||ইমাম ইবনে মাজাহ রহিমাহুল্লাহ ||

 





তিনি শুধু মুহাদ্দিস নয়। ছিলেন ইতিহাসবিদ এবং একজন বিদগ্ধ মুফাসসিরও।


ইসলামের ইতিহাসে বা ইসলামের কোনো রেফারেন্সে মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হবার মতো কাউকে তেমন দেখা যায় না। শুধু ঈসা ইবনে মারিয়াম আঃ ছাড়া। ঈসা আলাইহিস সালাম তো জন্ম হয়েছেন পৃথিবীর কোনো পুরুষের ছোঁয়া ছাড়া। তাঁর দুনিয়ায় আগমনের মাধ্যমই ছিলো মা! এর বাহিরে মায়ের সাথে সংযুক্ত কোনো ব্যক্তি, সে পরিচয়ে বেড়ে ওঠার মতো কোনো মানুষ আর আমার চোখে পড়ে না। ব্যতিক্রম তিনি।

তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনীন উসমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে বিজিত, প্রখ্যাত সাহাবী বারা ইবনে আজিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাসিত
বর্তমান ইরানের ‘কাযভীন ’ অঞ্চলের ‘রাব’ঈ’ গোত্রে ২০৯ হিজরী/৮২৪ খৃষ্টাব্দে। ইবনে মাজাহ নামে সারাটা পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর কাছে সমধিক পরিমাণে পরিচিত তিনি। কিন্তু তাঁর প্রকৃত নাম মুহাম্মাদ, পিতার নাম ইয়াযীদ, উপনাম আবু আব্দুল্লাহ, উপাধি আল-হাফিযুল কাবির, নিসবতী নাম আর-রাবঈ, আল-কাযভীনী। তাহলে পুরো নাম হলো ‘আল-হাফিযুল কাবির আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াযীদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মাজাহ আর-রাবঈ আল-কাযভীনী (রহ.)।


এখন এই যে ইবনে মাজাহ'র মাজাহটা। এটা কারো কারো মতে না, মায়ের অংশ না। তাই মায়ের পরিচয় নিয়ে উনি পরিচিত না। কারো মতে তা বাবার নাম, কারো মতে দাদার। কিন্তু মুহাদ্দিস শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী রহিমাহুল্লাহ তাঁর রচিত ‘বুসতানুল মুহাদ্দিসীন’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, মাজাহ ছিলো তাঁর মায়ের নাম।

বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। ছয় বছর বয়সে। ভালো একজন ক্বারী( তিলাওয়াতকারি) এবং মেধাবী ছাত্র হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে গড়ে ওঠেন তিনি। পরের বছরই আলকুরআন হিফয সম্পন্ন করতে সক্ষম হন।


কারো কারো মতে অল্প বয়সেই পিতৃহীন হয়ে পড়েন। তাঁর মা-ই তাঁকে পরবর্তীতে বাগদাদে প্রেরণ করেন। একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্যে। জ্ঞান আহরণ করে একজন যুগ শ্রেষ্ঠ কালজয়ী আলিম হবার জন্য। তিনিও নিজের সর্বোচ্চ সাধনা আন্তরিকতা নিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। হাদিসের প্রতি তাঁর সুতীব্র জোঁক ছিলো। মাত্র দু'বছরের মধ্যেই লাখের ওপর হাদিস আত্মস্থ করেন।

তাঁর এতো এতো হাদিস আত্মস্থ করার বিষয় উস্তাদগণ জানতে পারেন। তাঁরা তাঁর পরীক্ষা নেবার জন্যে মনস্থির করেন। তিনিও প্রস্তুত হয়ে যান পরীক্ষার মুখোমুখি হবার জন্যে। জ্ঞানের ভবন যারা বয়ে বেড়ায় তারা কি আর পরীক্ষাকে ভয় পায়? পাননি তিনিও। পরীক্ষার মাধ্যমেই তো একজন আদর্শের ছাত্রের মূল্যায়ন ফুটে ওঠে।

শুরু হলো শিক্ষকদের প্রশ্ন। একের পর এক প্রশ্ন জুড়ে দিচ্ছে ওনার প্রতি। হাদিসের পর হাদিস জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তাকে। তিনিও জবাব দিচ্ছেন। এক দাঁড়ানো অবস্থায়-ই মুখস্থ শুনিয়ে দিলেন ২০ হাজার হাদিস।


অনেকদিন পরে আবারও ডাকলেন। প্রায় তিন বছর পরে। আবারও পরীক্ষার মুখোমুখি তিনি। জ্ঞানের পরীক্ষা। হাদিস কতোটুকু আয়ত্তে আছে, সেটার পরীক্ষা। এবার তিনি ওনাদেরকে হাদিস শুনালেন। একেবারেই ভিন্ন রকমে। ইসলামের মৌলিক স্তম্ভ সমূহের ওপর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে। ঈমান, সালাত,সিয়াম, হাজ্জ যাকাত –ইত্যাদির ওপর যে হাদিস সমূহ আছে, সেগুলো। শিক্ষকরা তো বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গেছে! অথচ তাঁরা ওনাকে এভাবে পাঠদান করেন নি! তারা তাঁর এমন দারুণ রকমের বুদ্ধি মত্তা দেখে যারপরনাই আনন্দিত হলেন। খুশি হলেন।


এরপর নেমে পড়লেন হাদিস সংকলনের উদ্দেশ্য নিয়ে ময়দানে। আল্লাহর রাসুলের মুখনিঃসৃত অমিয় বাণী সমূহ সংগ্রহ করতে নানান দেশে নানান জনপদে ছুটে যেতে লাগলেন। সংগ্রহ করে হাদিসগুলো রাখতেন জামার আস্তিনে। নানা জায়গায়ই যেহেতু ঘুরতে হতো, যেতে হতো– সেহেতু পথ তো পাড়ি দিতে হতো খুবই দীর্ঘ! পথিমধ্যে রাত হতো। হয়রান হতো। আর সে সময় সেখানে যদি আশেপাশে মাসজিদ পেতেন, মাসজিদে ঢুকে পড়তেন। ইতিকাফের নিয়্যাতে। আর বসে বসে সেগুলো দেখতেন। আত্মস্থ করার চেষ্টা করতেন। কখনো কখনো আশেপাশে মাসজিদের সন্ধান পেতেন না। বসে পড়তেন বা সময় যাপন করতেন গাছের নিচে। সেখানেই বসে বসে চর্চা করতেন হাদিসের। রাবিদের নিয়ে, রিজালশাস্ত্র নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। ২৩০ হিজরি সনেই তিনি তাঁর এই সফরে নেমে পড়েন। ইরাক, বসরা, কূফা, বাগদাদ, হেজায, মক্কা, সিরিয়া, মিশর ইত্যাদি নানান অঞ্চলে সফর করে দ্বীনি ইলম অর্জনের পর,রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী সমূহ সংগ্রহ করার পরে তিনি ৩৭ টি অধ্যায় এবং দেড় হাজার পরিচ্ছেদ বিশিষ্ট একখানা সুনান গ্রন্থ রচনা করেন। এই যে এমন মহৎ একটা কর্ম, এই কর্মটার পেছনে তাঁকে অনুপ্রেরণা যিনি যুগিয়েছেন তিনি হলেন তাঁরই একজন শিক্ষক আবু যুরাহ আর রাযি (রহ.)।


তিনি গ্রন্থটি রচনা সম্পন্ন হবার পরেই তা পাঠিয়ে দেন তাঁর শিক্ষক আবু যুরাহ আর রাযি (রহ.) এর নিকটে। তিনি খুবই খুশি হন। আর ধরিয়ে দেন বিচ্যুতিগুলো। করে দেন সংশোধন। প্রদান করেন মহামূল্যবান মতামত।


তিনি তাঁর গ্রন্থটিকে দীর্ঘ একটি ভূমিকা দিয়ে আরম্ভ করেছেন। হাদিস শাস্ত্রের ছাত্রগণ অবশ্যই জানেন যে, সেখানে দ্বীনের মূলনীতি, তাওহীদ ও সুন্নাতের মহত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ভূমিকার মধ্যেই তিনি প্রায় ২৩৭ টি হাদিসের সমাবেশ করেছেন । এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যেই অন্যান্য সুনান গ্রন্থ থেকে আলাদা একটা বিশেষত্ব দান করেছে।


ইমাম ইবনে মাজাহ রহিমাহুল্লাহ কোনো মাযহাবের অনুসারী ছিলেন না বলে অনেকেই মনে করেন। তবে তাঁর ফিক্কহী মাসআলায় ইমাম শাফেঈ, আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর সাদৃশ্য পাওয়া যায়।


তার অসংখ্য উস্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’লেন- হাফেয আলী ইবনু মুহাম্মাদ আত-তানাফিসী, জুরারাহ ইবনুল মুগাল্লিস, মুসয়াব ইবনু আব্দুল্লাহ আয-যুবাইরী, আবু বকর ইবনু আবু শাঈবা, হিশাম ইবনু আম্মার, আব্দুল্লাহ ইবনু যাকওয়ান আল-মুকবেরী। এমন বহু মুহাদ্দিছের নিকট থেকে তিনি হাদিসের পাঠ নিয়ে হাদিস সংগ্রহ করলেও সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন আবু বকর ইবনু আবু শাঈবার (রহ.) নিকট।



তাঁর ছাত্রবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন–
ইবরাহীম ইবনু দিনার আল-হাওশাবী, আহমাদ ইবনু ইবরাহীম আল-কাযভীনী (তিনি হাফেয আবু ইয়া‘লা আল-খলীলীর দাদা), আবুত তাইয়্যেব আহমাদ ইবনু রাওহিন আল-বাগদাদী আশ-শা‘রানী, মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা আছ-ছাফফার প্রমুখ।


শুধু হাদিস গ্রন্থই না। তিনি সেসময়ে আরো কিছু স্মরণীয় কালজয়ী কিছু কাজও করে গেছেন। পূর্বেই বলা হয়েছে যে তিনি একাধারে একজন ঐতিহাসিক এবং মুফাসসিরও বটে। তাঁর সেই তাফসির গ্রন্থটির নাম কিতাবুত তাফসির, এবং তারিখুল কামিল নামক একখানা ইতিহাস গ্রন্থও রচনা করেছেন।


২৭৩ হিজরীর ২২ রামাযান মোতাবেক ২০ নভেম্বর ৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে সোমবার এই আলোর প্রদীপটি পৃথিবীর মাঝ থেকে নিভে যায়। (ইন্নালিল্লাহি ও-ইন্না ইলাইহি রাজিউন!) পরের দিন মঙ্গলবার তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।

এই মহান হাদিসের পণ্ডিতের মৃত্যু নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত থাকলেও নির্ভরযোগ্যতা উপরিউক্ত বর্ণনাতেই বেশি পাওয়া যায়!


তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন স্বীয় ভাই আবু বকর এবং কবরে লাশ নামান তার ভাই আবু বকর ও আবু আব্দুল্লাহ এবং স্বীয় পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াযীদ (রহ.)।


আল্লাহ ইমাম ইবনে মাজাহ রহিমাহুল্লাহর সকল কর্মকে কবুল করুন। জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান বানিয়ে রাখুন। আমীন।


||ইমাম ইবনে মাজাহ রহিমাহুল্লাহ ||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ