।। বলবো সদা 'ইন শাআল্লাহ' ।।
আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম চিন্তিত। ভীষণ চিন্তিত! ভীষণ!! মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত প্রায়। মুশরিকরাও তাঁকে নিয়ে যেনো উপহাসের ঢালি সাজিয়ে বসেছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বার্তাও আসছে না তাঁর কাছে। আসছে না জিবরাঈল আলাইহিস সালাম কোনো প্রকার ওহী নিয়ে। একদিকে মক্কার কাফির-মুশরিকদের অব্যাহত ঠাট্টা বিদ্রুপ, অন্যদিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী আসা বন্ধ— এভাবেই চলতে লাগলো দিন। যেতে লাগলো সময়।
একটানা পনেরো দিন অতিক্রান্ত হবার পর আল্লাহর তরফ
থেকে নবী ﷺ-এর কাছে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম হাজির হলেন ওহীসহ। দূর হলো আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লামের পেরেশানি ও অস্থিরতা।
আচ্ছা, কেন এমনটা হলো আমাদের প্রিয় নবীর (সা.) সাথে? এর কারণ হচ্ছে— আল্লাহর রাসূল যখন ইসলামের সুমহান বাণী যখন মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিচ্ছেন, ঠিক তখন থেকেই মুশরিকরা তাঁকে নানাভাবে নিবৃত করার প্রচেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের কোনো প্রচেষ্টা, কোনো প্রলোভনেই তিনি সাড়া দিলেন না। এই যখন অবস্থা, তখন তারা আল্লাহর রাসূলকে থামিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক সাপোর্টের জন্য দ্বারস্থ হলো ইয়াহুদিদের। ইয়াহুদিদের কাছে গিয়ে তারা সবিস্তারে সবকিছুই বর্ণনা করলো। ইয়াহুদিরা তাদেরকে তিনটে প্রশ্ন শিখিয়ে দিলো। সে তিনটে প্রশ্ন হচ্ছে এই—
১. আসহাবে কাহফ কারা ছিলেন?
২. খিযিরের ঘটনাটির তাৎপর্য কী?
৩. জুলকারনাইন কে ছিলেন?
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে আরেকটি বর্ণনা পাওয়া যায়। যেখানে আবার প্রশ্নগুলো ভিন্নভাবে এসেছে। আর তা হলো—
১. আসহাবে কাহফ কারা ছিলেন?
২. ওই ব্যক্তির কথা বলুন যিনি পূর্ব ও পশ্চিম পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন?
৩. রুহের স্বরূপ কী?
রাসূলে কারিম ﷺ তাদের প্রশ্নগুলো শুনে জবাব দিলেন এই বলে যে— আগামীকাল এসো। তখন জবাব দেবো। এই যে আগামীকাল এসো, তখন জবাব দেবো। এখানে তিনি একটি শব্দ বলতে ভুলে গিয়েছেন। আর সে শব্দ হলো— ইন শা আল্লাহ। যার মানে হলো ‘আল্লাহ চাহে তো’। এই শব্দটা তথা ইন শা আল্লাহ বলতে বিস্মৃত হবার কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা তাঁর নবী’র (ﷺ) প্রতি ওহী অবতরণ বন্ধ করে দিলেন। একেবারে টানা পনেরোটা দিন। আরো তা এমন একটা সময়, যখন তিনি মুশরিকদের একটা বড়োসড়ো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
পরেরদিন যখন মুশরিকরা আল্লাহর রাসূল ﷺ এর কাছে কোনো জবাব পেলো না, তখনই তারা আনন্দের আতিশায্যে উদ্বেলিত হতে লাগলো। তারা ভাবতে লাগলো, এইবার বুঝি মুহাম্মাদকে কোণঠাসা করা গেলো। এইবার বুঝি তার মুখ চিরতরে বন্ধ করা গেলো। তাদের ভেতর সে-কি নিদারুণ উৎফুল্লতা!
মুহাম্মাদ ﷺ আসোলে কোনো নবী-রাসূল নয়, তিনি ভণ্ড, মিথ্যেবাদী (আস্তাগফিরুল্লাহ)— এখন থেকে মানুষের কাছে প্রমাণ করা যাবে, তাঁর ইমেইজকে ছোটো করা যাবে; এই ছিলো তাদের ভাবনা। এই ছিলো তাদের চিন্তা এবং প্রচারণা।
কিন্তু এই প্রচরণাটি ধোপে টিকলো না। হলো না বেশিদিন স্থায়ী। আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর কাছে পনেরোদিন পরে ওহী অবতীর্ণ করলেন। তাঁর হয়ে যাওয়া ভুলটা সংশোধন করে দিলেন এবং সাথে সাথে মুশরিকদের করা তিনটে প্রশ্নেরও জবাব দিয়ে দিলেন। পবিত্র কুরআনুল হাকিমে বিষয়টি এভাবেই এসেছে — “আর কখনই আপনি কোনো বিষয়ে বলবেন না, ‘আমি এটা আগামীকাল করবো, (ইন শা আল্লাহ) আল্লাহ ইচ্ছে করলে’ এ কথা না বলে (বলবে না কাজটা করবো।) আর যদি ভুলে যান তবে আপনার রবকে স্মরণ করবেন এবং বলবেন, ‘সম্ভবত আমার রব আমাকে এটার চেয়ে সত্যের কাছাকাছি পথ নির্দেশ করবেন।[-সুরা কাহাফ-২৩-২৪]”।
এই যে 'ইন শা আল্লাহ'। এর অর্থ হলো— আল্লাহ চাহে তো। আমরা যখন ভবিষ্যতে কোনো কিছু করার ইচ্ছে পোষণ করি, তখন এই কথার-ই স্বীকৃতি দেই যে, আমার দ্বারা কিছুই হবে না। যদি আল্লাহ চান তা হলে হবে। তিনি যদি না চান, তাহলে হবে না। হবার কোনো সম্ভাবনাও নেই। তবে এ 'ইন শা আল্লাহ' বলতে হবে বৈধ কাজকর্মে।
‘ইন শা আল্লাহ্’ বলার মানে হলো আমি বিষয়টা আল্লাহর কাছে সঁপে দিলাম। আমার কাজের দায়ভার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে তাঁর দয়া-অনুগ্রহ আর করুণা প্রত্যাশা করছি। তাঁকে স্মরণ করছি।
আমরা আমাদের কোনো কাজ শুরু করার আগে যদি আল্লাহকে স্মরণ করি, তাহলে তিনি খুশি হন। আর যে কাজে স্বয়ং আমাদের রব আল্লাহ খুশি, সে কাজে তো তিনি বারাকাহ দিয়ে ভরপুর করে দিবেনই।
এই যে কাজ-কর্মে আল্লাহর স্মরন, এই স্মরনের মাধ্যমে তাঁর বান্দা হিসেবে তাঁর প্রতি আমাদের বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ পায়। আর আমরা বান্দা হিসেবে আমাদের রবের প্রতি বিনয়-নম্রতাসমেত সিজদায় পড়ে থাকা উচিত নয় কি? হররোজ নিজের মালিক মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লাকে খুশি করার চিন্তা-চেতনা লালন করা দরকার নয় কি? অবশ্যই দরকার। কিন্তু আসোলে আমরা সেরকমটা কি করি? আমার অভিজ্ঞতা বলে, আমরা অধিকাংশই
মনে হয় করি না।
আমরা প্রত্যাহিক জীবনে কতোজনকে কতো কতো প্রতিশ্রুতিই তো প্রদান করি, হররোজ কতোজনের সাথে সাক্ষাৎ-এর কথা বলি, অসংখ্য স্বপ্নে বোনা কাজকারবারের কথা বলি। সে সবে আসলে কয়বার 'ইন শা আল্লাহ' বলি? কয়বার আল্লাহকে স্মরণ করি? কতোটুকু বিনয় আর নম্রতা প্রকাশ করি ?
এই যে আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে এতো এতো স্বপ্ন আঁকি, এতো এতো কথা বলি, কতোজনকে কতো প্রতিশ্রুতি দিই ভবিষ্যতের জন্যে— তো সে অনাগত সময় অবধি বেঁচে থাকবো বা সে সবের বাস্তবায়ন করতে পারবো; এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে কি আমাদের?
আমরা যদি একটু চিন্তা করে দেখি যে, মুহাম্মাদ স্বল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম ছিলেন তাঁর মনোনীত একজন শ্রেষ্ঠ বান্দা ও রাসূল। তিনি শুধু জীবনে একবারই ওয়াদা দেওয়ার ক্ষেত্রে 'ইন শাআল্লাহ' বলতে ভুলে যাওয়ায় আল্লাহ তা'আলা পনেরো দিন ওহী পাঠানো বন্ধ রাখলেন। মুশরিকদেরকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও বিজয়ী আচরণ করে মুহাম্মাদ সল্লালাহু আলাইহি ওসাল্লামকে নিয়ে উপহাসের একটা সুযোগ করে দিলেন। আমরা তো দেখা যায় শতকরা নব্বইটা কাজেই 'ইন শা আল্লাহ' বলি না।
আসলে আমাদের কোনো কাজই বাস্তবায়ন হবে না যদি তিনি না চান। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন—
“তোমাদের কোন ইচ্ছা বাস্তবে রূপ নিবে না, যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।’’[সূরা আত-তাকভির : ২৯]।
তাহলে চলুন, সব-সময়ই সব কাজে আল্লাহর ইচ্ছের কাছে নিজেকে সঁপে দিই। কোনো কাজ ভবিষ্যতে করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করলেই ‘ইন শা আল্লাহ’ বলি।
।। বলবো সদা 'ইন শা আল্লাহ'।।
~রেদওয়ান রাওয়াহা
০৯.০৭.২১
Comments
Post a Comment