-| তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেন|-
তাঁকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। প্রবল অসহায়ের মতো আর্জি পেশ করে বললেন ; আল্লাহকে ভয় করো! আমি তোমার থেকে বাঁচতে চাই। আমার সম্রম-সম্মানের নিরাপত্তা চাই! তুমিও নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দা। তুমি সেই আল্লাহকে ভয় করো। এমন অন্যায় করতে পারো না তুমি! স্ফুট-অস্ফুট স্বরে এমন আরো কী কী যেনো বলে যাচ্ছেন তিনি!
আল্লাহর নামের সম্মানার্থে জিবরাঈল আলাইহিসসালাম কিছুটা পিছু সরে গিয়ে বললেন – না না! এমন কিচ্ছু
হবে না তোমার! আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার জন্যে শুভসংবাদ নিয়ে এসেছি। তোমাকে একজন
পূত্র সন্তান দান করবো। এই সংবাদটি নিয়েই আমি এসেছি আজ তোমার কাছে।
জীব্রাইল আলাইহিস সালাম থেকে সংবাদটা শুনেই হতচকিত হয়ে ওঠলেন তিনি। কীভাবে
সম্ভব তা! কীভাবে...!! বুকটা তাঁর কেঁপে
কেঁপে ওঠলো যেনো!! তাঁর মগজের ভাঁজে ভাঁজে যেনো এ-ই জিজ্ঞাসা – কীভাবে আমার ছেলে হবে? কীভাবে? আমাকে তো কস্মিনকালেও কোনো পুরুষ স্পর্শ পর্যন্ত করে নি। না
হয়েছে আমার বিয়ে! না আমি ব্যভিচারিণী!
কীভাবে হবে আমার সন্তান? কীভাবে?
জিবরাঈল আলাইহিসসালাম শান্ত অথচ দৃঢ়তার সাথেই মজবুতভাবে জবাব দিলেন– হ্যাঁ, এটাই হবে! এভাবেই হবে। তাঁর জন্যে সবই সহজ।
তিনি সবই পারেন। স-অ-ব! তিনি পিতা ব্যতীত তোমাকে সন্তানের মা বানাতে চান এই জন্যে
যে– তিনি তাঁকে সৃষ্টি জগতের জন্যে,
সকল
মানুষের জন্যে এক নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। এরমাধ্যমে তোমার প্রতিও
অনুগ্রহ করতে চান।
যেহেতু সীদ্ধান্তটা আল্লাহর। সেহেতু আর কোনো কথা চলে না এখানে। তিনি যা-ই চান
তা-ই করেন। তা-ই হয়! চুপচাপ হয়ে গেলেন তিনি। কিচ্ছু বললেন না আর। কিচ্ছু না!
জিবরাঈল (আঃ) তাঁর বুকে ফুঁকে দিলেন রূহ। আল্লাহর নবি ঈসা আলাইহিস সালামের রূহ।
যাঁর কথা এতোক্ষণ বললাম, তিনি আর কেউ না।
ঈসা আলাইহিসসালামের মাতা মারইয়াম আলাইহিস সালাম। তিনি ছিলেন বাইতুল মাকদিসের
তৎকালীন একজন সম্মানিত ইমাম ইমরান ইবনে লাখাম এবং হান্না বিনতে ফাকুদের বহুল
আকাঙ্খিত সন্তান। সাধনার ধন। তাঁরা নিঃসন্তান। বয়স হয়ে গেছে যথেষ্ট পরিমাণ। বৃদ্ধ
প্রায় তাঁরা। কিন্তু কোনো সন্তান নেই বিধায় আল্লাহর কাছে তাঁরা একজন সন্তান চাইতে
লাগলেন।
একদিনের ঘটনা। ইমরানের স্ত্রী হান্না বিনতে ফাকুদ একটি গাছের তলায় বসে আছেন।
হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়লো একটা পাখির দিকে। গাছের ডালে পাখিটির ডিম হতে একটা বাচ্চা
ফুটলো। ফোটবার সাথে সাথে সে কিচিরমিচির শব্দ করা শুরু করলো। মা পাখিটি বাচ্চাটিকে
বুকের মাঝে আগলে নিলেন। খাবার নিয়ে তাকে
খাবার খাওয়াতে লাগলেন। এই দৃশ্য দেখেই হান্না বিনতে ফাকুদের মায়াবী-মাতৃত্বপূর্ণ
মন হাহাকার করে ওঠলো। শুধু একটা সন্তানের জন্যে!
তিনি আল্লাহর কাছে কাঁদতে লাগলেন খুব করে। বললেন –হে আল্লাহ! আমাকে একটা সন্তান দান করুন। আমি সেই সন্তানটাকে
তোমার রাস্তায় চালাবো। বাইতুল মাকদিসের খিদমাহ্'য় তাঁকে নিবেদিত করবো।
আল্লাহ তাঁর ডাক শুনলেন। কিন্তু বাঁধলো বিপত্তি। ছেলে হলেই তো তাঁর কৃত নিয়তের
পূর্ণতা পেতো।হয়েছে মেয়ে। তাঁর নাম রেখেছেন মারইয়াম। কিন্তু নিয়ত যে তাঁরা করেছেন, তার কী হবে! অবশেষে তাঁরা ঠিক করলেন মারইয়ামকেই
বাইতুল মাকদিসের খিদমাতে নিবেদিত করবেন। করেছেনও।
বাইতুল মাকদিসে তাঁকে দেয়ার পরে তিনি নিবিষ্ট মনে ইবাদতের মধ্যে ডুবে থাকতেন।
সারাক্ষণ আল্লাহর স্মরণে মশগুল হয়ে থাকতেন। নির্দিষ্ট একটি কক্ষে। একদিন তিনি সেই
কক্ষ থেকে পূর্ব দিকে একটু আড়ালে চলে গেলেন। ইবাদতের জন্যে। কিংবা গোসল করার
জন্যে। কারো কারো মতে তাঁর একটি ক্ষেত ছিলো,
সে
ক্ষেতে পানি দেবার জন্যে।
পূব দিকে যাওয়ার সাথে সাথেই জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখতে পেলেন। দেখেই তো তো
ভড়কে গেলেন। ভাবলেন হয়তো কোনো মানুষ কোনো বদ ইচ্ছে নিয়ে এসেছে ওনার কাছে। কাহিনিটা
তো শুরুতেই বলা হয়েছে।
তিনি এখন আল্লাহর ইচ্ছায় গর্ভবতী। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লেন!
মানুষকে কী জবাব দেবে! মানুষ কী বলবে! অপবাদকারীরা অব্যাহত অপবাদ আরোপ করে তাঁর
পবিত্র জীবনকে কলুষিত করবার ফন্দি আঁটবে। করে তুলবে তাঁর জীবঙ্কে দুর্বিষহ। আসোলে
মানুষ তো কখনো দেখেও নি পিতৃ ছাড়া সন্তান হতে! মানুষের কাছে বিষয়টা বললে তারা তো
বিশ্বাস করবেন না! কিন্তু....! কিন্তু এখন কী করবেন তিনি -ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছেন
না কোনো!
চলে গেলেন তিনি আল্লাহর নবি এবং তাঁর খালু জাকারিয়া আলাইহিস সালামের স্ত্রীর
কাছে (কারো কারো মতে তিনি তঁর খালাতো ভাই)। সব তাঁকে খুলে বললেন। একেবারে সব।
তিনিও তো আল্লাহর নবির স্ত্রী। তাঁর
সুমহান কুদরাতে তিনিও এখন গর্ভবতী। অথচ তিনি বন্ধ্যা। তাই তিনি সহজেই ওনাকে
বিশ্বাস করলেন । পরম মমতায় বুকে টেনে নিলেন। সাহস দিলেন। অনুপ্রেরণা দিলেন। যেনো
আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে অটল - অনড় ও অবিচল হয়ে পরীক্ষাটা সামাল দিতে
পারেন। যেনো তাঁকে বুঝাতে লাগলেন- ভয় পেয়ো না, ভেঙ্গে পড়ো না,
আল্লাহর
ওপর আস্থা রাখো, বিশ্বাস রাখো, ধৈর্য ধারণ করো; আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা অবশ্যই পাবে, আল্লাহ তোমাকে একা ছেড়ে দেবেন না। সাহায্য না
করে থাকবেন না। তিনি যেনো প্রাণ পেলেন। ধূসর মরুভূমিতে এক ফোটা বৃষ্টি পেলে যেমনটা
হয়; তেমন-ই।
মাঝেমধ্যেই এখন তাঁরা দুজন মিলিত হয়। কিন্তু যাকারিয়া আঃ এর স্ত্রীর অনুভবে এক
অদ্ভুত বিষয় ফুটে ওঠে। তিনি তাঁর নিজ গর্ভের সন্তানটি মারইয়াম আঃএর গর্বভের
সন্তানের দিকে যেনো মাথাটা নুইয়ে দেয়। বুঝতে পারলেন তিনি- মারইয়ামের বড়ো আর মহৎ
কেউ হতে যাচ্ছে !
কিন্তু তিনি এখানে থাকা আর নিরাপদবোধ করলেন না। সত্যিই এই
স্থানে বসে থাকা, থেকে ইবাদাত করা
তাঁর জন্যে মটেও নিরাপদ হবে না। এখানের মানুষগুলো বিষয়টা জানতে পারলে তাঁর
জীবনকে বিষিয়ে তোলার সব আয়োজন করবে। তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন, সিদ্ধান্ত নিলেন — আর থাকবো না এখানে, বসবো না এই আংগিনায়, আল্লাহর ইচ্ছের
কাছেই যেহেতু সমর্পিত হয়েছি; তাই তাঁর ইচ্ছে বাস্তবায়নের আগ অবধি কোনো
তিরস্কারের তীরে বিদ্ধ হতে চাই না। চাই না হতে দুর্নামের দুর্বিপাকে বিপর্যস্ত হতে
। ব্যথাভরা অন্তর নিয়ে, বেদনায় ভারাক্রান্ত
দেহো-মন নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ধীরে ধীরে গিয়ে পৌঁছলেন বাইতুললাহ্মে।
হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। একা একা। সাথে নেই কেউ। নিঃসঙ্গ। শুরু হলো
প্রসব বেদনা। ভীষণ বেদনায় অস্থির তিনি। তাঁর চোখ-মুখে যেনো প্রবল যন্ত্রণার
কাতরানি ফুটে ওঠেছে। নিজেই যেনো নিজেকে জিজ্ঞেস করছছেন—কই যাবো? কোথায় যাবো? আমার আশ্রয় কোথায়? কার কাছে গেলে আমি এখন একটুখানি আশ্রয় পাবো? কার কাছে! পিপাসিতও তিনি। পিপাসায়ও বুকের ছাতি
ফেটে যাবার জোগাড় যেনো! আর চলে না কদম তাঁর। আশ্রয় নিলেন একটা খেজুর বাগানে। বসে
পড়লেন সেই গাছের তলায়। সেখানেই। কিন্তু
ব্যথা-যন্ত্রণা তো কমছে না। কাতরাচ্ছেন তিনি!
কেউ কি সহায় নেই ! তাঁর মন ঠেলে
প্রশ্নগুলো যেনো উঁকি দেয় —আমি মানুষ ক্যান ! মানুষ এমন ক্যান! ক্যান পৃথিবীতে এলাম! আমি যদি এই ভীষণ একটা কঠিন
পরীক্ষা থেকে উত্তীর্ণ হতে পারতাম! আমি কি পারবো? নাকি ভুল করে ফেলবো! তাঁর মনে শুধুই জিজ্ঞেসা! ভাবেন —হায়, আমি যদি নিফাসের একটি নেকড়াও হতাম, মানুষের স্মৃতি থেকে যদি আমি মুছে যেতাম।
মানুষ যদি আমাকে ভুলে যেতো। এই দিন,
এইক্ষণ
আসার পূর্বেই যদি আমি মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে যেতাম....!!
আমার সাহায্যকারী এখানে কে! কীভাবে আমি একটু মুক্তি পাবো! এমন নির্জনতায় সাহায্য পাবো? কীভাবে তা সম্ভব হবে? কীভাবে? কেউ কি আসবে? দূর থেকে কেউ
একজন যেনো বলে ওঠলো, হতাশ হবেন না। মন
ভাঙবেন না! অসম্ভবের কিছু নেই! আপনি পুরুষ
ছাড়া, স্বামী ছাড়া গর্ভবতী
হয়েছেন—আল্লাহ সেই অসম্ভবকে যেহেতু সম্ভব করেছেন ; এটাও করবেন।
একটু দূরে, আঁখির আড়ালে ছিলেন তিনি আজ।
তাঁর সতীত্ব আর পবিত্রতার প্রতি শ্রদ্ধার সর্বোচ্চটুকুনই যেনো তিনি ঢেলে দিয়ে বলতে
লাগলেন — আললা তাহযানী! আপনি চিন্তিত
হবেন না। অত্যধিক চিন্তা করে, চিন্তার কোলে ঢলে পড়ে হতাশ
হওয়া আপনাকে মানায় না! আপনার আশেপাশে কেউই নেই, কোনো
উপায়-উপাদান নেই, মানুষ আপনার পবিত্রতা-সতীত্বের ওপর মন্দ
ধারণা করবে, আপনার ওপর অপবাদ আরোপ করবে, দুর্নাম রটিয়ে বেড়াবে—এসব নিয়ে কোনো দুঃখ আর আফসোস করবেন না। শক্ত হোন,
শক্ত থাকুন। মন ভাঙবেন না! পাশেই ফিরে দেখুন, আপনার পদতলে ঝরনা সৃষ্টি করা হয়েছে। মিঠে পানির ঝরনা। আপনি পিপাসার্ত। ওখান
থেকে পানি পান করুন। মনের কোণে জমে থাকা বিষণ্ণতা, শরীরে
প্রতিটি অস্থিতে এঁটে থাকা ক্লান্তি আর দুর্বলতা সব কেটে যাবে! আপনি আবারও সতেজ হয়ে ওঠবেন!
এতোক্ষণ বলে যাওয়া কথাগুলো তিনি শুনলেন৷ কন্ঠটা পরিচিত মনে হচ্ছে তাঁর কাছে। ভীষণ
পরিচিত! ওপাশ থেকে তিনি বলেই যেতে লাগলেন,
আপনি আনন্দিত থাকুন। আল্লাহর তরফ থেকে এই যে এখানকার দেয়া
অনুগ্রহ, সেই
অনুগ্রহের আনন্দ, অনাগত এক মর্যদাবান সন্তানের জননী হবার আনন্দ! উপযুক্ত আর প্রিয়
বান্দাদের থেকেই আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন পরীক্ষা নেন। আপনি তাঁর প্রিয় আর বাছাইকৃত
বান্দী হবার মতোন
যে এক মহা সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, সেটার জন্যেও শুকরিয়া আর
কৃতজ্ঞতা আদায় করুন। তাঁর বন্দনা করুন। কন্ঠটা এবার সুস্পষ্টই বুঝতে পারলেন তিনি।
এ-তো রুহুল আমীনেরই কন্ঠ! পূর্বেও তাঁর কাছে নিজস্ব আকৃতিতে এসেছে। পুত্র হবার
সংবাদটা তো ইনি-ই
দিয়ে গেছেন।
তিনি মনে
মনে যেনো বলেন ; কিন্তু
সবই তো বুঝলাম, মানুষ
আমাকে জিজ্ঞেস করবে। প্রশ্ন করবে। আমি কী জবাব দেবো, কী
বলবো — এই প্রশ্নটা যেনো তাঁর মগজ
উতরে উতরে বের হতে চায়। প্রশ্নটার প্রচ্ছন্ন একটা চাপ তাঁর চেহারায়ও যেনো
সুস্পষ্টরূপে ফুটে আছে। কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের তরফ থেকে সে-ই উত্তরটাও জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরই প্রধান ফেরেশতা
জিবরাঈল (আঃ)! তাঁকে ( মারইয়াম আঃ-কে) বলা হোলো — তোমার কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। এর দায়িত্ব
সম্পূর্ণ আল্লাহর। তিনিই এর সমাধান করবেন। কারো আপত্তি আর অভিযোগ-অনুযোগের দিকে
কর্ণপাত না করে তুমি ধৈর্য ধারণ করতে থাকবে। প্রশ্ন করলে চুপ থাকবে। তাদের জানিয়ে দেবে
— আমি রোজাদার। আল্লাহর
উদ্দেশ্যে আমি মৌনতার নীতি অবলম্বন করলাম। করলেনও তিনি তাই। এক পর্যায়ে তিনি মা হয়েই গেলেন।
গর্ভের সন্তান এলেন দুনিয়ায়। শিশু ঈসা (আঃ)-এলেন পৃথিবীর জমীনে। তাঁকে নিয়ে
কাঁপাকাঁপা বুকে রওয়ানা হলেন নিজ জনপদের উদ্দেশে।
মারিয়ামের
কোলে শিশু ঈসা (আঃ)-কে দেখেই তাদের চক্ষু চড়কগাছ! তাদের কেউ কেউ তাঁর নামে মিথ্যের
সর্বোচ্চ মিসাইল নিক্ষেপ করতে লাগলো। অপবাদ ছড়াতে শুরু করে দিলো। ছড়িয়ে দিলো যে— বায়তুল মাকদিসের খাদিম ইউসুফের সাথে মারিয়াম
অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। (নাঊযুবিল্লাহ)! অথচ ইউসুফ নিজেও ছিলেন একজন বড়োই আল্লাহ
ভীরু মানুষ। মারিয়াম (আঃ) যখন গর্ভবতী হলেন, সেটা তিনিও টের
পেলেন। তখন তিনি অত্যন্ত জড়োসড়ো হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন;
আচ্ছা বলুন তো মারিয়াম, বীজ ছাড়া কি গাছ
হয়? গাছ বিহীন কি ফল হয়? মূলত
মারিয়াম ( আঃ)- এর তাক্বওয়া, পরহেজগারিতা, ইবাদাত-বান্দেগী তো তিনি সচক্ষেই দেখেছেন, তাই
ভয়-ভদ্রতা, বিনয়-নম্রতার সবটুকুন ঢেলে দিয়ে তিনি প্রশ্নটা
করলেন। মানুষ তো, মানুষের মনেই প্রশ্ন জাগে। তাঁর মনে জাগ্রত
সেই প্রশ্নও মারিয়াম ( আঃ)-ও সর্বোচ্চ সুন্দরপন্থায় জবাব
দিলেন —"হ্যাঁ, বীজ ছাড়াও গাছ হয়, গাছ ছাড়াও ফল হয়"
— এরপর মানুষটি আর দ্বিতীয় কোনো
প্ররশ্ন করলেন না । মেনে নিলেন, চলে গেলেন পরিপূর্ণ
বিশ্বাসেভরা হৃদয় নিয়ে। এমনই একজন নিষ্পাপ পবিত্র মানুষকে নিয়ে তাকে জড়িয়ে এমন
ভয়াবহ অপবাদ জড়িয়ে দিলো— ভাবতেই তাঁর চোখযুগল ছলছল করে
ওঠেছে যেনো। বাস্তবে তো মানুষের তা-ই হয়।
একজনের পর
একজন আসতেছে ওনার কাছে, দলে দলে। উৎসুক নেত্রে চেয়ে চেয়ে বলতে লাগলো ; এ-কি মারিয়াম। এ-করলেটা কী তুমি! তোমার নিকট তো
এরকম কিছু প্রত্যাশিত ছিলো না। আমরা তো তোমাকে অনেক, অনেক ভালো জানি! এ- তুমি কীভাবে করলে? না তোমার বাবা কোনো অসৎ মানুষ ছিলো, না ছিলো
তোমার মা কোনো
ব্যভিচারিনী নারী। তাঁরা তো ছিলেন ফরহেজগার মানুষ। তাহলে কীভাবে তুমি এমনটা করলে?
কীভাবে! বলো, জবাব দাও —তিরস্কার আর প্রশ্নবাণে জর্জরিত তিনি। কনো
কথায়-ই তাঁর মুখ থেকে বের হতে চায় না যেনো। তবুও তাদের মুখে তো আর কুলুপ এঁটে দেয়া
যায় না। তিনি দেখিয়ে দিলেন তাঁর কোলের ছোট্ট শিশু ঈসাকে। জবাব যা দিবে এই শিশুই
দিবে— মনে মনে এই ভাবনা তাঁর। কিন্তু তারা হতবাক
হয়ে বলতে লাগলো; এ-কি
বলো মারিয়াম ! এই বাচ্চা শিশুর সাথে আমরা কী বলবো? ও-আমাদের
কী জবাব দেবে! কীভাবে সম্ভব তা? কিন্তু আল্লাহ তো যা চান
তা-ই করেন। তিনি-ই তো অসম্ভবকে সম্ভব করেন!
তাদের সবগুলো কথায়-ই তিনি শুনতে পেলেন। শিশু ঈসা (আলাইহিস সালাম) তখন
দুগ্ধপানরত। সচকিত
হয়ে ওঠলেন তিনি ! আল্লাহ সুবহানাহু ওতা'আলা তাঁর জবান
খুলে দিলেন। তাদের সকলের উদ্দেশেই তিনি বলে ওঠলেন— আমি আল্লাহর বান্দা। আমাকে নবি হিসেবে প্রেরণ করা
হয়েছে। আমাকে কিতাব দেয়া হয়েছে। তোমরা যা বলো , তা অসত্য।
অন্যায়। অপবাদ। মিথ্যে । আমার জন্মে কোনো অপবিত্রতা ও অপরাধ থাকতে পারে না! আমাকে
বরাকাহ'র অধিকারী। রব্ব তাঁর বরাকাহ'র বারিধারায় আমাকে সিক্ত করেছেন । আমাকে আমার রব্ব তাঁর ইবাদত-দাসত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। স্বলাত ও
যাকাত আদায়ের আদেশ দিয়েছেন। যতোদিন বাঁচি পৃথিবীতে, ততোদিন।
আমাকে (আমার বাবা যেহেতু নেই) মায়ের প্রতি অনুগত্যশীল করেছেন এবং তিনি আমাকে
অহংবোধ লালনকারী ও হতভাগ্য হিসেবে সৃষ্টি করেন নি! জন্মের সময় আমাকে শয়তান
স্পর্শ করতে পারে নি। আমি পূর্নরূপে নিরাপদ ছিলাম। অনুরূপভাবে মৃত্যুর সময় ও পুনরুত্থানের সময়ও
আমাকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না ইবলিস। সে- সময়ো আমি থাকবো নিরাপদ । আমি আল্লাহর
সৃষ্ট বান্দাদের মধ্য হতে একজন। অন্যান্য সৃষ্টির মতো আমিও জীবন-মৃত্যুর আওতাধীন।
সকলের মতো আমিও পুনরুখিত হবো। শেষ বিচারের দিন আমাকেও তাঁর আদালতে হিসেব-নিকেশ
দিতে হবে। একটানা কথাগুলো তিনি বলেই গেলেন। কথা বলার সুযোগ পেয়েই তিনি যেনো তাঁর
জন্মের পবিত্রতার পাশাপাশি সকলকেই আরো কিছু জানিয়ে দিলেন যে ; আমার প্রতি প্রবল বিশ্বাস-ভালোবাসা থেকে তোমরা যেনো আমাকে মানুষ এবং
আল্লাহর বান্দা ও নবির বাহিরে ভিন্ন কিছু, অধিক কিছু বানিয়ে
ফেলো না! যারা এতোক্ষণ প্রশ্ন তুলেছে যে, শিশুটির সাথে
কীভাবে কথা বলবো। শিশুও বা কীভাবে আমাদের সাথে কথা বলবে? তাদের
মুখে যেনো তালা এঁটে গেলো। প্রবল বিস্ময়ে তাঁরা “থ” বনে গেলো।
এভাবেই
আল্লাহ সুবহানাহু ওতা’আলা মারিয়াম আলাইহিস সালাম ও ঈসা
আলাইহিস সালামের দ্বারা প্রমাণ করে সকল বিশ্বাসী ও বিশ্ববাসীর সম্মুখে প্রমাণ
কোঁড়ে দেখিয়ে দিলেন যে তিনি সকল অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। তিনি বললেই হয়ে যায়—কুন ফা-ইয়াকু-ন ! তিনি যা-ই চান তা-ই পারেন।
বাচ্চা শিশুর জবান দ্বারা
বড়োদের মতো স্পষ্টরূপে কথা বলাতে পারেন। স্বামী-পুরুষের সংস্পর্শ ছাড়া একজন নারীকে
“মা” বানাতে পারেন। আনাতে পারেন দুনিয়ায় সন্তানও। অমুক-তমুক কেউ-ই
অসম্ভবকে সম্ভব করার ন্যূনতম ক্ষমতা-ও রাখে না। অসম্ভবকে সম্ভব করেন শুধুই আল্লাহ
তা’আলা।
-| তিনি অসম্ভবকে
সম্ভব করেন|-
~রেদওয়ান রাওয়াহা
Comments
Post a Comment