|| জীবন-উদ্দেশ্যের খোঁজে ||



জীবনের কোনো গতি নেই। পাচ্ছি না। জড়তা-সংকোচও কাটছে না। কিছুই ভালো লাগে না। কতো কিছুই করতে চাই, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আলস্যের আখড়া যেনো আমি। কবি মতিউর রহমান মল্লিক রহঃ তাঁর একটা কবিতায় বলেছেন,

"জীবনের মানে হলো তার কাঁটার বেড়া ভেঙে ফেলা......"

নাহ! আমার তো কোনো কাঁটার বেড়া নেই। কী ভাঙবো আমি? ভাঙার তো কিছুই নেই! কিছুই যেহেতু নেই, তবুও এমন লাগছে কেনো? এই আবার কেমন জীবন! এ- আবার কেমন অনুভূতি! কী করবো! এলোমেলো সব ঝড় চলে মগজের ভাঁজে ভাঁজে....

বুকের খাঁচায় আটকানো "সুখ" নামক পাখিটা নেই। কোথায় গেলো সে? কোথায় পাবো তাকে? আমার স্বপ্ন, আমার সাধনার শোচনীয় পরাজয় ঘটিয়েছে কে! এখন আর কেনো কোনো স্বপ্ন দেখি না। কাউকে কোনো স্বপ্নও দেখাই না! কাউকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখতেও চাই না! কিন্তু কেনো?

জীবনের, যৌবনের, ক্যারিয়ারের, পরকালের —কোনোদিকেই মন নেই। মন-সাগরের সব ঢেউ আজ থমকে গেছে। কোনো ঢেউ নেই। গর্জন নেই। তর্জন নেই! অথচ তা তো ছিলো! খুব বেশিই ছিলো ! কিন্তু আজ আর কিচ্ছু নেই ! একেবার কিচ্ছু .... আজ আর মন থেকে কেনো আমি কিছুই ভাবতে পারছি না। ভাবি না! ভাবনায় আসছেও না।

সুস্থ চোখ। দিব্যদৃষ্টি। সেই দিব্যদৃষ্টিতে চোখ মেলে তাকাই এদিকে-ওদিকে। আশেপাশে। চারিদিকে। চারপাশে নাকি সৌন্দর্যের সাগর। মন জুড়ানো। চোখ ধাঁধানো। আমার তো সুস্থ চোখের দৃষ্টি। তবুও কেনো আজ সে দৃষ্টিতে সে সকল সৌন্দর্যের কিছুই দেখি না আমি। এ আমার কী হয়ে গেলো! আমি তো কিছুই বুঝতেছি না! বুঝতে পারছি না। আগা মাথার সন্ধান পাচ্ছি না আমি!

নাহ্! এভাবে চলতে পারে না! এটাকে জীবন বলে না! এটা কোনো জীবন নয়! এর নামও জীবন নয়! যে জীবনে কোনো স্বপ্ন নেই। লক্ষ্য নেই! উদ্দেশ্য নেই। গন্তব্য নেই! এই যে জীবন, এমন জীবনের কোনো মানেই হয় না!!

আমার তো গুনগুনিয়ে গলা ঝাঁকিয়ে গান গাইতেও ভালো লাগে। কিন্তু আজ আর লাগছে না কেনো! আমার মনের বেতারের গানগুলো কেনো আজ বেজে বেজে ওঠছেনা!!.....

ছাদে উঠি। ছাদে বসে চাঁদের আলোয় স্নান করি। তারা দেখি। তারাদের মেলায় হারিয়ে যাই। হারিয়ে ফেলি নিজেকে। তারাদের সাথে লুকোচুরি খেলতে আমার বড্ড ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে! সেকারণে আমি দূরের ওই নীলিমা দেখি। নীলাকাশ দেখি। প্রতিদিন। প্রতিরাত। প্রতি সন্ধ্যায়....

শেষ বিকেলে নদী-তরঙে তার জোয়ার দেখি। ভাটা দেখি। নৌকায় উঠি। পা ভিজিয়ে দিই। নদীর সেই শান্ত জলে হঠাৎ ঝড় ওঠে। আকাশ থেকে তাই বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিতে ভিজে যাই। বৃষ্টি আমার সারা দেহ ভিজিয়ে দেয়। শীতল করে দেয়। বৃষ্টির আদর আমার কপোল বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। আমার কম্পিত ঠোঁটে বৃষ্টির ছোঁয়ায় নেমে আসে এক টুকরো প্রশান্তির স্নিগ্ধ পরশ! মগজের ভাঁজে ভাঁজে বৃষ্টির ছোঁয়া পাই। আমার মগজ ঠান্ডা হয়। শান্ত হয়। স্নিগ্ধ হয়। শীতল হয়…...

কিন্তু আমার তো সে-সবের চেয়ে রাতের আকাশের ভেসে ওঠা ধবল জোসনায় স্নান করতে, তারার মেলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে একটু বেশিই ভালো লাগে। অথচ, আজ সব কিছুই নীরব। নিথর। নিস্তব্ধ...
মিলোডিয়াস কন্ঠের জাদুকর শিল্পী সাইফুল্লাহ মানসুরের গাওয়া একটি গানের সুর ও ভাষা আমার স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠেছে। সে গানের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই ;

"তারাগুলো আজ যেনো নিভে গেছে সব নদীগুলোও কেনো যেনো হয়েছে নীরব...."

আমার পাশে আজ কিছুই নেই। চাঁদ নেই। সূর্য নেই। নদী নেই। ঝিঁঝিঁপোকাদের ডাকাডাকি নেই। আমি কী করবো? কী দেখবো? কী শুনবো.....

হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম,ফররুখ কেউই টানে না। সবাইকে ধুমিয়ে ধুমসে পড়তাম। এখন তা-ও ভালো লাগে না! ঢাউস ঢাউস হুমায়ুন পড়েছি। রবিন্দ্রনাথ পড়েছি। কেউ আমাকে জীবনের সন্ধান দেয়নি।জীবনের উদ্দেশ্য কারো কাছে পাইনি....

কবিতা পড়তে ভাললাগে। ভীষণ ভালো লাগে। কতোদিন তা-ও পড়া হয় না। আজ সময়ের আলোচিত-পাঠক প্রিয় বিশ্বাসী তরুণ কবি আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব ভাইয়ের কবিতার বই খুঁজতে শুরু করেছি। পেয়ে গেছি একটা কবিতা। তাঁর কবিতায়ও জীবনের মানে খুঁজতে শুরু করছি। এই তো, একটা কবিতা পেয়ে গেছি আমি! কবিতা আমাকে খুব টেনেছে। খুব...! তাঁর সে কবিতায় জীবনের মানে খুঁজতে তিনি আমাকে একটা কাষ্ঠকঠিন পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন —

" জীবনের মানে খুঁজতে যাও শুধু তার কাছে, স্মৃতির অত্যাচার সয়ে যে দিব্যি বেঁচে আছে।"

কিন্তু নাহ! জীবনের মানে খুঁজতে কারো কাছেই তো আমার যাওয়া লাগছে না! স্মৃতির জ্বালা সয়ে আজো বেঁচে আছি আমি। স্মৃতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ আমার মন-মনন....

ধীরে ধীরে আমি স্মৃতির অত্যাচারকে হজম করতে শিখেছি। কেউ একজন কোনো একসময় যেনো আমাকে বলেছেন যে,

" জীবনের মানে হলো বাঁচতে শেখা......

আমি বাঁচতে শেখেছি। চেষ্টা করছি বাঁচতে। কিন্তু এই বাঁচাতে কোনো মানে খুঁজে পাই না। পাই না খুঁজে স্বার্থকথা। এই যে আমার বেঁচে থাকা, এই যে আমার জীবন, এই জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই। উদ্দেশ্য নেই। গন্তব্য নেই। স্বপ্ন নেই.....

জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে আমি কুরআনের কাছে আসি। এই তো ! এই তো আমি পেয়ে গেছি! আমার জীবনের উদ্দেশ্য আমি খুঁজে পেয়েছি! কুরআন পড়তে পড়তে আমার সামনে ভেসে ওঠে,

" আমি জিন ও মানুষকে আমার ইবাদাত ছাড়া ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করিনি।( সুরা যারিয়াত: ৫৬)
পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছি। এলোমেলো। অনবরত....

সুরা আনআমের ১৬২ নাম্বার আয়াতে কারিমা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। চক্ষুস্থির হয়ে পড়ে।

ঠোঁট কেঁপে ওঠে। কম্পিত ঠোঁটে আমি তিলাওয়াত করতে থাকি,

ان صلاتي ونسكي ومحيا يا وماماتي لله رب العالمين....
( নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার সকল ইবাদাত, আমার জীবন আমার মরণ সব কিছুই মহান রাব্বুল আলামীনের জন্য)।

আজ আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্য পেয়ে গেছি। আমি আমার জীবনের মানে বুঝে গিয়েছি। আমার গন্তব্য এখন কোথায় তা জানতে হবে। আমি আরো অনিন্দ্য আবেগ নিয়ে তিলাওয়াত এগিয়ে নিচ্ছি। পেয়ে গেলাম সুরাহ তাওবাহর ১১১ নাম্বার আয়াত। এখানে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, আমার জীবনের গন্তব্য জান্নাতুল ফিরদৌসের সবুজ নদীর মোহনায়। জান্নাতের সেই বাগানে, ফিরদৌসের সেই নদীতে বিচরণ করার তরে আমার রব্ব আমার থেকে আমার জীবনটা খরিদ করে নিয়েছেন......

আজ তাই আমি আমার জীবনের লক্ষ্যকে রব্বুল আলামীনের দিকে নিবেদিত করলাম। আমার গন্তব্য সেই চির সবুজ চির সুখের জান্নাত। যার সীমানা আকাশ-জমিন বিস্তৃত। সেই মহামহিম আল্লাহর সন্তোষ অর্জন করে জান্নাতের সবুজ আঙিনায় বিচরণ করার জন্যে আজ আমি স্বপ্ন আঁকি। স্বপ্ন দেখি।

কবি আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব ভাইয়ের কবিতার লাইনগুলো এখন আমি গুনগুনিয়ে আওড়াতে থাকি;
" মনের ভেতর একটা স্বপন খুব যতনে আঁকি। ফেরদৌসের ফুল বাগানে আমি হবো পাখি। "

প্রভুর সন্তোষ অর্জন করে ফেরদৌসের ফুল বাগানের পাখি হয়ে ওড়ে ওড়ে জান্নাতের সেই দুধের নহর মধুর নহর থেকে দুধ-মধু-শরাব পান করে চিত্তকে প্রশান্ত করার চির আকাঙ্ক্ষিত সেই শোভন স্বপ্নের পসরা বুকে নিয়ে নিজেকে সজ্জিত করছি রব্বের রঙে....
কিন্তু আমি তো সেই সুন্দর রঙে নিজেকে রাঙাতে পারছি না। আমি তো ভুল করেই যাচ্ছি। ভুলের সায়রে বসে আছি। ভুলের নদীতে সাঁতার কাটছি। বারংবার ভুলের সাগরে ঝাপিয়ে পড়ি। প্রায় প্রতিদিনই। প্রতিটিক্ষণেই! তবুও আমার একটা সান্ত্বনা আছে। তা হলো, আমি তো জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছি। জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছি...

| |জীবন-উদ্দেশ্যের খোঁজে ||

-রেদওয়ান রাওয়াহা

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ