরকে আল্লাহর জমিন থেকে উৎখাত
করার মিশন পরিচালনা করে যেতেই লাগলো সেই পরাজিত শক্তি মুশরিকরা। সেই কূটকৌশল, সেই ষড়যন্ত্রের মরনছোবলেরই ফলাফল হলো উহুদ প্রান্তরে
"উহুদ যুদ্ধ"। আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাদের সেই
উন্মাদনার জবাব দেয়ার জন্য মুমিনদেরকে সাথে নিয়ে রণসাজে সজ্জিত হয়ে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সংগঠিত হলো
আরেকটি যুদ্ধ। "উহুদ যুদ্ধ" যার নাম। তখন চলছিলো হিজরি তৃতীয় সন ।
এ যুদ্ধের পর্যায়গুলো খুবই
ইন্টারেস্টিং। প্রথম পর্যায়ে বীর বিক্রমে সিংহ গর্জনে কাফিরদের ওপর আধিপত্য বজায় রেখে জিহাদ করে গিয়েছেন মুসলিম
বাহিনী। এখানে মুশরিকরা মুসলমানদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পরাজিত হয়ে পড়ে। পিছু
হটে। এই পিছু হটা দেখেই এক পর্যায়ে মুসলিম বাহিনী যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে ময়দান ত্যাগ
করে গণিমত সংগ্রহে মনোনিবেশ করেছিলো, তখন তৎকালীন মুশরিক নেতা খালিদ বিন ওয়ালিদ বিষইয়টি খেয়াল করলো। খালিদ বিন
ওয়ালিদের আক্রমণে মুমিনগণ বড়ো রকমের এক বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়।
গণিমত সংগ্রহ কিংবা খালিদের
আক্রমণ,
ইত্যাদিতে যখন মুসলিমগণ যখন বিক্ষিপ্ত আর বিচ্ছিন্ন হয়ে
ময়দান ত্যাগ করেছিলো, তখন তিনি পিছু
না হটে অসীম সাহস আর দৃঢ়তায় ভরা ঈমান নিয়ে জিহাদ করার জন্যে, আল্লাহর দ্বীনের পতাকাকে বুলন্দ করার জন্যে সম্মুখপানে
এগিয়ে যেতে লাগলেন। আর সাথে সাথে তাঁর-ই সাথি মুসলিমদের হয়ে যাওয়া এই ভুলের জন্যে
আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন। দু'আ করলেন। নিজের
দ্বীনি ভাইদের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে বলতে বলতে লাগলেন, "হে আল্লাহ! এই মুসলমানরা যা করছে তার জন্য আমি আপনার নিকট
মাগফিরাত কামনা করছি।"
ওহুদের ময়দানের অবস্থা যখন এমন
ইতস্তত ও বিক্ষিপ্ত। হতাশা-ভয়-জড়তা ইত্যাদিতে আড়ষ্ট যখন সকলের মন-মনন-ঈমান, এমনকি উমার ইবনুল খাত্তাব ও তালহা ইবন উবাউদুল্লাহ
রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমাদের
মতো জাঁদরেল সাহাবাগণও দুঃখ-ভারাক্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় নিজেদেরকে গুটিয়ে
নিয়ে বসে ছিলেন। তখন তিনিই হয়ে উঠলেন তাঁদের অপার-অসীম অনুপ্রেরণার অনল জ্বালিয়ে
দেওয়া ব্যক্তি। উমার ইবনুল খাত্তাব ও তালহা ইবন উবাউদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমাদেরকে এমন অবস্থায় দেখে তিনি তাঁদের প্রশ্ন করলেন
যে,"আপনারা এভাবে বসে আছেন কেন?
তাঁরা জবাব প্রদান করলেন, " রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম নিহত
হয়েছেন।" তখন আল্লাহর দ্বীনের এসব
মুজাহিদদেরকে বলতে লাগলেন, রাসুলুল্লাহ
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম যদি নিহতই হয়ে থাকেন, তা হলে তাঁর আল্লাহ তো নিহত হননি। যেখানে আল্লাহর রাসুলল নিহত হয়েছে, সেখানে আপনারা বেঁচে থেকে কী করবেন? তিনি যে দ্বীনের জন্য জীবন দিয়েছেন আপনারাও সেই দ্বীনের
জন্য জিহাদ-সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন। উঠুন। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করুন। শহীদ হোন।
এই বলে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে
যেতে লাগলেন। পথে দেখা হয়ে গেলো সা’দ ইবনে মুয়াজের সাথে। সা'দ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন।
এর জবাবে তিনি উহুদের ময়দান দেখিয়ে দেন। আর বলেন আল্লাহর কসম ! আমি উহুদের ঐ
প্রান্ত থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণ পাচ্ছি। সা'দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে এই জবাব দিতে দিতেই তিনি উহুদ প্রান্তরে গিয়ে হাজির
হন। এরপর বীরবিক্রমে বাতিলের সাথে লড়াই করতে করতে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন।
রওয়ানা করেন চির সুখের মঞ্জিল জান্নাতের পানে।
এতোক্ষণ যাঁর কথা বলছিলাম তিনি
হলেন আনাস বিন নাদর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। তাঁকে খুবই নৃশংস, নির্মম আর নির্দয়ভাবেই আল্লাহর
দুশমনেরা সেদিন শহীদ করেছে যে, তাঁর সারা
শরীরের প্রায় প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিকৃত আর বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।
তাঁর সারা শরীরে সত্তর থেকে আশিটিরও বেশি আঘাত করা হয়েছে। এতোটাই ছিন্নবিন্ন আর
ঝাঁঝরা করা হয়েছে তাঁকে, কেউই তাঁর লাশটি
সনাক্ত পর্যন্ত করতে পারছিলো না। বড়ো কষ্টে তাঁর বোন রুবইয়্যা বিনতু নাদর তাঁর লাশ
সনাক্ত করেছিলেন। তাও হাতের আঙ্গুল দেখেই সনাক্ত করেছিলেন।
৩.
আল্লাহর রাসুলের সাহাবিদের
জীবনাচারণ, দ্বীনের জন্যে ত্যাগ, অক্ষমতা বা ভুলের জন্যে অনুতাপ, পারস্পরিক
ভালোবাসা-কল্যাণকামিতা কেমন ছিলো, কেমন ছিলো হৃদয়-কোণে শাহাদাতের প্রেরণা তাঁদের,
কেমন ছিলো দ্বীনের প্রতি কমিটমেন্ট; সেটার আরো একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হলো আল্লাহর
রাসুলের এই সাহাবি, তথা আনাস বিন নাদর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।
পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ
মুমিনদের বলেছেন নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই-ভাই। হাদিসেও রাসুল সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওসাল্লাম তা বলেছেন। তো সেই মুমিনদের মধ্যে, সেই ভাইদের মধ্যে পারস্পরিক
সম্পর্ক কেমন হয় বা হবে, সেটাও আল্লাহ তাঁর কালামে পাকে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ রব্বুল
আলামিন বলেন, “...তাঁরা কাফিরদের প্রতি ব্জ্রকঠিন। আর পরস্পরের প্রতি সদয়।
রহমদিল।” (সূরা আল-ফাতহ : ২৯)। এখন একজন মুমিন অন্যজনের প্রতি কীরূপ আর কেমন রহমদিল কেমন
কল্যাণকামি হবে, তার স্পষ্ট উদাহরণ হলো আনাস বিন নাদর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। জিহাদের মতো ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনেও তিনি তাঁর
নিজের ভাইদের ভুলের জন্য নিন্দাবাদ করেননি। যুদ্ধের ময়দানেও ভাইদের ভুলের জন্য
রব্বুল আলামিনের জন্য মাগফিরাত কামনা করতেন। ভাইদের জন্যে মাফ চেয়েছেন একদিকে,
অন্যদিকে কাফিরদের বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। ভাইদেরকে জিহাদে সক্রিয়
হবার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেছন, কিন্তু নিন্দা করেননি। বরঞ্চ আরো আল্লাহর কাছে
মাগফিরাত চেয়েছেন। আমরা কি এভাবে আমাদের ভাইদের ভুলের জন্যে নিন্দা না করে থাকতে
পারি? আমরা কি আমাদের অপর ভাইদের জন্যে আল্লাহর কাছে উদার হৃদয়ে ক্ষমার আবেদন করতে
পারি?
আনাস বিন নাদর রাদ্বিয়াল্লাহু
আনহুর তুলনায় উমর রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু ছিলেন মর্যদাবান আর উঁচু মানের এবং উঁচু
মাপের সাহাবি, জিহাদের ময়দানে ওনাদেরকে বিমর্ষ কিংবা সাময়িক নিষ্ক্রিয় দেখেও তিনি
তাঁর বা তাঁদের উদাহরণ দিয়ে নিজে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাননি। বরঞ্চ নিজ ঈমানের তাগিদেই সক্রিয়
ছিলেন। তিনি নিজেই স্বয়ং তাঁদেরকেই অনুপ্রেরণা দান করেছেন জিহাদের ময়দানে, দ্বীন
প্রতিষ্ঠার কাজে সক্রিয় হতে।
বদরে অংশগ্রহণ না করতে পারার
তাড়নায় তিনি স্বয়ং নিজেই গিয়ে আল্লাহর রাসুলের কাছে, নিজ নেতার কাছে গিয়ে অনুতাপ
প্রকাশ করে এসেছেন। ওয়াদাও যে দিয়ে এসেছেন ভবিষ্যতে কোনো ডাক এলে তিনি সেই ডাকে
প্রাণপণে লড়ে যাবেন। রাসুলের ডাকে, জিহাদের আহ্বাবানে সাড়া দিবেন। তিনি এক্ষেত্রেও
তাঁর কৃত প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন। শহীদ হয়ে শাহাদাতে আলান্নাস হিসেবে নিজেকে
প্রমাণ করেছেন। অথচ আমরা কিন্তু বারংবার ইচ্ছে করে আল্লাহর বিধানকে লঙ্ঘন করি,
দ্বীনের প্রয়োজনে সাড়া না দিয়ে নিজেদেরকে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে আড়াল করে রাখি। এবং
প্রত্যেকবার এর জন্যে নানাবিধ অজুহাত আর ঠুনকো যুক্তি দাঁড় করাই। কিন্তু আনাস বিন
নাদর তা কখনো করেননি। একবার শুধু জিহাদে যেতে পারেননি, এরজন্যে তিনি অনুতপ্ত হয়েছেন,
সামনে কখনো জিহাদের ডাক এলে এভাবে নিষ্ক্রিয় না থেকে সাড়া প্রধানের প্রতিশ্রুতি
দিয়েছেন। অতঃপর নিজের প্রাণটা আল্লাহ রাহে বিলিয়ে দিয়েই তাঁর দেওয়া কথার সত্যতার
প্রমাণ রেখেছেন।
তাঁরা যে দ্বীনকে ধারণ করে একটা
জীবন, একটা সমাজ, একটা রাষ্ট্র, একটা সভ্যতাকে আগাগোড়া পরিবর্তন করে ফেলেছেন, সে
দ্বীন আজোও আমাদের কাছে। আমরাও যদি তাঁদেরই মতো নির্ভিক মুজাহিদ হতে পারি। এতোসব
গুণাবলি অর্জন করতে পারি, তাহলে আমাদের জন্যও একটা সভ্যতার পাটাতন নতুনভাবে
বিনির্মাণ করা খুব বেশি কঠিন হবে না।
০৭/০৬/২২ ইং
Comments
Post a Comment