বাইআত নিয়ে বিভ্রান্তি

 






লেখাটির পেছনের গল্প

বাইআত ও জামায়াত নিয়ে আমার একটা লেখা গত বছর মাসিক ছাত্র সংবাদের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। লেখাটির উদ্দেশ্য ছিল বাইআত ও জামায়াত নিয়ে বিভ্রান্তির সমাধান হাজির করা এবং বিষয়গুলো ক্লিয়ার করা। আলহামদুলিল্লাহ, আমার লেখাটি বেশ সমাদৃতও হয়। তবে আমার কাছে মনে হলো সে লেখায় জামায়াত বিষয় কাভার করতে পারলেও বাইআতটা সেভাবে হয়নি। যাই হোক, সে লেখাটি পড়ে তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল, বর্তমান কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহতারাম মঞ্জুরুল ইসলাম ভাই আমাকে কল দেন এবং বাইআত নিয়ে আরেকটু সুন্দর করে গুছিয়ে একটা লেখা তৈরি করতে ও নোট দিতে বলেন।

তখন সবিস্তারে লিখতে না পারলেও ভাইকে খুবই অল্প সময়ে অনেক ছোটো একটা নোট দিই। এরপর এ বছরের ১৩-ই অক্টোবর একটা ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এর সুপ্রিয় তরুণ ভাইয়েরা বাইআত ও জামায়াতের ওপর একটা সেশন আয়োজন করে। আর উক্ত সেশনটা আমাকেই নিতে হয়। সে উপলক্ষ্যে আগে-পরে যা পড়েছি ও পড়ে নোট করেছি, সেগুলোই পরিপূর্ণভাবে ছাত্র সংবাদের পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম। আশা করি আগের লেখার সাথে মিলিয়ে পড়লে সম্মানিত পাঠকবৃন্দ উপকৃত  হবেন, ইন শা আল্লাহ।


বাইআত কি শুধু খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধানের হাতেই হতে হবে?

বাইআত নিয়ে সহিহ বুখারি ও মুসলিমে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেকগুলো হাদিসই আছে। যেগুলো বিশুদ্ধতার মানোত্তীর্ণ। মূলত ইসলামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা যখন পরিপূর্ণতায় পৌঁছে দিলেন, সমাজ-রাষ্ট্রের সব ব্যবস্থাতেই দীনকে যখন বিজয়ী করে দিলেন, যখন খিলাফত প্রতিষ্ঠা হলো, মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র তৈরি হলো, তখন সব মুসলিমের জন্য আবশ্যক হয়ে গেলো রাষ্ট্রপ্রধান বা খলিফার হাতে বাইআত নেওয়া। খিলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকাবস্থায় খলিফার হাতেই বাইআত নিতে হবে। এটাই হচ্ছে শুদ্ধ কথা। এমনকী মুসলমানদের একজন আমীর বা খলিফা থাকাবস্থায় অন্য কেউ বাইআতের দাবি করলে তাকে কতল (হত্যা) করার নির্দেশও হাদিস থেকে পাওয়া যায়। যেমন সহিহ মুসলিমে আবূ সাঈদ খুদরি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিস আছে, যেখান বলা হয়েছে—

إِذَا بُويِعَ لِخَلِيفَتَيْنِ فَاقْتُلُوا الآخَرَ مِنْهُمَا

“যদি দুজন খলিফার জন্য বইআত গ্রহণ করা হয় তবে তাদের শেষোক্ত ব্যক্তিকে হত্যা করবে।” (সহিহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ৪৬৪৬)। এছাড়াও অন্য আরেকটি হাদিসে আছে, এরকমই। মানে মুসলমানদের জন্যে একজন আমীর বা খলিফা থাকার পরেও কেউ যদি এসে তাঁর সাথে ক্ষমতার লোভে ক্ষমতা লাভের জন্যে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়, তবে রাসূলের সা. নির্দেশ হচ্ছে পরবর্তী জনের গর্দান তলোয়ার দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া। (মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ৪৬২৪)। এভাবে আরো কিছু হাদিস আছে।

এই যে খলিফার হাতে বাইআত নেওয়ার বিষয়টি, তা যে সকল মুসলিমের জন্যেই ফরজ, এটুকু নিয়ে দ্বিমত নেই। বাকি কথাটা হচ্ছে যখন খিলাফত থাকবে না, তখন কি বাইআত নেই? একটা গোষ্ঠীর বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণায় আন্দোলনমুখী ও মধ্যপন্থী অনেক আলিমগণও মতামত দেওয়া শুরু করেছে যে, খেলাফত ও খলিফা ছাড়া ইসলামে কোনো বাইআত নেই। কিন্তু বিষয়টা কি আসলেই তাই? চলুন, আমরা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জিন্দেগিতে ঘুরে আসি।

আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যখন দীন নিয়ে মানুষের কাছে আসলেন। তখন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে বাইআত গ্রহণ করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. কাছে মানুষ কীসের ওপর বাইআত নিতেন? অনেকগুলো বিষয়ের ওপরই বাইআত নিতেন।একেকজনকে বা একেক গ্রুপকে একেকটা বিষয় নিয়ে নবী সা. বাইয়াত দিতেন। 

• কখনো আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন না করার বাইআত, 

• কখনো পিতামাতার আনুগত্য আর খিদমত করার বাইআত, 

• কখনো ব্যভিচার না করার বাইআত। 

এভাবে শিরক না করার, অন্য মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণ কামনার, কখনো কখনো দীনি ভাইয়ের রক্তের বদলা নেওয়ার বাইআত এবং জিহাদের বাইআত, ইত্যাদি। তবে সব বাইআতের মূল ভাব হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য। রাসূলের অনুসরণ। নিজের নফসের গোলামি ও তাগুতকে বর্জন। (বিস্তারিত দেখুন, হায়াতুস সাহাবা ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৯৯-৪২৩)।


খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার পূর্বে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাইআত

এবার আমরা মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্ববর্তী সময়ের দিকে খেয়াল করি। দেখুন, বাইআতে আকাবা তথা আকাবার শপথ কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের হাতে বাইআত ছিল না। তখন তো মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র বা খিলাফতই কায়িম হয়নি। তবুও তারা দুই-তিন ধাপে বাইআত নিয়েছেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও দিয়েছেন। এখন কথা হলো, তখন যেহেতু ইসলামি খিলাফাহ কায়েমই হয়নি, তাহলে তাঁরা দুই-তিন ধাপে কীসের ভিত্তিতে বাইআত নিয়েছেন? যদি রাষ্ট্র ছাড়া বাইআত না-ই থাকে, তাহলে রাসূলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন বাইআত দিলেন? আসহাবে রাসূলও-বা কেন নিলেন?

 চলুন, আমরা এখন একটু দেখে আসি বাইআতে আকাবায় কী কী বিষয়ের ওপর আসহাবে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইআত নিয়েছেন, আর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও-বা কী কী বিষয়ের ও বাইআত দিয়েছেন।

বাইআতে আকাবা: রাসূল (ﷺ) নবুওয়তের একাদশ বছরে হজ্জের মৌসুমে মিনার ‘আকাবায়’ মদিনার খাজরাজ গোত্রের ছয়জন লোকের সাথে মিলিত হলেন। আমরা আগের লেখাতেও উল্লেখ করেছি যে, মদিনা তথা ইয়াসরিবে তখন আউস এবং খাজরাজ এই দুই আরব গোত্রের মধ্যে প্রায়শই লড়াই লেগেই থাকতো। বছরের পর বছর অব্যাহত লড়াইয়ে তারা সব হারিয়ে একদিকে নিঃশেষ  হয়ে গেছে অন্যদিকে অবসাদও হয়ে পড়েছিল। তারা এই বোঝা আর বহন করতে চাচ্ছিলো না। অবসাদ থেকে তারা একটুখানি অবসর চাচ্ছিল। ফলশ্রুতিতে নিজেদের মধ্যকার এই লড়াই সমাপ্ত করতে একজন সর্বজন মান্য নেতা ও মধ্যস্থতাকারীর খুঁজছিল।

মদিনায় তখন আউস এবং খাজরাজ গোত্র ছাড়াও কিছু ইহুদি গোত্র বসবাস করতো। গোত্রগুলো হলো যথাক্রমে বনু কুরাইজা, বনু কায়নুকা ও বনু নাজির। মূলত এই ইহুদিরাই তাদের মধ্যে দন্দ্ব-সংঘাতে উস্কে দিত। যেটা ওই প্রবন্ধেও উল্লেখ করেছি।

যাই হোক, ইয়াহুদিরা যেহেতু আসমানি কিতাবধারী, তাই তাদের কাছ থেকেই আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা সবসময়ই একজন নবীর —শেষ নবীর— আগমনের কথা শুনতে পেত। এর মধ্যে তারা মক্কায় রাসূল সা.-এর নবুওয়াতের কথা শুনতে পেলো। তখন তারা নবুওয়তের একাদশ বছরে হজ্জের মৌসুমে মদিনায় এলে রাসূল (ﷺ) মিনার ‘আকাবায়’ তাদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হলেন। রসূল সা. এর সাথে তাদের বিস্তারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি তাদেরকে ইসলামের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলেন। তাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিলেন। নবী করিম সা.-এর দাওয়াত শোনার পর তারা পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলো, “তোমরা নিশ্চিত জেনে রেখো, এই ব্যক্তিই সেই নবী, যার কথা ইহুদিরা তোমাদের কাছে বলে আসছে। এখন ইহুদিরা যেন আমাদের আগে এই নবীর সহযোগী হয়ে যেতে না পারে।” (বই: মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম, পৃষ্ঠা-১৯০)।

 এরপর তারা বলতে থাকে: “আমরা আমাদের জনগনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। আমাদের মধ্যে যতো শত্রুতা ও কলহ-বিবাদ ও কোন্দল বিদ্যমান রয়েছে, তা বোধহয় আর কোনো জাতিতে নেই। হতে পারে রাসূলের সা. মাধ্যমে আমাদের জাতিকে আল্লাহ আবার ঐক্যবদ্ধ করবেন। আমরা তাদের কাছে ফিরে যাওয়ার পর রসূল সা.-এর দীনের প্রতি তাদেরকে দাওয়াত দেবো এবং আমরা তাঁর সামনে এই দীনের ব্যাপারে যে মনোভাব ব্যক্ত করেছি, তাদের সামনেও সেই মনোভাব ব্যক্ত করবো। তারপর আল্লাহ যদি তাদেরকে এই দীনের ব্যাপারে একমত করে দেন, তাহলে এরপর থেকে ইনিই হবেন সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি।”

আল্লাহর রাসূলের সাথে বৈঠক করে ইসলামের ব্যাপারে কনভিন্স হওয়া সেই ছয়জন সৌভাগ্যবান হচ্ছেন আসাদ বিন জরারা, জাবির বিন আব্দুল্লাহ, আওফ বিন হারিছ, রাফে বিন মালিক, কুতবা বিন আমের এবং উকবা বিন আমের।

উক্ত ছয়জন আল্লাহর রাসূলের দাওয়াত কবুল করে মদিনায় ফেরত গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। মদিনার ঘরে ঘরে শাশ্বত দীনের আহ্বান ছড়িয়ে পড়লো। পরের বছর মদিনা থেকে ১২ জন লোক আসলো। জাবির বিন আব্দুল্লাহ রা. ব্যতীত আগের বছরের সকলেই এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে হাত রেখে বাইআত গ্রহণ করলেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের কাছে যেসব বিষয়ের ওপর বাইআত গ্রহণ করেন, সেগুলো হচ্ছে:

০১. আমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করব না।

০২. এবং মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্যতা করব না।

০৩. চুরি করব না।

০৪. ব্যভিচার করব না।

০৫. সন্তান হত্যা করব না।

০৬. জেনে-বুঝে কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটাব না। ( বই: মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম, পৃষ্ঠা-১৯১। সহিহ বুখারি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ৬৭২০)।

এরপরের বছরের মদিনা থেকে বারা বিন মারুর নেতৃত্বে ৭৩ জন পুরুষ এবং ০২ জন নারী মক্কায় আগমন করলেন। তাঁরা রাতের অন্ধকারে রাসূল (ﷺ) এর সাথে গোপনে মিলিত হলেন। তাঁরা তখন ইসলাম গ্রহণ করার সময় রাসূলকে (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (ﷺ)! আমরা কীসের ওপর আপনার কাছে বাইআত নেব? তখন রাসূলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম জবাব দিলেন—

০১. খুশিতে-অখুশিতে আমার কথা শুনবে ও মানবে,

০২. স্বচ্ছলতায়-অস্বচ্ছলতায় আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে,

০৩. সৎ কাজের আদেশ দেবে, অসৎ কাজের নিষেধ করবে,

০৪. আল্লাহর হক আদায় করবে, এ ব্যাপারে কোনো সমালোচকের সমালোচনায় ও নিন্দুকের নিন্দায় ভয় করবে না,

০৫. আমি তোমাদের কাছে এলে (মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করলে) তোমরা আমাকে সাহায্য করবে এবং তোমরা যেভাবে নিজেদেরকে, নিজেদের স্ত্রী-সন্তানদেরকে হেফাজত করো, সেভাবেই তোমরা আমাকে হেফাজত করবে। (বই: হায়াতুস সাহাবা, পৃষ্ঠা-৪১২-১৩)।

বাইআতে আকাবা আমাদের কী শেখায়?

দেখুন, এই যে বাইআতে আকাবা, এটি যখন সংগঠিত হয়, তখন কিন্তু আল্লাহর রাসূল ﷺ রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন না। ইসলাম তখনও রাষ্ট্রীয় মর্যদায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তখন ইসলামি রাষ্ট্র বা ইসলামি খিলাফাহ নামে কিছুর অস্তিত্বই ছিল না। তবুও তারা বাইআত নিয়েছেন। রাসূল সা.-ও বাইয়াত দিয়েছেন। তো এই বাইআত দেওয়া ও নেওয়া কীসের ওপর ভিত্তি করে হয়েছিল, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। 

 তবুও আমরা যদি সোজা ভাষায় বলি, সেটা হচ্ছে— তারা বাইআত নিয়েছেন আল্লাহর দীনকে তার জমিনে (ইয়াসরিবে) গালিব করার জন্য। এবং এই কাজের জন্য একজন নেতার প্রয়োজন। সংগঠিত হবার প্রয়োজন। প্রয়োজন দাওয়াত ও তালিম-তরবিয়তের। তারা সেজন্য সবগুলোই করেছেন। আর নেতা হিসেবে রাসূল ﷺ-কে মেনে নিয়েছেন। তাঁর হাতে দীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য, প্রচারের জন্য, পালনের জন্য এবং সর্বোপরি দীন প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতার জন্যে বাইআতবদ্ধ হয়েছেন। এমনকী রাসূলের হাতে বাইয়াত হবার পরে আউস এবং খাজরাজ গোত্রের লোকেরা মদিনার ইয়াহুদিদের সাথে সকল চুক্তিও পরিত্যাগ করেছিল।

যাহোক, এখন যারা বলে রাষ্ট্র ছাড়া বাইআত নেই, তারা এক্ষেত্রে কী জবাব দেবেন? মূলত রাষ্ট্র/ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠিত না থাকলে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের ওপর সংগঠিত হয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য বাইয়াতবদ্ধ হওয়া ফরজ। তারপর বাইআতবদ্ধ হয়ে সংগঠিতভাবে ইসলামি নেতৃত্বের অধীনে থেকে এর মাধ্যমেই ইসলামি হুকুমত বা খেলাফত প্রতিষ্ঠার কাজ করতে হবে। যখন ইসলামি খিলাফাহ বা ইমারাহ প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে, তখন বা তারপরই তো আসবে খলিফার নিকট খিলাফতের বাইআতের কথা। এটাই ইসলামের মূল শিক্ষা।

দীন কায়েমের কাফেলাগুলো কী করে?

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে আজমাইনের সিরাত ও বাইআতে আকাবার শিক্ষা যেহেতু ইসলামের ওপর বাইআতবদ্ধ হয়ে সংগঠিতভাবে ইসলামি নেতৃত্বের অধীনে থেকে এর মাধ্যমেই ইসলামি হুকুমত বা খেলাফত প্রতিষ্ঠার কাজ করা বা ইসলামি রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য ময়দান প্রস্তুত করা, সেহেতু দীন কায়েমের জন্য নিবেদিত কাফেলাগুলো এই শিক্ষাটিরই বাস্তবায়ন করে। তারা ইসলামি হুকুমত কায়েমের স্বপ্ন নিয়েই, ইসলামকে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামগ্রিক জীবনে বাস্তবায়নের জন্যই বাইআতবদ্ধ হয়।

ছাত্রশিবিরের বাইআত

চলুন, আমরা ঘুরে আসি ছাত্রশিবিরের সদস্যদের বাইআত থেকে। ছাত্রশিবিরের সদস্যরা বাইআত নেয় সর্বপ্রথম কালিমায়ে শাহাদাত পড়ে। মানে আল্লাহকে রব, মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে গ্রহণ করে তারপরই তারা সাতটি বিষয়ে শপথ গ্রহণ করে। সেই বিষয়গুলো হুবহু শিবিরের সংবিধান থেকেই তুলে ধরছি—

১) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা.- এর নির্দেশিত আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী জীবন গঠন করে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করাই হবে আমার জীবনের মূল লক্ষ্য এবং এ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার সংকল্প নিয়ে নিছক আল্লাহর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য হচ্ছি।

২) আমি শিবিরের কর্মনীতি ও কর্মসূচি পুরোপুরি সমর্থন করি।

৩) আমি এ সংবিধান অনুযায়ী শিবিরের নিয়ম-কানুন পালন করব। আমি আরও ওয়াদা করছি যে, আমার সাধ্যানুযায়ী—

৪) আমি সমস্ত ব্যাপারে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা এবং কার্যক্রমকে কুরআন ও সুন্নাহর ছাঁচে ঢেলে গঠন করার চেষ্টা করব এবং নিজের জীবনের উদ্দেশ্য, পছন্দ-অপছন্দের মাপকাঠি ও আনুগত্যের কেন্দ্র পরিবর্তন করে শুধু আল্লাহর সন্তোষ লাভের অনুকূলে গড়ে তোলার চেষ্টা করব।

৫) আমি জ্ঞান অর্জন করতে এবং শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতার বিকাশ সাধনের চেষ্টা চালিয়ে যাব।

৬) আমি ছাত্রদের নিকট শিবিরের আহ্বান পৌঁছাতে এবং যারা তা গ্রহণ করে তাদেরকে শিবিরের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ করতে চেষ্টা করব।

৭) আমি আমার ওপর অর্পিত আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করব। ‘ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহ রাব্বিল আ’লামিন।’ (আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু, সবকিছুই আল্লাহর জন্যে যিনি সারা বিশ্বের প্রতিপালক)। [বই : সংবিধান, অধ্যায়-পরিশিষ্ট্য]।


জামায়াতে ইসলামীর বাইআত

এবার আসুন বৃহত্তর আন্দোলন জামায়াতে ইসলামীর বাইআতে। তাদের গঠনতন্ত্র থেকেই তুলে ধরছি বিষয়টা। জামায়াতে ইসলামীর কর্মীগণ যেসব বিষয়ের ওপর বাইআত গ্রহণ করে রুকন হন,  সেগুলো হলো:

“আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে সাক্ষী রাখিয়া পূর্ণ দায়িত্ববোধের সহিত ওয়াদা করিতেছি যে, দুনিয়ায় সামগ্রিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবজাতির কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত দ্বীন কায়েমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্য অর্জন করাই আমার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্য হাসিলের প্রচেষ্টা চালাইবার জন্য আমি খালিসভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে শামিল হইতেছি।

আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র বুঝিয়া লওয়ার পর আরো ওয়াদা করিতেছি যে, 

১- আমি এই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জামায়াতের নিয়ম-শৃঙ্খলা পূর্ণরূপে মানিয়া চলিব; 

২- সর্বদাই শরীয়াত নির্ধারিত ফরজ-ওয়াজিবসমূহ রীতিমত আদায় করিবো এবং কবিরা গুনাহসমূহ হইতে বিরত থাকিব;

 ৩- আল্লাহ তায়ালার নাফরমানির পর্যায়ে পড়ে উপার্জনের এমন কোনো উপায় গ্রহণ করিব না

 ৪- এমন কোনো পার্টি বা প্রতিষ্ঠানের সহিত সম্পর্ক রাখিব না, যাহার মূলনীতি এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ইসলামের ঈমান ও আকিদা এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং কর্মনীতির পরিপন্থী। 

নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার সর্বপ্রকার ইবাদাত অনুষ্ঠানসমূহ, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সব কিছুই সারা জাহানের রব আল্লাহরই জন্য।(সূরা আল-আনআম-১৬২)। আল্লাহ তায়ালা আমাকে এই ওয়াদা পালনের তাওফীক দান করুন। আমীন।” (গঠনতন্ত্র, জামায়াতে ইসলামী)

এই হলো জামায়াতে ইসলামীর বাইআত। এখন দেখুন, এই যে বাইআতটা, এই বাইআতের সাথে বাইআতে আকাবার কোন বিষয়টি বা কোন চেতনাটি সাংঘর্ষিক? বরং দেখা যায়, কোনো সাংঘর্ষিক বিষয় আশায় তো নেই-ই, উল্টো তারা সে সকল বিষয়ের ওপরই আজকের এই যুগে এসেও বাইআতবদ্ধ জীবন যাপন করে আদর্শ মুসলিম হিসেবে নিজেকে এবং সমাজের অগণিত মানুষকে তৈরি হবার সুযোগ করে দিচ্ছে। ইসলামি বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুতে নিজেদেরকে এবং মুসলিমদেরকে তৈরির কার্য সম্পাদনা করছে।

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পরের বাইআত

আচ্ছা, রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রাষ্ট্রপ্রধান হলেন, মদিনায় ইসলামি হুকুমত কায়েম করলেন, এরপরে কি সব বাইআতই কেবল খিলাফতের বা রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্যের বাইআত ছিল? সব বাইআতই কি সব সময় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই দিতেন?

এর উত্তর হলো, না। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় ইসলামি সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর করার পর ইসলামি হুকুমতের প্রধান হওয়ার পরেও সব সময় কেবলই রাষ্ট্রের আনুগত্যের বা ইসলামি হুকুমতের বা ইসলামি নেতৃত্বের আনুগত্যের বাইআতই দিতেন না। এবং সব সময় সব জায়গায় নিজেও যেতে পারতেন না। কখনো কখনো প্রতিনিধিও পাঠাতেন।

 এটুকু বলার পর, এখন এই ব্যাপারে আপনাদের মধ্যে দলিলপত্র পাবার অদম্য এক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে নিশ্চয়ই। ঠিক না? তাহলে আপনাদের জন্যে এক্ষুনি দলিল উপস্থাপন করছি। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা মুমতাহিনার বারো নাম্বার আয়াতটি পড়ে দেখুন। যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা ইরশাদ করেন—“হে নবী! মুমিন নারীগণ যখন আপনার কাছে কাছে এসে বাইআত করে এ মর্মে যে, তারা আল্লাহর সাথে কোনো শরীক স্থির করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদের  হত্যা করবে না, তারা সজ্ঞানে কোনো অপবাদ রচনা করে রটাবে না এবং সৎকাজে আপনাকে অমান্য করবে না, তখন আপনি তাদের বাইআত গ্ৰহণ করুন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা মুমতাহিনা:১২)।

এই যে আয়াতটি, এই আয়াতটি খেয়াল করে দেখুন— এখানে মুমিন নারীদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। আর মূলত এই আয়াত মক্কা বিজয়ের পূর্বে নাজিল হয়েছিল। তখন রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই তাদেরকে বাইআত দিয়েছেন। পরবর্তীকালে মক্কা বিজিত হলে কুরাইশরা বাইআতের জন্য দলে দলে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে হাজির হতে থাকলো। তিনি তখন নিজে সাফা পাহাড়ের ওপর পুরুষদের থেকে বাইআত গ্রহণ করলেন এবং তাঁর নিজের পক্ষ থেকে মহিলাদের বাইআত গ্রহণ করতে এবং এ আয়াতে যে বিষয়গুলো বর্ণিত হয়েছে সে বিষয়ে বাইআত নিতে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে নির্দেশ দিলেন।

এরপর  রাসূলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় ফিরে গিয়ে আনসারি মহিলাদের এক জায়গায় জমায়েত করার নির্দেশ দিলেন এবং তাদের বাইআত গ্রহণের জন্য এবারও সাইয়েদুনা উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে পাঠালেন।

এছাড়াও নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে পুরুষদের সমাবেশে বক্তৃতা করার পর মহিলাদের সমাবেশে গিয়ে সেখানেও বক্তৃতার মধ্যে উপরিউক্ত আয়াতটি তিলাওয়াত করেন। এর মধ্যে যেসব বিষয়ের উল্লেখ আছে সেসব বিষয়েই তিনি মহিলাদের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি নিতেন। (তাফহিমুল কুরআন, সূরা মুমতাহিনা, টিকা:১৮)।

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে আহসানুল বায়ান প্রণেতা বলেন, “বাইআতে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতিও নিতেন যে, তারা শোকে রোদন করবে না, বুকের কাপড় ছিঁড়ে মাতম করবে না। মাথার চুল ছিঁড়াছিঁড়ি করবে না এবং জাহেলি যুগের মহিলাদের মতো ডাক পাড়বে না। (বুখারি ও মুসলিম প্রভৃতি)। এই বাইআতে সালাত, সিয়াম, হজ্জ ও জাকাত ইত্যাদির কথা উল্লেখ নেই। কারণ, এগুলো ইসলামের রুকন এবং দ্বীনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ আচার বিধায় তার বর্ণনার প্রয়োজন হয় না। তিনি বিশেষ করে সেই জিনিসগুলোর বাইআত নিয়েছেন, সাধারণত যেগুলো মহিলাদের দ্বারা বেশি হয়ে থাকে। যাতে তারা দ্বীনের রুকনগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়ার সাথে সাথে এই জিনিসগুলো থেকেও বিরত থাকে।”  (তাফসিরে আহসানুল বায়ান, সূরা মুমতাহিনা:১২)।

আমাদের প্রিয় নবী, মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো কোন কোন বিষয়ে বাইআত দিতেন, সে বিষয়েও আমরা দুয়েকটা হাদিস উল্লেখ করতে চাই।

যেমন আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটা হাদিস আছে, যেখানে তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মহিলাদের বাইআত করার সময়ে এই বিষয়েও প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, তারা মৃতের জন্য বিলাপ করবে না। তখন তারা বললো, “ ইয়া রাসূলাল্লাহ! মহিলারা জাহিলি যুগে মৃতের জন্য বিলাপে আমাদের সহযোগিতা করত। এখন আমরা কি মৃতের জন্য বিলাপে তাদের সহযোগিতা করব না? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, “ইসলামে মৃতের জন্য বিলাপে কোন সহযোগিতা নেই।” (সুনানে নাসা'ঈ: ১৮৫৫)।

জারির ইবনু আবদুল্লাহ্ আল-বাজালি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, “আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বাই’আত গ্রহণ করেছি সালাত কায়েম করার, জাকাত প্রদান করার এবং সমস্ত মুসলিমের মঙ্গল কামনা করার। এছাড়াও শিরক পরিত্যাগ করার বাইআতও নিয়েছেন তিনি।” (সহিহ বুখারি, কিতাবুল ঈমান:৫৭, হায়াতুস সাহাবা, পৃষ্ঠা: ৪০২-৩ )।

এই পর্যায়ে এখানে খেয়াল করে দেখুন— রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সব সময়ই বাইআত গ্রহণ করতে পারতেন না, ফলে কখনো কখনো প্রতিনিধি পাঠাতেন। আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, এখানে কিন্তু খলিফা ও খিলাফত, রাষ্ট্র ও সরকারের যেই আনুগত্যের বাইআত, সেটাও ছিল না। তবে অনেক বাইআতে সেটাও ছিল। মানে রাষ্ট্র প্রধানের আনুগত্যের বাইআতও ছিল। যেমন এই হাদিসটি লক্ষ্য করুন— উবাদা ইবনু সামিত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ মর্মে বাইআত গ্রহণ করলাম যে, সুখে দুঃখে সর্বাবস্থায় আমরা তাঁর কথা শুনব ও তার আনুগত্য করব। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধাচরণ করব না। যেখানেই থাকি না কেন সর্বদা সত্যের ওপর অবিচল থাকব কিংবা বলেছিলেন সর্বদা সত্য কথা বলব এবং আল্লাহর পথে কোনো নিন্দাকারীর নিন্দার ভয় করব না।।” (বুখারি, ইসলামি ফাউন্ডেশন ৬৭০৭)

রাসূলুল্লাহ সা. রাষ্ট্রীয় বাইআত ছাড়াও যে বাইয়াতগুলো দিতেন— বিশেষত আমাদের উপরিউক্ত আলোচ্য অংশটাতে— সেগুলো হচ্ছে, মানুষের মধ্য থেকে আল্লাহর একত্ববাদ, মুসলিম ভাইবোনদের জন্যে কল্যাণ কামনা, অন্যায়-অপরাধ ও পাপাচার না করার প্রতিশ্রুতি, দীনের বিধান বা কুরআন-হাদিস শোনা এবং মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান— ইত্যাদি ছিল। এমনকী মহিলা সাহাবিদের বাইআতবদ্ধ হবার বিষয়টিও ফুটে ওঠেছে।

মহিলাদের বাইআত

ওপরের পয়েন্টে বাইআতের আয়াত এবং হাদিসে মহিলা সাহাবিদের বাইআত গ্রহণের বিষয়টা সুস্পষ্ট ছিল। রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মহিলা সাহাবিদেরও বাইআত প্রদান করতেন— বিষয়টি তো দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই বাইআতে কি মহিলা সাহাবিগণ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের হাতের ওপর হাত রাখতেন? রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি নারী সাহাবিদের হাত ধরে বা স্পর্শ করে বাইআত দিতেন?

 চলুন, বিষয়টি রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তমা স্ত্রী, উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কাছ থেকে জেনে আসি। উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রা. বলেন, “মহিলাদের বাই’আত কেবল কথাবার্তার মাধ্যমে হতো। হাতের উপর হাত রেখে না, যা পুরুষদের ক্ষেত্রে হতো। যেসব মু’মিন মহিলা বাই’আতের শর্তগুলো মেনে নিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলতেন, আমি কথার মাধ্যমে তোমাকে বাই’আত করে নিলাম। আল্লাহর কসম! বাইআতকালে কোনো নারীর হাত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতকে স্পর্শ করেনি। নারীদেরকে তিনি শুধু এ কথার দ্বারাই বাই’আত করতেন— قَدْ بَايَعْتُكِ عَلٰى ذَلِكِ অর্থাৎ আমি তোমাকে এ কথার ওপর বাইআত করলাম। বস্তুত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত কখনোই কোনো গায়রে মাহরাম নারীর হাতকে স্পর্শ করেনি ৷”(বুখারি: ৪৮৯১, মুসলিম: ১৮৬৬)।

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিষয়গুলোর ওপর বাইআত প্রদান করতেন

আমরা যদি রাসূলের (ﷺ) বাইআতের বিষয়বস্তুকে পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব যে, তাঁর বাইআত নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে:

১. ঈমানী বাইয়াত তথা ইসলাম গ্রহণ করার বাইআত।

২. কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলার বা নানান বিষয় ভিত্তিক আমলের বাইআত।

৩. ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্যে ময়দান প্রস্তুত করার বাইআত।

৪. রাষ্ট্রপ্রধান বা খিলাফতের বাইআত।

৫. জিহাদের বাইআত।

৬. ঈমানদারদের মধ্য থেকে শিরক-বিদআত ও কুসংস্কার দূর করার বাইআত।

৭. মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনা করার বাইআত।

৮. দীনের পথে কোনো নিন্দুকেরা নিন্দাবাদের পরোয়া না করে পূর্ণোদ্যমে সম্মুখপানে এগিয়ে চলার বাইআত।

এমনকী আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের বাইআতও নিয়েছেন সাহাবায়ে আজমাইনের কাছ থেকে।

মূলত ইসলামি আন্দোলনের জনশক্তিরা কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলার বাইআত এবং ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্যে ময়দান প্রস্তুত করার বাইআতই গ্রহণ করে। এরপর ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা হলে তখনই রাষ্ট্রপ্রধান বা খিলাফতের বাইআতের বিষয় আসবে।

 ইকামাতে দীনের কর্মীদেরকে তাদের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সেই বাইআত তথা খিলাফতের বাইআত দিচ্ছে না। সুতরাং এটা নিয়ে বিভ্রান্তি কাম্য নয়। তাছাড়া এই বাইআতের সিলসিলাও বাংলাদেশের প্রচলিত ইসলামি আন্দোলনগুলোর চালু করা নয়। বরং আধুনিক দুনিয়ার ইসলামি আন্দোলনগুলো প্রতিষ্ঠার শতাব্দীকাল পূর্বেও এই বাইআত দেওয়া-নেওয়া হতো।

এর বহুকাল পূর্ব থেকে তো পীর-মুরিদী বাইআত চলছিলই। যদিও ইসলামের প্রথম ৫০০/৬০০ বছর পর্যন্ত জিহাদ ও খিলাফতের বাইআত ছাড়া আর কোনো বাইয়াত (সাংগঠনিক বা পীর মুরিদী) ছিল না। আর থাকবেই-বা কেন? তখন রাষ্ট্র ইসলামকে পেট্রোনাইজ করতো। দীনের বিধি-বিধানগুলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কায়েম ছিলো। শাসক খারাপ হলেও দীনকে ইগনোর করতো না। এই যখন অবস্থা, তখন ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্দোলন প্রতিষ্ঠারও ওই অর্থে প্রয়োজন ছিল না। কিংবা আত্মশুদ্ধির জন্যে পীর-উস্তাদের বাইআতও প্রয়োজন হতো না।

উপমহাদেশে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও বাইআত

সারাবিশ্বে তখন ইউরোপীয়দের উত্থান চলছিল। অন্যদিকে মুসলমানদের খিলাফত ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটছিল। তবু্ নামকাওয়াস্তে হলেও ১৯২৪ সাল অবধি মুসলমানদের একটি খিলাফাহ ছিল। যা কামাল পাশা ধ্বংস করে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র চালু করে।

সে যাই হোক, উসমানি খিলাফাহ থাকাবস্থাতেই এই উপমহাদেশে ইংরেজ দস্যুরা আগমন করে। মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পায়তারা করে। এরও পূর্ব থেকে মুসলমানদের হাতে ক্ষমতা থাকার পরও এই উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে শিয়াবাদের ভ্রান্তি ও মুশরিক হিন্দুদের হিন্দুয়ানি কালচার ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করে। নানাধরনের শিরক-বিদআত এবং কুসংস্কারের রমরমা রাজত্ব চালু হয়।

এহেন অবস্থাতেই উপমহাদেশের অযোধ্যার রায়বেরেলিতে ১৭৯৬ সালের ২৯ নভেম্বরে একজন মানুষের জন্ম হয়। নাম ছিল তাঁর সাইয়েদ আহমেদ। যাকে আমরা সাইয়েদ আহমেদ বেরলভি নামেই চিনি। সাইয়েদ আহমেদ বেরলভির জন্ম যেন মুসলমানদের মুক্তিদূত হিসেবেই হয়েছিল।

সাইয়েদ আহমেদ বেরলভি এক সময় ধীরে ধীরে বড়ো হন। মায়ের কাছ থেকেই জিহাদি চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হন। তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন উপমহাদেশের আরেকজন নন্দিত নায়ক শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহিমাহুল্লাহর খলিফা ও পূত্র শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিস দেহলভীর কাছে। তিনি ১৮১৭ সালে তাঁর হাতেই বাইআতবদ্ধ হন। (চেতনার বালাকোট, পৃষ্ঠা: ১৮)।

এরপর এক পর্যায়ে তিনি এই ভারতীয় উপমহাদেশে সম্রাট হুমায়ূনের অসচেতনতায় এবং হিন্দুয়ানি কালচারের প্রভাবে মুসলমানদের ঈমান-আমল, আকিদা ও আখলাকে যে-সকল ভ্রান্তি, কুসংস্কার, শিরক-বিদআত অনুপ্রবেশ করেছিল, সেগুলো বিদূরিত করার মহান লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়া নামক একটি সংগঠন।

সেই সংগঠনের মাধ্যমে মুসলমানদের ঈমান আমলের সংস্কার, শিখ ও ইংরেজদের জুলুম থেকে মুসলমানদের মুক্তি দানের মহান আকাঙ্ক্ষায় জিহাদি চেতনা উজ্জীবিত করার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। সাইয়েদ আহমেদ শহীদের সেই আন্দোলন-সংগঠনে বাংলাদেশেরও অগণিত আলিম-ওলামা অন্তর্ভুক্ত হন এবং বাইআত গ্রহণ করেন। এরমধ্যে নোয়াখালীর মাওলানা ইমামুদ্দিন বাঙালি অন্যতম। (চেতনার বালাকোট, শেখ জেবুল আমীন দুলাল, পৃষ্ঠা: ২৯)।

সম্ভবত ইমাম আবুল হাসান আলী নদভী রহিমাহুল্লাহ তাঁর সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস বইতে উল্লেখ করেছেন যে, সাইয়েদ আহমেদ শহীদের হাতে ৪০ হাজারের অধিক হিন্দু মুসলমান হয়েছে। ৩০ লাখ মুসলমান তাঁর হাতে বাইআত গ্রহণ করেছে।

সে যাই হোক, সংখ্যাটা কত, সেটা আসলে মতপার্থক্যের বিষয় হলেও তাঁর আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে কোনো ধরনের মতপার্থক্যের অবকাশ নেই। হাজি শরীয়তুল্লাহ ও তাঁর ফরায়জি আন্দোলন এবং মীর নিসার আলী তিতুমীর, শহীদ সাইয়েদ আহমেদ বেরলভির আন্দোলনেরই ফসল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়া নামক সংগঠনে মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন তরিকার মানুষ তো ছিলেনই, এমনকী শিয়ারাও শিয়াবাদ ছেড়ে মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ তরিকায় চলে আসেন এবং বাইআতবদ্ধ হন। শিয়াদের তাজিয়া মিছিলের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করায় তাঁর কর্মীদের জেলেও যেতে হয়।এছাড়াও সীমান্ত প্রদেশের কয়েকটি রাজ্যে যে তিনি শরিয়াহ কায়েম করেছেন বা ইসলামী হুকুমত করেছেন, সেটাও এই মজবুত এবং বিশুদ্ধ তাওহিদের দাওয়াত প্রদানের জন্য সম্ভবপর হয়েছে। মানে তিনি তৎকালীন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে শুরু করে মর্দান পর্যন্ত এ বিশাল অঞ্চলে শরিয়াহ কায়েম করেন বা ইসলামি শাসনব্যবস্থা চালু করেন। সেটাকে ভিত্তি করে জালিম শিখদের জুলুমের বিরুদ্ধে যে তিনি জিহাদ পরিচালনা করে সাফল্য পেয়েছেন, তা এই বাইআতবদ্ধতা ও নির্ভেজাল দীন অনুসরণের ফলেই পেয়েছেন। যদিও সর্বশেষ তিনি বালাকোটের ময়দানেপাঠানদের বিশ্বাসঘাতকতায় শাহাদাত বরণ করেন।

এখানে উল্লেখযোগ্য দুটি বিষয় খেয়াল করুন। সেগুলো হচ্ছে: তখন কিন্তু নিভু নিভু পর্যায়ের হলেও মুসলমানদের একটা খিলাফত— উসমানি খিলাফত চলছিল।  কিন্তু এই উপমহাদেশে ভয়াবহভাবেই শিরক-বিদআত ঘাটি করেছিল। পাশাপাশি সীমান্ত প্রদেশে মুসলমানদের ওপর মুশরিক শিখদের অনবরত হামলা চলছিল তো চলছিলই। এবং ইংরেজ দস্যুরা মুসলমানদের স্বাধীনতা হরণ করে যাচ্ছিল।

সবমিলিয়ে এই অঞ্চলে ইসলামি তাহজিব-তমুদ্দুন অনৈসলামিক আবরণে বিনষ্ট হয়ে পড়ছিল। তো তিনি এবং তাঁরা ইসলামি খিলাফতের খলিফার দিকে না তাকিয়ে থেকে নিজের ভূখণ্ডকে, নিজ কওমকে কীভাবে জাগিয়ে তোলা যায়, নিজের জন্মভূমিকে কাফির ও কুফুরি শাসনের করায়ত্ত থেকে কীভাবে মুক্ত করা যায়, সে-জন্য জি জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর জাগরণী কাজের সূচনা করেন। সেই উপলক্ষ্যে সংগঠন গড়ে তোলেন। সংগঠিত ব্যক্তিদের বাইআত প্রদান করেন। প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এরপর তাদের দ্বারা জিহাদ পরিচালনা করেন, এক পর্যায়ে কিছু অঞ্চলে শরিয়াহ কায়েমও করেন। এরপর তো শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে পাড়ি জমান প্রভুর দরবারে।

যাই হোক, এই পয়েন্ট থেকে আমরা শিখতে পারি— বিশ্বব্যাপী ইসলামি খিলাফাহ কায়েম করতে পারি বা না পারি, অন্তত নিজের ভূখণ্ডে হলেও যেন ইসলামি শরিয়াহ কায়েম করতে চেষ্টা করি। আর এই জন্যেই যেন জামায়াতি ও বাইআতি জিন্দেগি যাপন করি। এবং নিজেদের ঈমান-আমল-আখলাক-আকিদা পরিশুদ্ধ করার কাজ থেকে যেন পিছপা না হই।

পাশাপাশি আরেকটা কথাও বলে রাখি, যা পূর্বেও বলেছিলাম— এই জমিনে বাইয়াত ও সংগঠনবদ্ধতার কাজ মওদূদী রহিমাহুল্লাহ কিংবা জামায়াত-শিবির চালু করেনি। বরং দীন কায়েমের জন্য এই কাজ দুই-তিন শতাব্দীকাল থেকেই চলে আসছে এই জিমেনে। এবং সেটা তাঁরাই করেছেন, যাদের আকিদা ও মানহাজের ব্যাপারে কারো মধ্যেই কোনো সংশয় নেই। তাছাড়া এই কাজ বা এই পন্থায় ও পদ্ধতিতে স্বয়ং রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কাজ করেছেন।

বাইআত ও শাসকের আনুগত্যের ব্যাপারে চূড়ান্ত কথা

এই পয়েন্টের আলোচনার শুরুতেই একটি হাদিস উপস্থাপন করতে চাই। তা হলো এই— “যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে তার হাতকে খুলে ফেলল, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে এমনভাবে যে, তার বলার কিছুই থাকবে না। আর যে ব্যক্তি বাইআতের বন্ধন ছাড়াই মারা গেল সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।” (মুসলিম : ৩৪৪১)।

এখানে উক্ত হাদিসের আলোকে যা বুঝতে পারি আমরা, সেটা হলো বাইয়াত নেওয়া মূলত আবশ্যক। তবে সে বাইআত আমরা কার কাছে নেব? খলিফা বা ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান যিনি, তার কাছেই তো। ঠিক না? কারণ, আনুগত্য তো তারই করতে হবে। তাই না? কিন্তু এখন তো খিলাফত নেই, তাহলে বাইআত কার কাছে নেব? আনুগত্যই-বা কার করব? কেউ কেউ বলেন রাষ্ট্র যেহেতু নেই, সেহেতু বাইআতও নেই। ইসলামি হুকুমত তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকলে বাইআতহীন থাকলে গুনাহগার হতে হতো।

আচ্ছা, ওনারা শাসকের আনুগত্যের ব্যাপারে কখনো কি সাহস করে এ কথাটা বলেন? যেহেতু খলিফা নেই, ইসলামি ইমারাহ নেই, সেহেতু রাষ্ট্র প্রধানের আনুগত্যও নেই। বলেন কি? না। বলেন না। এটা বলা তো আরো সহজ ছিল। কারণ এই ব্যাপারে কুরআনের আয়াতও আছে— যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না, শাসন পরিচালনা করে না, তারা কাফির, জালিম, ফাসিক।

একজন মুসলিমের কি কুফুরি বিধান দিয়ে ফায়সালা করা শাসকের আনুগত্য করা উচিত? এ ব্যাপারে তাঁরা কি কোনো বক্তব্য-বিবৃতি প্রদান করেন? যদি তা না করে থাকেন, তাহলে ওনারা কেন শুধু বাইআতের ব্যাপারেই এভাবে বলেন? কোনো কিন্তু কি এর মধ্যে লুকায়িত আছে? মনে হয় থাকতেও পারে। আল্লাহই অধিক অবগত।

যাই হোক, এখন যেহেতু ইসলামি হুকুমত নেই, খিলাফত নেই  ইসলামি রাষ্ট্র নেই, শরিয়াহ বাস্তবায়িত নেই, সেহেতু আমরা সেই আমল থেকে বা বাইআতহীন থাকার গুনাহ থেকে মুক্ত— তাদের এই বক্তব্যটুকু সঠিক। সঠিক বলতে আংশিক সঠিক। এখন আমার কথা হলো বাইআতহীন মৃত্যু যে জাহিলিয়াতের মৃত্যু, এই হাদিসগুলো তো সহিহ। ওপরে বর্ণিত হাদিসটিও তো সহিহ।

সবকিছু বাদ। মূল আলোচনায় ফেরত আসি। খিলাফত না থাকায় খলিফার হাতে বাইআত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না আমাদের দ্বারা। এক্ষেত্রে আমরা নিজেদেরকে মাজুর হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। মুসলমানরা যেন বাইআতবদ্ধ জীবন পায়, খলিফার হাতে, ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের হাতে বাইআত নিতে পারে, সেজন্য কাজ করার বিধান কী? ইসলামী রাষ্ট্র বা খিলাফত প্রতিষ্ঠিত না থাকার জন্যই তো মানুষ জাহিলিয়্যাতের দিকে পঙ্গপালের মতো ছুটছে। খিলাফত প্রতিষ্ঠিত না থাকার জন্যই তো বাইআতের মতো এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের কাছ থেকে মিস হয়ে যাচ্ছে। আমরা ইসলামি শাসনব্যবস্থা থেকে মাহরুম হচ্ছি। এক্ষেত্রে কি আমাদের কোনো করণীয় নেই? ওপরের হাদিসের মতো করে কুরআনের আরো একটা নির্দেশ হচ্ছে শাসকের আনুগত্য করো। শাসকের আনুগত্য করা ফরজ। হাদিস হলো, যে ব্যক্তি মারা যায়, অথচ আনুগত্য বা বাইয়াতের বন্ধনহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তার মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যু। সহিহ মুসলিমের হাদিস যেভাবে, একইভাবে বুখারিরও হাদিস।

কুরআনও বলছে আল্লাহ, রাসূল এবং শাসকের আনুগত্য করো। (সূরা নিসা:৫৯)। কোন শাসকের? যে শাসক আমাদেরকে কুরআন-হাদিস অনুযায়ী চালান। যিনি বা যে শাসক অথবা যেই রাষ্ট্র আমাদেরকে শরিয়াহ অনুযায়ী, কুরআন-হাদিসের বিধান মতো চালান না, তার আনুগত্য করা কি ফরজ? আপনি মুসলিম হিসেবে আপনার বিবেক কী বলে? বরং যিনি কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী আমাদেরকে চালান না, তার আনুগত্য করা হারাম। স্রষ্টার আনুগত্য ছেড়ে সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবল সৎ কাজে। নেক কাজে। ভালো কাজে। এগুলোও রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। (মুসলিম: ১৮৪০, বুখারি: ৭১৪৫)।

সেই শাসকের বাইআতই আমাদেরকে জাহিলিয়াতের মৃত্যু থেকে রক্ষা করবে, যে শাসক আল্লাহর দীন অনুযায়ী আমাদেরকে চালান। আমি হাদিসের মর্ম অনুযায়ী যা বুঝেছি, সেটা হচ্ছে— যতোক্ষণ ইসলামি হুকুমত বা ইসলামি রাষ্ট্র অথবা বৃহৎ পরিসরে ইসলামি খিলাফত যে পর্যন্ত না কায়েম হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে আমরা গুনাহগার হব। কারণ আমরা ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করছি না। খিলাফত কায়েম করছি না।

তবে হ্যাঁ, তারা গুনাহের অধিকারী হবে না, যারা এই জাহিলি শাসনব্যবস্থা বা খোদাদ্রোহী কাঠামোকে মনেপ্রাণে ঘৃণা বা অপছন্দ করে গিয়েছে। এই শাসন কাঠামোয় সন্তুষ্ট ছিল না যারা, তারা পাপের ভাগিদার থেকে মুক্তি পাবে। পাশাপাশি আরেকটা কাজও করতে হবে। সেটা হচ্ছে যেই পর্যন্ত না আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করা যাচ্ছে, ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা না যাচ্ছে, খোদার দুনিয়ায় তার দীনকে কায়েম করা না যাচ্ছে, খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা না যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত যাদের সর্বোচ্চ এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকবে শরিয়াহ কায়েমের জন্য, তারা গুনাহ থেকে মুক্ত থাকবে। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, বা ইকামাতে দীনের শপথ তথা বাইয়াতবদ্ধ হবার কারণে তারা জাহিলিয়াতের মৃত্যু থেকে মুক্ত থাকবে, ইন শা আল্লাহ। এই একই কথাগুলো আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভী রহিমাহুল্লাহ তাঁর ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা তত্ত্ব ও প্রয়োগ বইয়ের ভূমিকার চার-পাঁচ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন।

মহান মালিক আমাদেরকে ইকামাতে দীনের সংগ্রামে, নবুওয়তের আদলে খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হয়ে ময়দানে ইখলাস ও ইয়াকিনের সাথে ভূমিকা পালন করার তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন।



~রেদওয়ান রাওয়াহা

[লেখাটি ছাত্র সংবাদ-২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে ]







 

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ