আমরা কাদের সঙ্গী হব

 




কিছুদিন আগে একটা নিউজ চোখের সামনে পড়ল। পাকিস্তানের এক মডেল নিজের অ্যাপার্টমেন্টে মারা গেছে, কিন্তু বহুদিন যাবৎ তার লাশটা ওখানেই পড়ে ছিল। প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে তার মৃতদেহ সেখানে। এরপর আস্তে আস্তে বের হলো আরো চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। একমাস না, দীর্ঘ আট মাসেরও বেশি সময় ধরে লাশটা সেই অ্যাপার্টমেন্টেই পড়ে আছে। ভিডিও বের হলো। লাশের অবস্থা এত ভয়ানক যে তাকানো যাচ্ছে না। চারিদিকে ঘিরে আছে পোকামাকড়ের দল। গন্ধ ছুটছে। হাত-পায়ের মাংস খসে পড়ছে। পচেগলে চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে। বীভৎস দৃশ্য।

 

এই ঘটনাটা আমার মনস্তত্ত্বে খুব নাড়া দিল। ভাবছিলাম, জীবিত থাকতে এই নারী কতই না সুন্দরী ছিল। তার অজস্র ছবি নেট জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছিপছিপে গঠন, নিত্যনতুন পোশাক, সুন্দর সুন্দর পোজ দেয়া ছবি। রূপবতী এক নারী ছিল সে। মডেলিং জগতে নিশ্চয়ই যাকে-তাকে নেয়া হয় না।


কিন্তু কতটা লোনলি ছিল তার জীবন চিন্তা করা যায়? দীর্ঘ আট মাস কেউ তার কোনো খোঁজও করে নি। হয়তো খোঁজ করলেও এতটা ক্লোজ কেউ ছিল না, যারা তার জন্য দুশ্চিন্তা করবে। কেউ ভাবে নি, মেয়েটা এতদিন সোশ্যাল মিডিয়াতে চুপ হয়ে কেন আছে? কেউ একবারের জন্য তার সাথে দেখা করতে আসে নি। কেউ বলতে আসে নি, তুই কোথায়? তোকে ছাড়া ঈদ কীভাবে হবে? জলদি বাড়ি আয়। 


পুরো পৃথিবীতে তার ঘনিষ্ট একটা মানুষও ছিল না, যার জন্য সে খুব "বিশেষ" কেউ ছিল। এমন কেউ ছিল না, যে তার অনুপস্থিতি টের পাবে। এমন একটা মানুষও ছিল না, যে তার সাথে যোগাযোগ করতে না পারলে অস্থির হয়ে যাবে, চোখের পাতা এক করতে পারবে না। 


এই মডেল কন্যা পৃথিবীতে থাকতে ছুটেছে রূপের পিছে, সৌন্দর্য্যের পিছে, সফলতার পিছে। তার ছিল হাজারো ফ্যান-ফলোয়ার, অথচ তার পরিণতিটা কত করুণ, কত শোচনীয়, চিন্তা করা যায়?


এই মডেল নারীর মৃত্যু এক অমোঘ বাস্তবতাকে আমাদের সামনে নিয়ে এলো। যারা এত সফল, তাদের জীবনেও কত একাকিত্ব, কত শূন্যতা। তাদের হাজারো ফ্যান-ফলোয়ার মৃত্যুর সময় কোনো কাজেই লাগল না। তার একাকী জীবনের সঙ্গ দেয়ার মতো, তাকে সাহায্য করার মতো কেউ এগিয়ে এলো না। তারকাদের নাম আর যশের স্থায়িত্ব ঠিক ততটুকু সময়ের জন্য, যতক্ষণ সে তার দর্শকদের মুগ্ধ রাখতে পারবে। 


ভেবে দেখলাম, এমন কত নায়ক-নায়িকা আছে, যারা তাদের সময়ে সেরা ছিল। তবুও আজ তাদেরকে ঠিক কতবার স্মরণ করা হয়? কতজন তাদেরকে 'মিস' করে? কতজন তাদের "অভাব" অনুভব করে? আসলে, এমন একজন তারকাও নেই। পুরোনোরা চলে যায়, মানুষ মেতে ওঠে নতুন মুখদের নিয়ে। তাদের নিত্যনতুন কাজ নিয়ে। সময়ের আলোচিত অভীনেত্রী, খ্যাতনামা গায়ক, নামকরা মডেলদের নিয়ে। বর্তমানের সামনে অতীতের সবাই ম্লান হয়ে যায়। তাদেরকে বড়জোর স্মরণ করা হয় তাদের জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীকে। ফাঁকা বুলিতে বলা হয়, অমুক বড় অভিনেতা ছিল। ব্যস। দায়সারা গোছের কথাবার্তা বলে সারাবছরের জন্য তার চ্যাপ্টার ক্লোজ।


যে নারীর কথা বললাম, তাকেও লোকে ভুলে যাবে খুব দ্রুত। সবাইকেই ভুলে যায়। এই সব দর্শক, ফ্যান, ফলোয়ার, ভক্তদের দল -- যাদেরকে "মুগ্ধ" করে রাখতে এত আয়োজন করা হয়, তারা কেউই সারাজীবন কোনো সেলেব্রিটিকে মনে রাখে না। 


আরও সুন্দর, আরো নজরকাড়া কারো প্রতি বুঁদ হয়ে যায়। 


অস্থির একটা সময়ে আমরা বাস করছি। এখানে সবকিছুর স্থায়িত্ব রীলসের মতোই সংক্ষিপ্ত। এ আই টেকনোলজির মতোই ফেইক। 


আমরা এখন কারো রূপ দেখলেই মুগ্ধ হয়ে যাই। যে কোনো উপায়ে তাকে সাপোর্ট করা শুরু করি। তার চরিত্র যত খারাপই হোক না কেন, আমরা তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি। সে যত অনৈতিক কাজই করুক না কেন, তাকে আমাদের রোলমডেল বানিয়ে ফেলি। তার অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, যৌনউদ্দীপক সাজ, খোলামেলা শরীরের প্রদর্শনী দেখেও আমাদের পছন্দে কোনো হেরফের আসে না। অন্ধের মতো এই সুন্দরীদের ফলো করতে থাকি সবাই, যতদিন না তার চাইতেও বেশি সুন্দরী, স্মার্ট আর সাকসেসফুল কাউকে খুঁজে পাই। এরপর আগেরজনকে রেখে নতুন করে তাকে ফলো করা শুরু করি। তাদের মতো হেয়ারস্টাইল করতে চাই। তাদের মতো পোশাক পরতে চাই। তাদের মতো শো-অফ করতে চাই। 


এই চক্রের শেষ কোথায়? 

 

যে নারী বহু পুরুষের সাথে প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক রেখেছে, এমন অশ্লীল বেপরোয়া "তারকা"-ও এখন সামহাউ মানুষের কাছে 'আইডল' হয়ে যায়। যে নারী নিজের স্বামী-সন্তান ফেলে আরেক পুরুষের সাথে ঘর বেঁধেছে, সেও শয়ে শয়ে লাইক-কমেন্ট পায়, কারণ সে অনেকের নজরেই খুব "সুন্দরী"। যে নারী অন্যের সংসার ভেঙে বিবাহিত পুরুষকে বাগিয়ে নিয়েছে, সেও লোকের বাহবা কুড়ায়। এরকম হাজারো নায়িকা, গায়িকা, মডেল, উঠতি ভ্লগার, সেলেব্রিটি আমাদের চোখে আইডল, আইকন, রোলমডেল। রোজ রোজ লোকে তাদের অবৈধ প্রেমের গল্প শোনে। স্বামীর সাথে তাদের একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি দেখে কোনোরকম অরুচি ছাড়াই। শরীরের নির্লজ্জ প্রদর্শনী দেখেও কেউ লজ্জা পায় না। হা করে তাকিয়ে দেখে। নিজেরাও একটু একটু করে নির্লজ্জতার দীক্ষা নেয়। 


এ যেন শয়তানের খেলা। 


খারাপের জয়জয়কার। 


নোংরামির জমজমাট আসর। 

 

কেন?


এত ঠুনকো কেন হয়ে যাচ্ছে আমাদের পছন্দ-অপছন্দগুলো?

 

একদিকে নারীরা দামী দামী পোশাক, ব্যাগ, প্রসাধনী ব্যবহার করে এডিট করা ফটো তুলে আমাদের দেখাবে। আর আমরাও তার চারিত্রিক দিকটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তার রূপ-যৌবনে বুঁদ হয়ে উঠব? মানুষের চরিত্রের কি কোনো দামই নেই তাহলে? যে যত দেখাতে পারবে, নিজেকে যত বেশি জাহির করবে, নাচ-গান-অভিনয় দিয়ে তাক লাগিয়ে দিবে তার জন্যই আমরা সব ভুলে লাফাতে থাকব?


মানুষকে আল্লাহ তা'আলা বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন কি এতটা নির্বোধের মতো আচরণ করার জন্য? 


মৃত্যুর সময়টা এরা কেউ কারো জন্য থাকবে না। 

এত যশ-খ্যাতি কোনো কাজে আসবে না।

কেউ কারো গুনাহর ভার বহন করবে না। 


এরা একজন আরেকজনকে খারাপির দিকে উসকে দেয়, নোংরামি আর নির্লজ্জতার দিকে আহবান করে। এরা একজন আরেকজনের গুনাহের ভার বাড়ায়। সেলেব্রিটিরা তাদের অবাধ যৌনতা, অশ্লীলতা সুন্দর করে সাজিয়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। আর ভক্তরাও হাততালি দিয়ে দিয়ে সেলেবদেরকে আরো নির্লজ্জতার প্রতি উৎসাহিত করে তোলে। 


এজন্যই আমরা দেখি, ৪০-৫০ বছরের শিল্পীরাও এখনো বিয়ে না করে ভক্তদের উত্তপ্ত করতে ব্যস্ত। বিভিন্ন সার্জারি, আর ইনজেকশন নিয়ে হলেও তারা তাদের যৌবনকে যতদিন সম্ভব ধরে রাখতে চায়। তারাও বোঝে, মুটিয়ে গেলে, বুড়িয়ে গেলে এসব ভক্তদের আর হাতে রাখা যাবে না। কিছুদিন আগেই এমন এক "জনপ্রিয়" মডেলের মৃত্যু হয়, যে কিনা নিজের যৌবন মেন্টেইন করার জন্য নিয়মিত ইনজেকশন নিতো, সেটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। সেলেব জগতে টিকে থাকার জন্য কত ঝুঁকি নেয় এরা। ডিপ্রেশনে ভুগবে, একাকিত্বে মরে যাবে, নিজের শারীরিক সুস্থতার তোয়াক্কা না জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে, কিন্তু "তারকা" সেজে ভক্তদের "হাতে" রাখা চাই।


আর আমরা যারা ভক্তদের দল। আমরা তাদের মতো হয়ে ওঠার জন্য প্রতিযোগিতা করতে থাকি। আমরা বুঝি না এই জগতটা কত অন্ধকার। আমরা টের পাই না এই সেলেব্রিটিদের পাল্লায় পড়ে আমরা কী হারাচ্ছি।  


কিছুদিন আগেই যে মেয়েটা আদালতের কাঠগড়ায় নিজের বাবা-মাকে দাঁড় করালো, তার মুখেও একই কথা। সে বিশাল বড় সেলিব্রিটি হতে চায়। আমরা সবাই একদিন তাকে নাচতে আর গাইতে দেখব। এটাই তার ড্রিম।


একটা সমাজ কত উচ্ছন্নে গেলে "তারকা" হওয়াটা ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েদের "স্বপ্নে" পরিণত হয়? 

 

শোচনীয় অবস্থা! 


যে তারকা তারও, যে ভক্ত তারও।


আখিরাতে মানুষ তার সাথেই অবস্থান করবে, যাকে সে দুনিয়ার জীবনে ভালোবাসতো। আপনার কি মনে হয়, এইসব মডেল, সেলেব্রিটি নরনারীরা জান্নাতের পাখি হবে? নাকি জাহান্নামের জ্বালানি? আর যারা নিজেদের জান-মাল চলে যাওয়ার পরেও আল্লাহকে ভুলে যায় নি? ফি-লি--স--তিনের একটা অনাথ শিশুও কি এরচেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ, মমতা আর মুগ্ধতা পাওয়ার যোগ্য নয়? যে চোখের সামনে বাবা-মা, ভাইবোনের লাশ দেখেও মুখে বলে "আলহামদুলিল্লাহ"। যে ভাঙা হাত-পা নিয়েও নামাজ পড়ে। যে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে থেকেও কুরআনের তিলাওয়াত করে। 


কেন এরা আমাদের রোলমডেল হতে পারে না? 

 

আমি দুয়া করি, আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এইসব অপরিচিত ভাইবোনদের সাথে আখিরাতে 

এক কাতারে রাখুক। এই মানুষগুলো দুনিয়াতে যশ-খ্যাতি, ধনসম্পদ পায় নি, কিন্তু আখিরাতে এরাই হবে হিরো। আর আজ যারা তারকা, সেলিব্রিটি, তারা নিজেরা তো জাহান্নামে যাবার পথে হাঁটছেই। ভক্তদেরও সাথে টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। 

 

কোন পথের পথিক আমরা হতে চাই, ভাবার সময় কি এখনও আসেনি?


~লিখেছেন: আনিকা তুবা

Comments

Popular posts from this blog

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ

গণতন্ত্র, শত্রুতা ও পারস্পরিক বিরোধিতা