প্রাধান্য পাবে যে.....

 

 


মানুষগুলো যখন চূড়ান্ত গোমরাহি আর ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত, ঠিক তখন-ই আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা মানুষকে সতর্ক-সচেতন করার জন্যে, ভ্রষ্টতার পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে পাঠালেন রহমাতাল্লিল আলামিন মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাইহি ওসাল্লামকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা তাঁকে এই বিষয়টিই পবিত্র কালামুল্লাহর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়ে বলেন—“আর হে নবি, আমি তোমাকে পুরো মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা এবং ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে পাঠিয়েছি।   আর তিনিও তাবলিগ-তালিম-তরবিয়তের মাধ্যমে মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসার অদম্য চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। প্রতিদিনই তাঁর তাবলিগ-তালিম চলছেই কোথাও না কোথাও। কোনো না কোনো সভা-সমাবেশে উপস্থিত হয়ে তিনি মানুষের সামনে বক্তৃতার মাধ্যমে দ্বীনের আলো বিতরণের প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন-ই।

 

তেমনি একদিন তিনি মক্কায় একটি সমাবেশে মানুষের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করে বক্তৃতা করছেন। আর সেই সমাবেশে আল্লাহর রাসুলের সামনে উপস্থিত ছিলো ওতবা ইবনে রবীয়া, আবু জাহল ইবনে হিশাম এবং রাসুলুল্লাহ্ স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের মতো মক্কার তৎকালীন জাঁদরেল সব নেতৃবৃন্দ। আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব তখনও ঈমানের পথে আসে নি, করেনি ইসলাম গ্রহন।

 

এসব জাঁদরেল সমাজপতিদেরকে সামনে পাওয়ার বিরাট মওকাটা আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথাযথভাবে কাজে লাগাতে চাইলেন, তাদেরকে দ্বীনের পথে আহ্বান করে। তাদের পেছনে দাওয়াতি কাজ করে। তো সেখানে যখন আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে দাওয়াতি করছেন, এমন সময় অন্ধ একজন সাহাবি এসে আল্লাহর রাসুলের কাছে হাজির হলেন। সেই অন্ধ সাহাবি ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। সম্পর্কে তিনি নবিজির শ্যালক। তাঁর মা উম্মে মাকতুম ছিলেন উম্মুল মুমিনিন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার পিতা খুওয়াইলিদের আপন বোন। তিনি এসে নবিজিকে ডাকতে লাগলেন। এতে তিনি বিরক্তবোধ করলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের দিকে কর্ণপাত করলেন না তিনি। তিনি মনে মনে চাইলেন এটাই যে ওতবা ইবনে রবীয়া, আবু জাহলদের মতো সুস্থ-সবল এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় এবং উঁচু শ্রেণির মানুষেরা যদি ইসলাম গ্রহন করে; তা হলে ইসলামের শক্তিটা আরো দ্বিগুন হবে। কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামিনের নিকট এই বিষয়টা পছন্দনীয় হলো না। তিনি যেনো সাথে সাথেই তাঁর প্রিয় হাবিবকে এই বিষয়টিই বলতে চাইলেন যে আপনি নিজে যেই উঁচু মানের ব্যক্তিত্বের অধিকারী, আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে এই আচরণটা যায় না! যে ব্যক্তি নিজ থেকেই হিদায়াতের পথ, আলোর পথ বেছে নিতে চাইছে, সাগ্রহে দ্বীনের পথ চিনতে চাচ্ছে; তাকে রেখে কেনো আপনি এমন লোকদেরকে সময় দিচ্ছেন যারা আপনার বার্তার গুরুত্ব দিচ্ছে না? আর তখনই আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা নবি করিম স্বল্লালাহু আলাইহি ও'সাল্লামের ওপর ওহী নাজিল করলেন। যেখানে বলা হয়েছে যে সে ভ্রু কুঞ্চিত করলো এবং মুখ ফিরিয়ে নিলো। কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি এলো। তুমি কেমন করে জানবে  সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো। ফলে উপদেশ তার উপকারে আসতো। পক্ষান্তরে যে পরওয়া করেনা, তুমি তার প্রতি মনোযোগ দিয়েছো। অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে তোমার কোন দায়িত্ব নেই। অন্যদিকে যে তোমার দিকে ছুটে এলো, আর সে সশংকচিত্ত, তাকে তুমি অবজ্ঞা করলে। না, এরূপ আচরণ অনুচিত। এ তো উপদেশবাণী। যে ইচ্ছে করবে স্মরণ রাখবে। তা আছে মহান লিপিসমূহে, যা উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন, পবিত্র, মহান, পূত-চরিত্র লিপিকর হস্তে লিপিবদ্ধ। 

 

স্বাভাবিভাবেই আমরা আমাদের সমাজের সমাজপতি, বিত্তশালী, প্রভাবশালীদেরকে আলাদা সম্মান-মর্যদার দৃষ্টিতে দেখি। সাধারণ মানুষদের থেকে তাদেরকে একটু বেশি সমীহ করি, সম্মান দিই। যাদের একাডেমিক রেজাল্ট ভালো, যাদের খুব বেশি ডিগ্রি আছে তাদেরকে অন্যদের চেয়ে আলাদা দৃষ্টিতেই দেখি। একটু বেশিই গণ্য করি। একজন সাধারণ চাকুরিজীবীর তুলনায় উচ্চপদ ধারণকারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমপি-মন্ত্রীকে অত্যধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকি।  আমাদের অনেকে তো আবার এককাঠি বেশি সরেস। যারা উঠতে-বসতে, হাঁটতে-চলতে উচ্চপদস্থ, প্রভাবশালী-বিত্তশালী মানুষদের স্তুতি- প্রশংসা-চাটুকারিতা করতে করতে তাকে পারি না যে সিদরাতুল মুনতাহায় উঠিয়ে দিই!

 

এই যে যশ-খ্যাতি, সম্পদ,পদ-পদবী, বংশ-গোত্র এসবের কোনো মূল্য-ই আল্লাহর কাছে নেই। তাঁর কাছে সম্মানিত শুধু সে-ই, যিনি তাকওয়ার গুণাবলিতে সিক্ত। তাকওয়া ব্যতীত তাঁর কাছে প্রাধান্য লাভের আর কোনো মানদণ্ড নেই। পবিত্র কুরআনুল কারিমে তিনি বলেন—‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাবান; যে অধিক মুত্তাকি বা আল্লাহ ভিরু।

 

আমরা যারা দ্বীনের দিকে মানুষকে ডাকি, তখন আমরাও দেখা যায় সামাজিক অবস্থা, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বিচার করেই মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কোন লোকটা দেখতে কী রকম, কতোটা হ্যন্ডসাম সেইত্যাদি হয়ে যায় বিবেচ্য বিষয়। যাদের অবস্থান সামাজিকভবে একটু নিচের দিকে; তাদেরকে এড়িয়ে চলি। যারা দেখতে একটু কম সুন্দর বা কম ভালো; তাদেরকে, তাদের কথাবার্তাকে গুরুত্ব দিতে চাই না। তাদের কাছে ভিড়তে চাই না। তাদেরকে এড়িয়ে চলি।

 

তার মানে কি আমরা প্রতাপশালীদেরকে, কিংবা হ্যন্ডসাম-আকর্ষণীয়দেরকে প্রাধান্য দেবো না? দাওয়াত দেবো না? অবশ্যই দেবো। কিন্তু আমাদের কাছে দ্বীনের ক্ষেত্রে, মন থেকে গ্রহন করার ক্ষেত্রে প্রাধান্য সবাই সমভাবে পাবে। বরংএই  সুরার আলোকে বলা যায় যে একজন মাজুর, অসুস্থ, দূর্বল, গরীব মানুষও যদি ইসলামের বিধান জানতে আগ্রহী হয়; তা হলে তিনি বা তাঁরাই আমাদের কাছে বেশি প্রাধান্য পাবেন। এ কথা সত্য যে আমরা বাছাই করে যদি নেতৃস্থানীয়, প্রভাবশালী মানুষদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত দিতে পারি, এবং সে-সকল মানুষ যদি ইসলামে পূর্ণভাবে প্রবেশ করে; তা হলে ইসলামের শক্তিটা আরেকটু বেড়ে যাবে। দ্বীনকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনটা আরো বেগবান হবে। কিন্তু যে প্রভাবশালী বা নেতৃস্থানীয় কিংবা অনেক ডিগ্রির অধিকার খুব মেধাবী ব্যক্তি দ্বীনের দাওয়াতকে ক্রমাগত অবজ্ঞা করে যায়, তা হলে তার পেছনে পড়ে থেকে সময় ক্ষয় করে কোনো লাভ নেই। তারচেয়ে অধিক উত্তম হলো সে মানুষের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা, যে ব্যক্তি সোৎসাহে দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে কজানতে চায়, মানতে চায়। করতে চায় এর বিধানকে বিজয়ী। হোক সে অন্ধ,পঙু, সামাজিকভবে কম গ্রহনযোগ্যতবুও সেই ব্যক্তিই উত্তম। তাঁকেই নসীহা বা সময় দেওয়াটা কিংবা প্রাধান্য দেওয়াটা আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দনীয়।

 

আল্লাহ  রব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় হাবিবকে এই আয়াতগুলো নাজিল করে তাঁকে এটাই জানিয়ে দিয়েছেন যে, আসোলে তিনি তাঁর কাছে ক্যামন আচরণ-ক্যামন ব্যবহার প্রত্যাশা করেন ইসলামের প্রচার-প্রসার-প্রতিষ্ঠার কাজে। এবং এই মানদণ্ডটা-ই সারা জাহানের মুমিন-মুসলিমদের কাছে তিনি প্রত্যশা করেন। কারণ আল-কুরআনের বিধান তো শুধু রাসুল্লাহ স্বল্লালাহু আলাইহি ওসাল্লামের জন্যই আাসেনি। আসছে গোটা মানব জাতির জন্যই। আর সে কারণেই তিনি তাঁর হাবিবকে উদ্দেশ্য করে সংশোধনমূলক আয়াতগুলো অবতীর্ণ করলেন। এখন আমরা যারা দাঈ ইলাল্লাহ হিসেবে আল্লাহর কুরআনের কথাগুলো মানবজাতির কর্ণকুহরে পৌঁছে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বা পৌঁছে দেবার স্বপ্ন দেখি, তারা যেনো বুঝতে পারি বা শিখতে পারি যে এই পরিমাণ বা এরকম আদর্শিক মানদণ্ড  আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের কাছে প্রত্যাশা  করেন। আমরা যেনো অন্যদের তুলনায় তাদেরকেই প্রাধান্য দিই, যে বা যারা স্বপ্রণোদিত হয়ে ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে আগ্রহী। ইসলামের এতোটা কাঙালিপনা হয় নি যে কোনো ব্যক্তি তা থেকে অব্যহতভাবে মুখ ফিরিয়ে নিবে, অবজ্ঞা করবে, আর ইসলামের ধারক-বাহকরা শুধু তাদের পেছনেই পড়ে থাকবে। মানুষের জন্য আল্লাহর এই দ্বীন  একটা নিয়ামাত। এই নিয়ামাতকে যারা হেলায় হারাবে, তাদের থেকে যতো হিসেব-নিকেশ  নিতে হয়, তাদের ব্যাপারে যতো প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হয়; তা তিনিই নেবেন, তিনিই করবেন। পবিত্র কুরআনুলহাকিমে এই বিষয়টা-ই তিনি বলেছেন যে অতঃপর তাদের হিসেব-নিকেশ গ্রহন করা আমারই কাজ। 

 

// প্রাধান্য পাবে যে......//

~রেওদয়ান রাওয়াহা

০৮। ০৭। ২১ ইং

Comments

  1. মা শা আল্লাহ। প্রতিনিয়ত লেখা চাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইন শা আল্লাহ্‌। চেষ্টা করতেছি। দু'আ করবেন

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ