ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহহুল্লাহ


 

 সকল আমলই নিয়্যাতের ওপর নির্ভরশীল"।


"ইসলামের সৌন্দর্য হলো অপ্রয়োজনীয় কথা ও কাজ পরিত্যাগ করা"।
"কোনো ব্যক্তি মু'মিন গতে পারবে না ততোক্ষণ, যতোক্ষণ সে নিজের জন্যে যা পছন্দ করে তা অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্যে না করবে! "
"হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট!"


ওপরের দুর্দান্ত ও জীবনঘনিষ্ঠ চমৎকার হাদিস সমূহ তিনি তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। এই হাদিসগুলো হাদিসের মৌলিক ও প্রধান সকল গ্রন্থে মুহাদ্দিসরা উল্লেখ করলেও এই হাদিসগুলো নিয়ে তিনি করেছেন অসাধারণ হৃদয় আলোড়নকারী মন্তব্য। তিনি উক্ত হাদিস সমূহ সম্পর্কে বলেন –আমি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লাম এর পাঁচ লক্ষাধিক হাদিস থেকে গ্রহণ বর্জনের মধ্যে ৪৮০০টি হাদিস নিয়ে এসেছি এই গ্রন্থে। যেগুলো সহীহ্ এবং হাসান হাদিস। এই বিশাল গ্রন্থের মধ্য থেকে মাত্র (এই) চারটি হাদিসই দ্বীনুল ইসলাম অর্জনের জন্য যথেষ্ঠ!


সত্যি কেউ যদি এই হাদিসগুলোকেই বুঝে, ধারণ করে হৃদয়ে, আর চেষ্টা করে উপলব্ধি করতে তাহলে তার জন্য ইসলামের বিধানকে হৃদয়ে চাষাবাদ করার জন্যে, মন-মগজে ধারণ করার জন্যে যথেষ্ঠ!


তিনি তাঁর হাদিসগ্রন্থে প্রায় সকল হাদিস সম্পর্কেই মন্তব্য করতেন। কোনটা সহীহ্, কোনটা দ্বয়ীফ, কোনটা নাসিখ কোনটা মানসুখ,একই জাতীয় হাদিসের দু'ধরণের বর্ণনা পেলে কোনটা সন্দেহযুক্ত কোনটা বিশুদ্ধ তা তিনি বলে দিতেন, সুস্পষ্টরূপে। তবে কোনো কোনো হাদিসের ক্ষেত্রে তিনি মন্তব্য না করে চুপ থেকেছেন।


এই যে চুপ থাকা, এটা নিয়ে আলিমদের মাঝে মতপার্থক্য তথা মতভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়! তারা অধিকাংশই মনে করেন যে, যেহেতু তিনি চুপ থেকেছেন তার মানে এই নয় যে হাদিসটি দ্বয়ীফ। বরং হাদিসটি হাসান। কেউ কেউ বলেন যে তা দ্বয়ীফই। কিন্তু বাস্তবে মোটের ওপর তেমনটি না।
কারণ, তিনি যখন হাদিস সংকলনের কাজে মনপ্রাণ দিয়ে নেমে পড়লেন, তখন কিন্তু মক্কার অধিবাসীদের পত্র প্রেরণ করেছেন। সেই পত্রে তিনি গ্রন্থটি ফিকহী পদ্ধতিতে সাজানো এবং সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে সহীহ্ পদ্ধতিতে তা সংকলিত করার কথা উল্লেখ করেছেন।

ইসলামের ইতিহাসের একেবারে প্রথম থেকেই মুহাদ্দিসরা বিধি-বিধান এবং উপদেশমূলক হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনের ওপর অধিক গুরুত্ব প্রধান করেন। বাস্তব জীবন ও কর্মের জন্যে তো রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের দৈনন্দিন কর্মের বিষয়গুলো সবচে বেশি প্রয়োজন। যার পরিপ্রেক্ষিতে হিজরি তৃতীয় শতকের শেষার্ধ থেকে মুহাদ্দিসরা শরিয়তের বিধান সম্পর্কিত হাদিসগুলো সংকলনের ওপর একটু বেশি গুরুত্ব দিতে থাকেন। আর এই বিধান বা আহকাম জাতীয় হাদিস গ্রন্থসমূহকে বলা হয় সুনান।


আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের দৈনন্দিন জীবনের কর্ম তথা স্বলাত, সওম, হাজ্জ্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয়, বিয়েশাদি, শাসনব্যবস্থা, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা বাস্তব জীবনের বিষয়গুলো অধিকতর জরুরি।


এই জিনিসটা উপলব্ধি করেন তিনিও। তাই নেমে পড়েন কর্মেও। ব্যবহারিক জিন্দেগীর আমলের যে হাদিস সমূহ –সেগুলো সংগ্রহের মতো মহৎ উদ্যোগ আর উদ্দেশ্য নিয়ে। শুরু করেন সংগ্রাম আর সাধনা। তিনি আল্লাহর রাসুলের মুখনিঃসৃত অমিয় বাণী সমূহের যে মহা সাগর,সে মহা সাগরে ডুবুরি হয়ে সাঁতার কেটে সেখান থেকে সিঞ্চন করতে শুরু করেন মানুষের সীমিত যে জিন্দেগি, সে জিন্দেগি যাপনের উপযোগী হাদিস সমূহ! পূর্বেই তো বলেছিলাম যে, এ-সব হাদিসগ্রন্থকেই বলা হয়ে থাকে সুনান। আর তিনিছিলেন সুনান গ্রন্থ সংকলকদের পথিকৃৎ। তিনি তাঁর সুনান গ্রন্থে সে-সকল হাদিস সন্নিবেশ করেছেন, যেগুলোকে ফিকহের ইমামরা তাঁদের মতামতের পক্ষে দলিল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছেন, 'আমার এ কিতাবের মধ্যে ইমাম মালিক, ইমাম সাওরি, ইমাম শাফিঈ (রহঃ)দের মাজহাবের ভিত্তি মজুদ রয়েছে।'


যতোটুকু জানা যায় -তিনি তাঁর যৌবনের সোনালি সকালেই 'সুনান গ্রন্থটির রচনা সম্পন্ন করেন। তিনি তাঁর স্মৃতির মলাটে আবদ্ধ হাদিসের সুবিশাল ভাণ্ডার থেকে যাচাই-বাছাই করে মোট চার হাজার ৮০০ হাদিস তাঁর সুনান গ্রন্থে সমবেত করেন। এ বিষয়ে তিনি নিজেই বলেন, 'আমি রাসুলে করিম (সা.)-এর পাঁচ লাখ হাদিস লিপিবদ্ধ করেছিলাম। তার মধ্য থেকে বাছাই করে মনোনীত হাদিসগুলো এ গ্রন্থে সমবেত করেছি।'


দিনের পর দিন যায়। একপর্যায়ে তাঁর গ্রন্থের রচনা-সংকলনেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর প্রথম তা নিজের উস্তাদের নিকট উপস্থাপন করেন। যেই উস্তাদের কাছে তিনি তা উপস্থাপন করেছেন, তিনি আর কেউ নয়, তাঁর সেই উস্তাদ ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.)! তাঁর উস্তাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বিমুগ্ধ আর বিমোহিত হন। আনন্দে চোখের তারা যেনো চিকচিক করে ওঠে। কে না খুশি হয় তার হাতে গড়া মানুষের, সাগরেদের এমন অভাবনীয় মহৎকর্ম দেখে? হয়েছেন তিনিও।
তিনি তাঁর সেই গ্রন্থখানা খুবই পছন্দ করেন এবং একখানা উত্তম হাদিস গ্রন্থ বলে প্রশংসা করেন।প্রশংসার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত করেন তাঁর প্রিয় ছাত্রকে! অতঃপর তিনি নিজের সেই গ্রন্থখানা সকলের জন্য সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করেন, উপস্থাপন করেন। তাঁর পরিশ্রম, মনোযোগিতা, একাগ্রতার আর সাধনার সাক্ষী তাঁর ছেলে ইমাম আবু বকর রাহিমাহুল্লাহ! তাঁর জীবনাচরণ সে সময়ের, সে যুগের মানুষদের মধ্যে একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী ছিলো! ওনার ছেলে বলেন যে, তিনি ইলমুল হাদিসের সাগরে এমনভাবে ডুবে থাকতেন খাবারের সময়টা পর্যন্ত পেতেন না ঠিকমতো!


ইলমে হাদিসের এই উজ্জ্বল তারকা আল ইসলামের এই প্রজ্জ্বল বাতিটা আর কেউ নয়, তিনি ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ! সুনানে আবু দাউদ'-এর সংকলক তিনিই। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম সুনান হলেও পরবর্তীতে ওনার নামের সাথেই একে যুক্ত করে "সুনানে আবু দাউদ" নামে নামকরণ বা চিহ্নিত করা হয়। এই মহান ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ ইলমে হাদিস চর্চার স্বর্ণযুগ ২০২ হিজরি সনে, ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান আফগানিস্তানের কান্দাহার ও চিশতের কাছে সিস্তান নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম সুলাইমান, উপনাম আবু দাউদ, বাবার নাম আশয়াস, দাদার নাম ইসহাক। জন্মস্থানের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে তাঁকে সিজিস্তানি বা সিস্তানি বলা হয়।
কারো কারো মতে তাঁর জন্ম ২০৩ হিজরিতে। যদিও সেটা দুর্বল মনে করেন অধিকাংশ ইতিহাসবিদ।

অনেক মানুষের জীবন একেক সময় একেক স্থানে কাটে। ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ'র জীবনী সম্পর্কে পড়াশোনা করে যতোটুকুন অনুমিত হয়, তা হলো ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ'র শৈশব সিস্তানেই কেটেছিল। পারিবারিক পরিমণ্ডলে অর্জন করেন প্রাথমিক শিক্ষা!

দুনিয়ার প্রতি লোভহীনতা এসব মহৎপ্রাণ মানবদের প্রধান ভূষণ!তাঁর ভূষণ সে থেকে ব্যতিক্রম নয়। তাঁদের মন মননে,চলন-বলনে,চিন্তা-কর্মে সবসময়ই বইতো দ্বীনের প্রচার-প্রসার আর প্রতিষ্ঠার প্রণোদনা!
তাঁদের ফ্যাশন-স্টাইল সবটাই জ্ঞান আহরণের জন্যে, ইলমের বিকাশের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো।


আমরা আজকের যুগেও কতো কতো স্টাইলের, বাহারি ডিজাইনের ও মডেলের জামা পরি। তিনিও একটা চমৎকার ডিজাইনের জামা পরতেন। তাঁর ডিজাইনটা এমন ছিলো যে, জামার একহাতা চিকন একহাতা দারুণ মোটা! এমনটা দেখে তো মানুষ হতবাক। কেউ কেউ তো এমনটা দেখে হেসে কুটি কুটি হওয়া স্বাভাবিক। কমপক্ষে কৌতূহল তো জাগবেই। সেই কৌতূহল বশতঃ একজন ওনাকে জিজ্ঞেস করেন। জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেন ; একস্থানে লিখিত হাদিসের কপিগুলো রেখে দিই। তাই এমনটা করে রাখা। অন্যটায় রাখি না।


দেখুন, আমরাও কতো কতো স্টাইল কতো কতো ডিজাইনের জামা কাপড় পরিধান করি। আমাদের স্টাইলের উদ্দেশ্য কীভাবে আমাকে একটু আকর্ষণীয় দেখানো যায়, কীভাবে আমাকে একটু স্টাইলিশ আর দুর্দান্ত স্মার্ট হিসেবে ফুটিয়ে তোলা যায় –সেই আকাঙ্খা, সেই কসরত। কিন্তু ওনার উদ্দেশ্য বা এমন একটা জামা তথা এমন পদ্ধতির জামা পরিধানের কারণ কী ছিলো? জ্ঞানটাকে, ইলমটাকে, ইসলামের শিক্ষাটাকে যেনো বহন করা যায়, সংরক্ষণ করা যায় –সেই আকুল আগ্রহ, সেই সুন্দর উদ্দেশ্য! যার কারণে তিনি আজো আমাদের স্মৃতিতে ভাস্বর। আমাদের আলোচনা আর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। যুগ যুগ ধরে তাঁদেরই তো উম্মাহ স্মরণ আর বরণ করে রাখবে! আর পক্ষান্তরে আমাদের সবকিছুই সাময়িক চাকচিক্যের আড়ালে আচ্ছন্ন। সে কারণে দু'দিন ভবে থেকে অতঃপর যখন হারিয়ে যাই –তখন আর বেশিদিন কেউ স্মরণ রাখে না। মানুষের স্মরণে বরণীয় হয়ে থাকি না।


কতো কতো সুন্নাহ, কতো কতো ফরজ আমল আমরা হেলায় হারিয়ে ফেলি! কিন্তু তিনি একটু সামান্য সুন্নাহও ছাড়তেন না। শুনা যায় একবার তিনি নদী পার হচ্ছেন। নদীর ধারে এসে পৌঁছাতেই একটু দূরে নদীর ওপর একজন মাঝি হাঁচি দিলো। হাঁচির পরে আলহামদুলিল্লাহ বলাটা তো সুন্নাহ। সেই মাঝি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহটা আমল করলেন। তা শুনে ফেললেন ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ। এই যে শ্রবণটা, এটা শ্রবণের পরে জাওয়াব দেয়াটাও একটা সুন্নাহ। তিনি যেহেতু কিছুটা দূরে, তাই তাঁর দেয়া জাওয়াব মাঝি শুনতে পাবে কি পাবে না তা নিয়ে তিনি পড়েলেন সংশয়ে। তিনি তাঁর সেই সংশয় না রেখে আল্লাহর রাসুলের এই সুন্নাহ'র ওপর আমল করতে আবারো একটা নৌকা ভাড়া করলেন। ভাড়া করে তিনি মাঝির কাছে গিয়ে হাঁচির জাওয়াব –ইয়ার হামুকাল্লাহ- দিয়ে এসেছেন! সুবহানাল্লাহ!!


তাঁর শরীরের মাঝে শহীদের তপ্ত খুন প্রবাহিত। তাঁর পূর্বপুরুষ ইমরান। তিনি যুদ্ধসঙ্গী হিসেবে আলী ইবনে আবি তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সঙ্গী হয়ে সিফফিনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। সেই যুদ্ধে তিনি শহীদ হয়ে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেন। তাঁর মাঝেও ছিলো তেমনিভাবে সত্য আর ন্যায়ের প্রতি অবিচলতা। ইসলাম বিরোধী, বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে তিনিও ছিলেন সোচ্ছার! সে সময় একটা ভ্রান্ত ইসলাম বিরোধী ফিরকা মাথা ছাড়া দিয়ে ওঠে। তাদের ভ্রান্তি তারা ছড়িয়ে দিতে লাগলো। সত্য আর ইসলামের একনিষ্ঠ সৈনিক ও সাধক ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ তাদের ভ্রান্তির বিরুদ্ধে কলম সৈনিক হিসেবে, বুদ্ধিদীপ্ত তারকা হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। জাগিয়ে তুললেন, সচেতন করে তুললেন জনসাধারণকে। এরপর থেকে সেই বাতিল ফিরকাটি আর কখনো মাথা ছাড়া দিয়ে ওঠতে পারে নি!


রাজা-বাদশাহ্ কিংবা শাসকদের আনুকুল্যের জন্যে নিজের ব্যক্তিত্ব আর আত্মমর্যাদাবোধকে, ইলমে হাদিসকে বিসর্জনও দিতেন না। তাঁদের আনুকুল্য পেতে, দয়াদাক্ষিণ্য পেতে যে-ই সে-ই আবেদন অনুরোধ ও আদেশ গ্রহণ করে নিতেন না! যাঁদের আনুকল্যের জন্যে, সোহবতের জন্যে পুরোটা দুনিয়া মুখিয়ে থাকে, তাদের আবার অন্যের দিকে, অন্যের থেকে আনুকল্য পাবার দরকারই বা কী!

একবার দেখা যায় বসরার বাদশা আবু আহমেদ আল মুআফফাক ওনার সাথে সাক্ষাৎ, কথাবার্তার জন্যে তাঁর কাছে হাজির হয়েছেন। তিনি সম্মান আর মর্যদার সাথে বসরার সেই শাসককে গ্রহণ করেছেন। কারণ, দায়িত্ব প্রাপ্তদের সম্মান করাটাও ইসলামের শিক্ষা। তাদের হককে গ্রহণ আর অসুন্দরকে বর্জনই ইসলামের নীতি। তো ওনাকে বসরার শাসক তিনটি প্রস্তাব করলেন। এক, ওনাকে বসরায় গমাণ করে সেখানকার অধিবাসীদের ইলম শিক্ষা দেয়াটা। তাঁরা তো মুখিয়েই থাকেন আল্লাহর নবীর বাণী সমূহকে চারদিকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে। মানুষের মাঝে দ্বীনের বুঝকে সমুন্নত করার জন্যে! তাই তিনি তা গ্রহণ করলেন। বরণ করলেন। হাসি মুখে। আনন্দের সাথে। দ্বিতীয়ত যে প্রস্তাব করেছে তা হলো যে, তিনি তাঁর সন্তানদেরও ইলমে হাদিস শিক্ষা দিবেন। এবং তাদেরকে অন্যান্যদের সকলের সাথে নয় –আলাদা। তিনি শেষোক্ত বিষয়টি গ্রহণ করলেন না। সাফ জানিয়ে দিলেন –সম্ভব নয়। আল্লাহর কালাম, এবং তাঁর রাসুলের বাণীকে শিক্ষা দিতে তিনি কোনো ব্যবধান তৈরি করতে চান না। পারবেন তা করতে তিনি। সকলকেই সমভাবে দায়িত্বশীলতার সাথে আল্লাহর বাণী ও রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষাটা বিলিয়ে দিয়ে যাবেন। আবু আহমেদ আল মুআফফাক মেনে নিলেন তা। এমনই করে আমাদের ইমামগণ শাসকদের প্রভাবিত করতেন। তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হতেন না। বিসর্জন দিতেন না নিজের আত্মমর্যাদা সামান্য কিছু দুনিয়াবি পাওয়নার জন্যে! প্রয়োজনে তাঁদের বিরাগবাজনও হতেন। হাসি মুখে সয়ে নিতেন নির্যাতন। শতো নিষ্পেষণ। অথচ আজকে আমরা করছিটা কী!!ভাবার বিষয়....

বাল্যকাল থেকেই প্রজ্ঞাবান আর ভীষণ স্মৃতি শক্তি শক্তির অধিকারী ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহকে হাকিম (তথা প্রজ্ঞাবান) উপাধিও প্রদান করা হয়েছে।
৪৮০০ হাদিস, ৩৪টি অধ্যায় এবং ১০৮০ পরিচ্ছেদ নিয়ে সংকলিত হাদিস গ্রন্থটি ছাড়াও তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন নাসিখ মানসুখের মতো কঠিন বিষয় নিয়ে এবং স্বওম ও স্বলাতের ওয়াক্ত নিয়েও!


হাদিস সংগ্রহ আর শিক্ষার উদ্দেশ্য তৎকালীন সময়ের প্রায় সকল স্থানেই ভ্রমণ করেছেন। তবে প্রাথমিক শিক্ষার পরে দশ বছর বয়সে ভর্তি হন মুহাম্মদ ইবনে আসলাম রহিমাহুল্লার কাছে। এছাড়াও শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন আহমদ ইবনে সালিহ, ইসহাক ইবনে ইব্রাহিম, ইসহাক ইবনে রাহওয়াই, ইয়াহয়া ইবনে মাঈন, আলী ইবনুল মাদীনী, কুতাইবা ইবনে সাঈদ প্রমুখদের।

আর ছাত্র হিসেবে পেয়েছেন আব্দুর রহমান আন- নাসা'ঈ,আহমদ ইবনে সালমান, মুহাম্মদ ইবনে ঈসা তিরমিজি পটরমুখদের।


আশ্চর্যজনক সত্য হলো যে, আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এর কিছু উস্তাদ এবং তিনি নিজেও ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ থেকে হাদিস বর্ণনা, গ্রহণ ও বর্জন করেছেন।

তিনি যখন তাঁর গ্রন্থখানি সমাপ্তি করলেন, তখন তৎকালীন সময়ের আরেকজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক আস-সাগানী ( রহ.) বলেন –আল্লাহ দাউদ আলাইহিস সালামের জন্যে যেভাবে যেমন করে লোহাকে নরম ও সহজ করে দিয়েছেন, তদ্রূপ ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ'র জন্যেও হাদিসের ভাণ্ডারকে সহজ করে দিয়েছেন।


হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজালি রহিমাহুল্লাহ বলেন – কারো কাছে যদি পবিত্র কুরআন, এবং ইমাম আবু দাউদ রচিত "সুনান" গ্রন্থখানি থাকে তা হলে এ দুটোই তাঁর ইলম অর্জনের জন্য যথেষ্ট! ক্ষণজন্মা এই মহা মনীষী ১৫ শাওয়াল মতান্তরে ১৬ সাওয়াল ২৭৫ হিজরী সনে ৭৩ বছর বয়সে বসরা নগরীতে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আর তাঁকে সমাহিত করা হয় ইমাম সুফিয়ান সাওরি রহিমাহুল্লাহর নিকেটই। সিজিস্তানে। আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআ'লা এই মহান ইমামের জীবনের সকল খিদমাহ্'কে স্বদাক্বায়ে জারিয়া হিসেবে কবুল করুন। আমীন!


||ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ-||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

[কপি করা নিষেধ, সংকলকের পক্ষ থেকে অনুমতি নেই ]


Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ