"আলিমরা কি সবকিছুকেই হারাম হারাম ফতোয়া দেয়?"
০১.
এখানে আমি একটা গল্প দিয়ে বিষয়টা শুরু করতে চাই। সেটা হচ্ছে —একটা টীমের বলাররা বা একজন বলার নিয়মিত নো-বল করে। ওয়াইড বল করে। এখন আম্পায়ারও প্রতিবারই নো-বল বলে তার ডিসিশন জানায়। তখন উক্ত প্লেয়ার আম্পায়ারের ওপর চেতে গিয়ে বা রাগ করে বলে যে— শুধু নো-বল নো-বল ডিসিশন দিয়ে (পড়ুন, শুধু হারাম হারাম ফতোয়া দিয়ে) দায়িত্ব শেষ করেন ক্যান? বিকল্প দেন না ক্যান? বিকল্প দেন। শুধু হারাম হারাম বলা ছাড়া (নো-বল সিদ্ধান্ত দেওয়া ছাড়া) আর কিছুই তো করেন না আপনারা বা আপনি।
উক্ত ভদ্র(!) প্লেয়ার এটা বুঝেতে চেষ্টা করেনা যে, আম্পায়ারের দায়িত্ব তাকে বা তার টীমকে বিকল্প দেওয়া নয়। আম্পায়ারের কাজ হচ্ছে যে খেলতে নেমেছে মাঠে, এরপর বল হাতে বল করতেছে, তা কী আইসিসির নিয়মানুযায়ী হচ্ছে নাকি হচ্ছে না— তা খেয়াল রাখা। তার বল নিয়ম অনুযায়ী হলে ভালো। না হলে আম্পায়ার নো-বলই দেবে। এটাই আম্পায়ারের মূল এবং নৈতিক দায়িত্ব! বরঞ্চ আম্প্যায়ার যদি মূল দায়িত্ব পালন না করে, নো-বল করার পরেও ডিসিশন না দেয়, তাহলেই বরং আম্পায়ারের সমালোচনা করা উচিৎ ছিলো। কিন্তু যে নিয়মিত নো-বল করতেছে, যে নিয়মিত নিয়ম লঙ্গন করতেছে, এটা ঠিক না করে সে দোষারোপের দলা নিক্ষেপ করতেছে আম্পায়ারের ওপর। চেত যাচ্ছে দায়িত্বরত বিশেষজ্ঞগণের ওপর। অথচ তার বা তার টীমের উচিৎ ছিলো বল ঠিকমতো করা। ভুল শোধরানোর চেষ্টা করা।
হুবহু প্রায় একই কাহিনী দেখা যায় উম্মহর মাথার তাজ আলিমদের ব্যাপারে। কিছু কিছু মানুষ উম্মাহর মাথার তাজ আলিমদের বিরুদ্ধে ঢালাও একটা অভিযোগ করে, বিভিন্ন সময়, তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ চর্চা করে বলে যে— "মোল্লারা সব কিছুতেই শুধু হারাম হারাম বলে বেড়ায়। বিকল্প দেয় না, বা এইরকম আরো নানবিধ কথাবার্তা।"
এখন উক্ত শ্রদ্ধেয় ভাই-বোনেদের নিকট আমার প্রশ্ন—
আলিমগণ হারাম ঘোষণা করবে না তো আপনি-আমি করবো? উম্মাহর মাথার তাজ আলিমগণই তো হারাম হলে হারাম ঘোষণা করবেন আর হালাল হলে হালাল বলবেন। আলিমরা হারাম ঘোষণা না করলে কে করবে?
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আপনি আমি সবসময়ই হারাম কাজ করে যাবো, কিন্তু উম্মাহর মাথার তাজ আলিমগণ হারাম কাজকে হারাম বলতেও পারবে না? আপনি হারাম কাজ করলে ক্ষতি নেই, আর তারা হারামকে হারাম বললেই ক্ষতি হয়ে যায়?
এরপর হলো গিয়ে, হারামের বিকল্প দিতে পারেনা আলিমরা— যুক্তির খাতিরে মানলাম, কিন্তু হারামের বিকল্প দিতে না পারলে কি হারামকে হারাম বলবে না আলিমরা? আর সবকিছুর বিকল্প কি আসলেই হয়? আসলেই কি সবকিছুর বিকল্প আছে? হারামের বিকল্প তো স্রেফ হালালটাই। হারামের বিকল্প তো হারাম হতে পারে না।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরোধিতা করতে হলে কি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনেই ডুবে যেতে হবে? আলিমরা উম্মাহর শ্রেষ্ট সন্তান। তাঁরা উম্মাহর পথপ্রদর্শক। তাঁরা আমাদের আমজনতার ভুল হলে ভুলটা ধরিয়ে দিবেন। এটাই তো হওয়া উচিৎ। এখন ভুল ধরিয়ে দিলে কাউকে হিংসুক-বিদ্বেষী না ভেবে কি আমরা শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে পারি না? ভুল ধরিয়ে দেওয়া আর মিথ্যাচার করা, চরিত্র হনন করা, বিদ্বেষ চর্চা করা কি এক? ভুলকে ভুল বললে (আপনাদের যুক্তিতে) শরয়ী সমাধান হয় না বুঝলাম, কিন্তু ভুলকে ভুল না বলে কি ভুলকে ফুল বললে শরয়ী সমাধান হয়? আপনার দাবি অনুযায়ী আলিমরা বিকল্প দেন না, অথবা দিতে পারেন না ঠিক আছে। এটা তাদের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা, মানলাম। কিন্তু বিকল্প দিতে না পারার কারণে বুঝি তারা যেটা ভুল, যেটা হারাম, সেটাকে হারাম বা ভুল বলবে না?
আমরা সকলেই ভুল করি। আমরা সকলেই অপূর্ণাঙ্গ। কিন্তু আমরা নিজের ভুলের জন্য, আমাদের নিজের অপূর্ণাঙ্গতার জন্যে কি দ্বীনকে বিকৃতি করবো?
০২.
আমরা আদম সন্তান। আমাদের ভুল হয়। পাপ হয়। অনেক সময় আমরা দীন পালন করতে পারি না। সম্ভব হয় না। আমরা দীন পালন করতে না পারি, কিন্তু দীনকে বিকৃত করবো না। দীন না পালনের অক্ষমতা-দুর্বলতা আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন চাইলে, কিন্তু বিকৃতির কাজকে ক্ষমা নয়। বিকৃতি করলে, আল্লাহর বিধান অস্বীকার করলে, হারামকে হালাল বলে চালিয়ে দিলে কখনো কখনো ঈমানও ভঙ্গ হতে পারে। আর কোনো গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার স্বার্থে, কোনো ব্যক্তিকে খুশির করার উদ্দেশ্যে, অথবা নিজের নফসের খায়েশ মেটাবার জন্য আল্লাহর দীনকে মনমত ব্যাখ্যা করা, এর বিধান পরিবর্তন করার চেষ্টা করা, হারামকে হালাল বলে চালিয়ে দেওয়াটা কিন্তু ইহুদি ও খ্রিস্টানদের স্বভাব। মুসলমানদের নয়। আল্লাহর বিধানকে নিজের খায়েশ মতো ব্যাখ্যা করার কাজ পোপদের ইতিহাস, আলিমদের ইতিহাস নয়। কিছু মুখোশধারী আলিম কখনো এটা করলেও হকপন্থী আলিমরা সেটা প্রতিহত করেছেন যুগে যুগে।
০৩.
একজন মুসলিমের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ তাঁর ঈমান। আলিমরা আমাদের এই সম্পদেরই রক্ষণাবেক্ষণ করার কাজ করেন। এই কাজ করতে গেলে তাদের যে ভুল হয় না, বিষয়টা এমন নয়। তাদেরও কখনো কখনো ভুল হয়। কিন্তু ভুলের চেয়ে তাঁদের মোটাদাগে ভালো কাজের পরিমাণই বেশি। ভুলের চেয়ে তাদের ফুলের পরিমাণই বেশি।
০৪.
বিকল্প দেয় না কেন আলিমরা—এ কথা যারা বলেন, তাঁরা আসলে এটা ভাবে না যে, আলিমদের হাতে এখন কোন ক্ষমতাটা আছে? আলিমরা বৈশ্বিকভাবেই বৈরিতার শিকার। আলিমরা বিকল্প দিতে পারে না, কিন্তু অন্তত আপনাকে এখনো কোনটা হালাল-কোনটা হারাম; এটা তো জানাতে পারতেছে। এরজন্যেও তো কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আলিমরা শুধু হারাম হারাম বলে, বিকল্প দেয় না। বিকল্প কি আলিমরা দেবে? নাকি স্বয়ং আল্লাহ নিজেই বিকল্প দিয়ে রেখেছেন? হারাম রিলেশনের ( বিয়ে বহির্ভূত প্রেম ভালোবাসা, যিনা-ব্যাভিচার) বিকল্প হিসেবে আল্লাহ নিজেই বিয়ে দিয়ে রেখেছেন। সুদের বিকল্প হিসেবে দিয়ে রেখেছেন ব্যবসা। অনেকে বলেন সুদের বিকল্প করজে হাসানা, এটা মোটাদাগে সত্য নয়। কুরআন বলছে সুদ হারাম। ব্যবসা হালাল— আহাল্লাল্লাহুল বাইয়া ওহাররামার রিবা اَحَلَّ اللّٰهُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ( সূরা বাকারা : ২৭৫)।
এভাবে সত্য হালাল। মিথ্যা হারাম। খেলা হালাল। জুয়া হারাম। সতর ঢাকা ফরজ। লঙ্ঘন করা হারাম। হামদ-নাত হালাল। শিরকপূর্ণ গান হারাম। সংগীত হালাল। বাদ্যযন্ত্র হারাম। এভাবে আল্লাহ সবকিছুরই বিকল্প রেখে দিয়েছেন। সবকিছুর। আপনি কেবল আপনার নফসের খায়েশ মেটাবার জন্য যেগুলো আল্লাহর দীনে নিষিদ্ধ, এমন বিষয় আশয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিকেই হালাল বানাতে চান। কিন্তু আপনার খায়েশের পথে প্রতিবন্ধক হচ্ছে আলিমরা। সে কারণেই আপনি তাদের প্রতি এতোটা ক্ষুব্ধ। এই হলো সত্য কথা। এছাড়াও আরেকটা কথা হলো, আলিমরা তো কথিত বিকল্পের প্রয়োজন বোধ হয়তো করেন না; সে কারণে তারা বিকল্প দেন না। কিন্তু আপনি তো বিকল্পের প্রয়োজন বোধ করেন। তাহলে আপনারই তো কাজ ছিলো বিকল্প নিয়ে আসা। যেটা হালাল হবে।
০৫. আপনি যদি ইতিহাসের দিকে তাকান, দেখবেন — আজকের ইউরোপীয় সভ্যতাসহ অন্যান্য সবকিছুর ওপর যখন ইসলাম বিজয়ী ছিলো, তখন কিন্তু আলিমদের একটা আলাদা বড়ো মাপের মর্যদা ছিলো। সর্বশেষ অটোম্যান বা উপমহাদেশীয় মোগল আমলেও কিন্তু আলিমদের আলাদা কদর করা হতো। তাঁরা বিচারক ছিলো। সমাজের প্রভাবক শক্তি ও নিয়ন্ত্রণক ব্যক্তি ছিলো। শাসকের নানান কাজে তাঁরা প্রভাব ফলাতে পারতো। কিন্তু এখন আজ শত বছেরর ওপর থেকে ইসলাম পরিপূর্ণ পরাজিত। ইসলামের ধারক-বাহক আলিমগণ সম্মানিত তো নয়-ই, বরং সামাজিকভাবে কোথাও কোথাও অনেকটা নিগৃহীতই। আবার নিগৃহীত না হলেও অবমূল্যায়িত। রাষ্ট্রীয়ভাবেও তাঁরা এই অঞ্চল-সহ সারা বিশ্বে চরম অবহেলিত। তবুও আলিমগণ উম্মাহর মুক্তির জন্যে মানবতার শান্তির জন্যে দিকে দিকে সংগ্রামী কেতনকে উড্ডীন করেছেন বহুবার। ঔপনিবেশিক বর্বর বৃটিশদের নাগপাশ থেকে মানুষদের স্বাধীনতার জন্যে আলিমগণ নিজেদের তপ্ত লহু বারংবার ঢেলে দিয়েছেন। ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলেছেন। জেলে গিয়েছেন। নির্বাসনে গিয়েছেন। আর আপনার মতো আলিম বিদ্বেষীরা কী করেছে? ইংরেজদের দালালি করেছে। তাদের কেরানি হিসেবে চাকরি করেছে। তাদের দালালি করে সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে।
আজকের দিনেও যেখানে আমাদের সাধারণ জনতা এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের ধারক-বাহকদের থেকে তাদের দর্শন মেনে, তাদের সেবা দিয়ে রাজার হালে চলাফেরা করছে, বা করে যাচ্ছে; সেখানে আলিমগণ মসজিদ-মাদরাসার খিদমত করে নামকাওয়াস্তে সামান্য বেতন দিয়ে নিজে চলছে, নিজের পরিবারকেও চালাচ্ছে। সাথে সাথে ইলমের নুরকেও প্রজ্জলিত করে রাখতেছেন। আমাকে আপনাকে দ্বীন-ঈমান শেখাচ্ছেন। তিনশত বছর থেকে এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের কাছে পুরোপুরিভাবে ইসলামের ক্ষমতা হারানোর পরেও যতোটুকুন ইসলাম টিকে আছে, আপনি যতোটুকুন দীন জানছেন, ঠাণ্ডা মাথায় দেখবেন এর পেছেনে সম্পূর্ণ ভূমিকাটাই ওলামায়ে কেরামের।
আজকে যারা চাইনিজ হোটেলে বসে বসে বা বাসে করে সিলেটে ট্যুর দিয়ে, কিংবা ট্রেনে করে দার্জিলিংয়ে সফর করে, অথবা এরোপ্ল্যানে করে সুইজারল্যান্ড-নরওয়ে-গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভ্রমণ করে করে আলিমদের নির্মম সমালোচনা করছেন, তারা নিজেরাও কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই আলিমদের মাধ্যমেই দীনের আলোটুকু পেয়েছেন। যতটুকু আছে আরকি তাদের ভেতর।
আলিমরা এখন যেহেতু ক্ষমতাহীন, তাই তাঁরা যদি সবকিছুর কথিত বিকল্প থেকেও থাকে, তবুও তা দিতে সক্ষম নয়। কারণ তাঁরা আজ পরাজিত। কিন্তু তাঁদের দীনকে রক্ষা করার, কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক তা বলার দায় আছে। দায়িত্ব আছে। তাঁরা স্রেফ তাঁদের বোধ-বিশ্বাসের আলোকে দায়টুকু দায়িত্বটুকুন পালন করে যাচ্ছেন। এটা আপনি ইচ্ছে হলে মানবেন, না-ইচ্ছে হলে মানবেন না, আপনি এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের কাছে মগজ বিকিয়ে দিয়ে এলিট ক্লাস নাগরিক বনে থাকবেন —কিন্তু এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের দাসত্ব করতে গিয়ে ওলামায়ে কেরামের নিষ্ঠুর সমালোচনা করবেন না। তাঁদের ভুলগুলো টেনে আপনার ভুলগুলোকে ফুল প্রমাণ করতে যাবেন না। এটা ঠিক নয়। আলিমরা মজলুম। সারা দুনিয়ায় মজলুম। মজলুম বিদ্বেষ আল্লাহ সইবে না।
~রেদওয়ান রাওয়াহা
২৮.০৬.২২ ইং
Comments
Post a Comment