বিএনপি: মরীচিকার রাজনীতি
১. বিএনপির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট হলো— এই দলের কোনো সুসংহত আদর্শ বা মহান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। সাধারণ মানুষ আদর্শিক টান থেকে বিএনপিকে বেছে নেয় না; বরং তারা বিএনপিকে দেখে একটি বিকল্প আশ্রয়স্থল হিসেবে— আওয়ামী লীগের জুলুম থেকে বাঁচার সাময়িক ছায়া।
২. বিএনপির আরেকটা বড়ো সংকট কিংবা ব্যর্থতা হলো রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণে ব্যর্থতা। বিএনপি কখনোই নিজস্ব বয়ান বা দর্শন গঠনে সক্ষম হয়নি।
এদেশে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকার জন্য যেমন আদর্শ দরকার, তেমনি দরকার সময়োপযোগী রাজনৈতিক ভাষ্য।
এই দুই ক্ষেত্রেই বিএনপি দুর্বল, যার ফলে তারা ক্রমাগত জনগণের আস্থার বাইরে চলে যাচ্ছে।
৩. বিএনপি আদতে আওয়ামী লীগের বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই গড়ে ওঠেছিল। আজও তারা সেই ভূমিকাতেই আটকে আছে— শুধু বিরোধিতা, প্রতিস্থাপন বা প্রতিশোধের রাজনীতি। এর বাইরের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি তারা জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি।
৪. হতাশ ও বার্নআউট ইসলামপন্থী এবং বামপন্থীদের সাময়িক আশ্রয়স্থল:
প্রথমত, এক শ্রেণির ইসলামপন্থী ও বামপন্থী রয়েছেন, যারা ইসলামি আদর্শভিত্তিক (বামদের ক্ষেত্রে তাদের আদর্শভিত্তিক) রাজনীতিতে দীর্ঘদিন যুক্ত থেকেও চূড়ান্তভাবে হতাশ— যাদের আর স্বপ্ন দেখার শক্তি নেই।
সাংগঠনিক ব্যর্থতা, নেতৃত্বের সংকট, এবং কার্যত ফলশূন্যতা তাদেরকে বার্নআউট করে তুলেছে। তারা তখন আর কোনো মৌলিক রূপান্তরের স্বপ্ন দেখে না, বরং অপেক্ষাকৃত বাসযোগ্য ও নিরাপদ বিকল্প হিসেবে বিএনপির ছায়ায় এসে আশ্রয় নেয়। এরা আদর্শের ক্লান্ত যাত্রী— বিএনপি তাদের জন্য একধরনের ডিপ্রেশন স্যুট মাত্র।
দ্বিতীয়ত, এমন একটি শ্রেণিও আছে, যারা আদর্শে এখনো বিশ্বাসী, কিন্তু বাস্তবতার চাপে পর্যুদস্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়— সেটা হলো এমন, যখন ইসলামি শক্তিগুলো নিপীড়নের শিকার হয়, সাংগঠনিকভাবে পেছনে পড়ে যায়, কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়— তখন এরকম এক শ্রেণির কিছু কর্মীরাও রাজনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য সাময়িক আশ্রয় খোঁজে।
তাদের কাছে বিএনপি হয়তো শেষ আশ্রয় নয়, তবে আপাত স্বস্তির ছায়া। এরা মূলত সাময়িক আশ্রয়প্রার্থী, কোনো দীর্ঘমেয়াদি আদর্শিক সহচর নয়।
কিন্তু দুই শ্রেণির এই অবস্থানই একটি সত্য প্রতিফলিত করে—বিএনপি কারও জন্য গন্তব্য নয়, বরং ক্লান্ত পথিকদের একটুখানি ছায়া মাত্র। আবার সেই ছায়াটিও দীর্ঘস্থায়ী নয়।
৫. সুযোগসন্ধানী নেতৃত্বের ভিড়: বিএনপির রাজনীতিতে এমন এক শ্রেণির লোক ঢুকে পড়ে, যাদের লক্ষ্য শুধু ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ। তাদের অর্থ আছে, সামাজিক প্রভাব আছে, নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষাও আছে— কিন্তু কোনো আদর্শিক টান নেই বা থাকলেল ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা নেই। তারা উপযুক্ত সময়ে টাকা দিয়ে নমিনেশন কিনে নেয় এবং ক্ষমতার সুযোগ ভোগ করে। এই শ্রেণিটিও বিএনপিকে আরও আদর্শবিচ্যুত করেছে।
৬. বিএনপি একসময় মধ্য-ডানপন্থী (center-right) ধারার প্রতিনিধিত্ব করত। এখনো ইসলামি মূল্যবোধ ও রক্ষণশীল সামাজিক চিন্তার একটি সুশৃঙ্খল প্ল্যাটফর্ম হতে পারত তারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই সম্ভাবনা তারা নিজেরাই নষ্ট করেছে—অন্তঃসারশূন্যতা ও নকল ন্যারেটিভ দিয়ে নিজেদের গৌরব ধ্বংস করে যাচ্ছে।
৭. যদি ভবিষ্যতের বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন আদর্শের ভিত্তিতে ঘটে— বাম বনাম ডান, সেক্যুলার বনাম ইসলামি, প্রগতিশীল বনাম রক্ষণশীল— তাহলে বিএনপির কোনো জায়গা থাকবে না। কারণ, তারা কোনো পক্ষেই পরিপূর্ণ নয়; তারা কেবল মাঝে পড়ে থাকা একটি শূন্যতায় দুলতে থাকা প্ল্যাটফর্ম। এহেন আদর্শিক মেরুকরণের বাস্তবতায় বিএনপির অস্তিত্ব বিলীন হবেই হবে।
৮. আদর্শহীন দল কখনো টিকে থাকে না। জনগণ কোনো একসময় বুঝে ফেলে— যে ছায়ায় তারা আশ্রয় খুঁজছে, তা আসলে মরীচিকা। সুতরাং, ভবিষ্যতের রাজনীতিতে বিএনপির অস্তিত্ব হয়তো ইতিহাসের একটি ক্লান্ত পৃষ্ঠায় পরিণত হবে।
৯. অন্যদিকে অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আওয়ামী লীগ একটি আদর্শভিত্তিক দল। এই সত্য মানা না গেলেও, অস্বীকার করা কঠিন। তাদের আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা— একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের ঐতিহাসিক দাবি, এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি দৃঢ় ভাষ্য।
পাশাপাশি, তারা সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাকে তাদের আদর্শিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে তুলে ধরে, যেটা অনেকের কাছে বিতর্কিত হলেও রাজনৈতিকভাবে স্পষ্ট ও ধারাবাহিক। এই চেতনার জন্যই আওয়ামী লীগ বারবার ফিরে আসে।
ইতিহাস ঘাটলে খুবই স্পষ্টভাবে দেখতে পাবেন— একটি দল যদি তার চেতনা ও ইতিহাসকে সংগঠিতভাবে তুলে ধরতে পারে, তবে সে দল সময়ের ঘূর্ণিপাকে বারবার ফিরে আসে।
হয়তো বিরক্ত লাগবে, খারাপ লাগবে। তবুও সত্য হলো— আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও তা-ই হবে। আওয়ামী লীগ আজ বা কাল, এমনকি পঞ্চাশ বছর হলেও ফিরবে। তাদের কর্মী সমর্থকদের বড় একটি অংশ এখনো চেতনার সূত্রেই দলটিকে গ্রহণ করে।
১১. বিএনপির আদর্শহীনতা, বয়ানহীনতা এবং বিভ্রান্ত নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের জন্য বরং রাজনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করছে। আওয়ামী লীগ শুধু নিজের শক্তির কারণে নয়, প্রতিদ্বন্দ্বীর দুর্বলতার কারণেও টিকে গিয়েছে এবং অনেক সময় আরও শক্তিশালী হয়েই ফিরে এসেছে। বর্তমানে বিএনপির দুর্বলতাই আওয়ামী লীগের শক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সর্বসাকুল্যে কথা হলো— বাংলাদেশের রাজনীতি যখন এক মোড়বদলের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ছিল, যখন দারুণ সম্ভাবনা ছিল, বাংলাদেশকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার, শক্তিশালী আদর্শিক চেতনা দিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে গঠন করার, সেখানে আমাদের সব স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে বিএনপি।
এর মাধ্যমে মূলত বিএনপিও দিন দিন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে এবং পড়বে। এই অপ্রাসঙ্গিকতা যদিও এখন বুঝতে পারবে না তারা, কিন্তু সামনে এটা কোনো না কোনো সময় সবাই বুঝবে। যেখানে রাজনৈতিক ময়দানে টিকে থাকার প্রধান শর্ত হয়ে ওঠছে শক্তিশালী আদর্শ ও নিজস্ব বয়ান, সেখানে বিএনপি স্রেফ আওয়ামীদের বয়ান কপি-পেস্ট করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ তাদের ইতিহাস ও ন্যারেটিভকে—সঠিক-ভুল মিলিয়ে জনগণের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে (সব সময়ই সক্ষম ছিল)।
এই বাস্তবতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আওয়ামী রাজনীতিরই পুনর্জাগরণ ঘটবে— আর বিএনপি পরিণত হবে এককালীন বিকল্পের স্মৃতিমাত্র।
~রেদওয়ান রাওয়াহা
১৫.০৭.২৫
Comments
Post a Comment