" জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির ও ছাত্রীসংস্থার সিলেবাস এবং কিছু কথা "



এলোমেলো আর অগোছালো অনেক বেশি বই পড়ার চেয়ে টপিক ধরে ধরে সিলেবাস ভিত্তিক পড়াশোনা করা অনেক বেশি ভালো এবং উত্তম। এমন করেই জামায়াত, শিবির এবং ছাত্রী সংস্থার সিলেবাস সাজানো রয়েছে। 


আমার জানামতে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামি ছাত্রশিবির এবং ইসলামি ছাত্রীসংস্থার সিলেবাস অনেক সুন্দর এবং সমৃদ্ধ। কেউ সেসব সংগঠন না করেও তাদের সিলেবাস ফলো করে পড়াশোনা করলে ব্যক্তি হিসেবে মানুষটি যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হবে ইন শা আল্লাহ! 


দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সকল ইসলামি ও অনৈসলামিক সংগঠনসমূহের পড়াশোনা-সিলেবাস নিয়ে ঘাটাঘাটি এবং স্টাডি করেছি। এবং সে হিসেবে আমার কাছে এটা মনে হয়েছে। এবং আমার কাছে মনে হয়েছে ইসলামি ছাত্র শিবিরের মতো এতো সুন্দর আর গঠনমূলক ভারসাম্যপূর্ণ সিলেবাস অন্য কোনো সংগঠনেরই নেই। 


কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে শিবিরের ভাইয়েরা পড়াশোনা করাটা এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছে মনে হয়। এবং ওনারা  নিজেদের সিলেবাসটাই মনে হয় ঠিক মতো পড়েন না। যারা টুকটাক পড়াশোনা করেন, তাঁরা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে না। আবার অনেকে অন্যদিকে দৌঁড়ায়। ভাইরাল সেলিব্রিটিদের পেছনে পড়ে থাকে। নিজেদেরকে নিজেরা চেনা ভুলে গেলে যা হয় আরকি।


এসবের কারণ কী? কারণ হচ্ছে, বড়ো একটা অংশ পরিকল্পিত অধ্যয়ন ছেড়ে দেওয়া।  নিজেদেরকে নিয়ে হীনমন্যতায় আক্রান্ত হওয়া। রাত-বিরেতে অযথা আর অপ্রয়োজনীয় ঘোরাঘুরি করা। বই নিয়ে না ঘুরে হরদম মোটরসাইকেল নিয়ে অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরা ও নেতা নেতা ভাব নিয়ে চলাচল করা। এটা যে সবাই করেন, এমন না। একটা অংশ। আবার আরেকটা অংশ আছে, যারা পড়াশোনা করেন বা করতে চান, তবে তাঁরা বুঝতে চান না যে (শিবিরের) সিলেবাসটা আসলে কী? তাঁরা কিছু চটকদার শব্দচয়ন, আরবি-ইংরেজি মিশ্রিত কিছু চমকপ্রদ পরিভাষা, কিংবা তাত্ত্বিক আলোচনা—যেগুলো অনেকাংশই ইমাম মওদূদীরই কথাবার্থা বা তাঁরই চিন্তা অথবা তাঁর সমচিন্তার ওলামাদের চিন্তার প্রতিফলন— দেখে মোহগ্রস্ত হয়ে যায়। এরপর তাদের অন্যান্য নীতি-আদর্শের প্রতিও অনুরক্ত হয়ে সেসবকে ধারণ করতে চায়। কেউ কেউ আবার ইসলামি জ্ঞান খুঁজতে যায় তুর্কী মডারেট মৌলভী কিংবা পশ্চিমা সুইট শাইখদের কাছে। এরপর পশ্চিমা মিষ্টি মৌলভীদের থেকে পশ্চিমা ধাঁচের (ইসলাম-ওয়েস্টার্ন মিশ্রিত দ্বীন) মডার্ন কথাবার্তা, লেখাজোঁকা বা প্রবন্ধ-নিবন্ধ-ফতোয়া পড়ে নিজেদেরকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। স্থানীয় ওলামাদেরকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এড়িয়ে চলে। নিজেদের ওয়েস্টার্ন শাইখদের চিন্তাভাবনার আলোকে গড়ে তুলতে চায়।

আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশের এমন কোনো অনলাইন-অফলাইন সেলিব্রিটি ও লেখক নেই— যাঁরা শিবিরের সিলেবাসের চেয়ে উন্নত কিছু দিতে পেরেছে বা পারবে। ব্যক্তি পর্যায়েও যদি ধরি— তাহলে দেখবো যে, ওয়েস্টার্ন যেকোনো শাইখদের চাইতেও এদেশের সাধারণ শিক্ষিত সাবেক আমীরে জামায়াত প্রফেসর গোলাম আজম কিংবা প্রফেসর মফিজুর রহমানদের ঈমান-আমল অনেক বেশি বিশুদ্ধ, ইলম অনেক বেশি মজবুত। দ্বীনের বুঝ অনেক বেশি ভালো।  তাহলে শিবিরের বা সংস্থার বোনেদের হীনমন্যতার কারণ কী?

যদি ভালো করে আপনি নিজেদের সিলেবাস অধ্যয়ন করতে পারেন, তাহলে অন্যদের ফাঁকফোকর ধরে ফেলতে পারবেন। কিন্তু আপনি যদি তা ঠিকমতো অধ্যয়ন না করেন, তাহলে আপনাকে যে কেউ বিভ্রান্ত করে ফেলবে। আপনার চিন্তার মধ্যে ভেজালের মিশ্রণ ঘটিয়ে দেবে। আপনার মগজের ভাঁজে ভাঁজে বিশৃঙ্ক্ষলা ছড়িয়ে দেবে। উসুল-মাকাসিদ ও হাদিসের মেথোডোলজির নামে আপনার বা আপনাদের মাধ্যমে সব কিছুই জায়েজ করে নেবে— যেগুলো মওদূদী-আব্দুর রহিম-গোলাম-নিজামী-সাঈদীরা জায়েজ মনে করতেন না, কিংবা ভালো চোখে দেখতেন না ! সুতরাং আপনারা দায়িত্বশীল আলিমদের সোহবতে থাকুন, আগে সিলেবাস ভালোভাবে অধ্যয়ন করুন।


আমি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছি— কী নেই এই শিবিরের সিলেবাসে? তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব,  আকিদা, ইবাদাত, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, পাশ্চাত্যবাদ, মহৎ মানবদের জীবনী, রাসুল (সঃ) ও সাহাবাদের সীরাত, উলুমুল কুরআন, উলুমুল হাদিস, তাফসীর, ফিক্বহ, জি.হাদ, তুলনামূলক সাহিত্য, বিভিন্ন মতবাদ। এবং কিশোরদের জন্য তাদের উপযোগী করে নবিদের-সাহাবিদের ও মনীষীদের গল্প-কবিতা- নাটিকা; এক কথায় সব!! অন্যরা আপনাদেরকে আজকে যেসব মুখরোচক কথা গেলাচ্ছে, এসব আরো বহুকাল পূর্ব থেকেই আপনাদের সাংগঠনিক সিলেবাসে আছে। এবং সেসবের চাইতে বহু উন্নত মানের চিন্তা-সমৃদ্ধ সাহিত্য-সিলেবাস রয়েছে আপনাদের। 

আমি ইসলামি ছাত্রশিবিরের ভাইদের খুব বিনয়ের সাথেই অনুরোধ করবো, নিজেদের শক্তিশালী সাহিত্য সম্পর্কে উদাসীনতা পরিহার করুন। সিলেবাসের সবগুলো বই খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ুন। আপনাদের সিলেবাস-আপনাদের সাহিত্য খুবই মজবুত। জাতির চিন্তা জগতের ভিত্তি নাড়িয়ে দেওয়ার মতো ! প্রতিষ্ঠিত জাহিলি-সমাজ ব্যবস্থাকে সমূলে উপড়ে ফেলার মতো। ধ্বংসের দুয়ারে পড়ে থাকা মগজকে সত্য আর শুদ্ধতার সাগরে ভাসিয়ে দিতে পারে শুধু এই সিলেবাসের বইপত্রগুলোই।

বুঝেশুনে সিলেবাসের বইগুলো অধ্যয়ন করতে পারলে আপনি নিজেকে নিজে চিনতে পারবেন। জাতিকে পরিবর্তনে আরো উঁচু মানের নেতৃত্ব দিতে পারবেন। আপনাকে কেউ চাইলেও বিপথগামী কিংবা পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। আপনার সাথে কথা হিসেব-নিকেশ করেই কথা বলবে। তবে হ্যাঁ, অসৎ-অহংকারী, প্রতিহিংসাপরায়ণ লোকদের কথা আলাদা। তারা মর্যদাবানদের মর্যদা কখনোই দেয় না। জ্ঞানীদের মূল্যায়ন করতে পারে না। এটা তাদের ব্যর্থতা। অহংকারী ইবলিশের সোহবতই তাদের ভেতর বিনয়ের মতো মহৎগুণাবলি সৃষ্টি করতে পারেনি।


যাই হোক, আপনি যদি খুব সুন্দর করে বুঝেশুনে মনোযোগী হয়ে সিলেবাসের বইগুলো অধ্যয়ন করতে পারেন, তাহলে মোটামুটি ভালো মানের একজন স্কলার হিসেবে গড়ে উঠতে পারবেন আপনি। ইন শা আল্লাহ! 


ছাত্রশিবির এবং ছাত্রীসংস্থা ভাই-বোনদের বলবো, আমি আপনাদের কষ্ট দিতে এসব বলিনি। জাস্ট আপনাদেরকে সজাগ করতে বলেছি। সচেতন হতে বলছি। অন্যদের দ্বারা আপনারা খুব বেশিই প্রভাবিত হয়ে পড়েন। এটা উচিৎ না। আপনারাই তো বরং অন্যদেরকে প্রভাবিত করবেন।

শেষ পর্যায়ে সাধারণভাবে একটা সাজেশন আছে সবার জন্যে। আর সেটা হচ্ছে, সবাই তো আর জামায়াতে ইসলামী বা ছাত্রশিবির করবে না। কিন্তু জামায়াত-শিবির কী পড়ায়, তাদের সিলেবাস কেমন—তা তো জানা-ই যায়, তাই না? ছাত্রশিবির তাদের প্রায় অধিকাংশ বই এবং সিলেবাস অনলাইনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তাদের হয়তো-বা শক্তিশালী আইটি টীমও রয়েছে, যাঁরা খুব নিখুঁতভাবে নিজেদের সিলেবাসের বইপত্রগুলো অনলাইনে আপলোড করে রেখেছে, এবং এখনো নিয়মিত করে যাচ্ছে। তাদের সমৃদ্ধ অনলাইন লাইব্রেরিও রয়েছে। যাঁরা নিরপেক্ষ মন-মগজে শিবিরকে জানতে চান, কিংবা দলীয় গণ্ডির বাইরে থেকেও ইসলাম সম্পর্কে জানাশোনার লেভেলকে বাড়াতে চান, তারা অনলাইন থেকে ক্যাটাগরিভিত্তিক বা টপিক ধরে ধরে পড়তে পারেন, জানতে পারেন। হতে পারেন উপকৃত। নিম্নে শিবিরের এবং জামায়াতের অনলাইন লাইব্রেরির লিংক দেয়া হলো। ঘুরে দেখতে পারেন।

[১. শিবিরের অনলাইন লাইব্রেরির লিংক- https://www.icsbook.info/ // 

২. জামায়াতের অনলাইন লাইব্রেরির লিংক- https://www.bjilibrary.com/]




~রেদওয়ান রাওয়াহা

Comments

Popular posts from this blog

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ

‘বিয়ে ও ডিমান্ড’