//দ্বীনে দাখিল হও পূর্ণভাবে//
সদ্য ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাঁরা। পূর্বে ছিলেন ইয়াহুদি। তবে ইসলাম গ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে তাওরাতপ্রীতি তখনো রয়েছে বিদ্যমান। তাই তো তাঁরা তখনো উটের গোশত ভক্ষন করছেনা। উটের দুধ পান করা থেকেও রয়েছেন বিরত। এবং শনিবারকে করে যাচ্ছেন বিশেষ তা’জিম। কিন্তু বিষয়টি মুসলামানদের কাছে ভালো লাগছেনা। তাদের এহেন আরো কিছু আচরণ মুসলমানদের নিকট ভীষণ কষ্টদায়ক হয়ে যাচ্ছে। তাই তো তাঁরা এ-বিষয়ে আল্লাহর রাসুলের কাছে অভিযোগ করেছেন। তিনি সব শুনেছেন। সব শুনে সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী নওমুসলিমদের ডাকলেন।
তাঁরা রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম যখন তাদেরকে উক্ত বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, তখন তাঁরা বলেন — “হে আল্লাহর রাসুল, তাওরাত-ও তো আল্লাহরই কিতাব। আর তা ছাড়া আমরা তো খারাপ কিছু করছিনা। আমরা আল্লাহর এক কিতাব দিয়ে অন্য কিতাবকে শক্তিশালী-ই করছি কেবল। তাঁরা আল্লাহর রাসুলের কাছে এই বলে আবেদন করেছেন যে, ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আমরা তো ইসলাম গ্রহণের পূর্বে শনিবার দিনটিকে খুবই তাজিম করতাম। আপনি আমাদেরকে কিছু বিষয়ের অনুমতি প্রদান করুন। আমরা রাতের বেলায় তাওরাত তিলাওয়াত করে যেনো নামাজ করতে পারি, তাওরাতের কিছু বিধিবিধানের আনুগত্য যেনো এখনো করে যেতে পারি! তাঁরা বলে যেতে লাগলো। আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু ল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামও তাদের কথাগুলো চুপ করে শুনে যেতে লাগলেন।
অবশেষে রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লামের কাছে আল্লাহ ওহী অবতীর্ণ করলেন। উক্ত নওমুসলিম সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বিষয়ে, তাদের চিন্তাধারাকে পরিপূর্ণভাবে দ্বীন-ইসলামের প্রতি অনুগত করার আদেশ করলেন। বললেন তোমরা পরিপূর্ণভাবেই আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করো। ইসলামগ্রহণ করার পরে যা আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদিত, যা হালাল, তা মানো। যা হারাম, তা বর্জন করো। এককথায় দ্বীনে দাখিল হও পুর্ণভাবে। আংশিক নয়। বিষয়টি পবিত্র কুরআনে এভাবেই বর্ণিত হয়েছে —হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের কাছে যে নওমুসলিম সাহাবিগণ এসব দাবি নিয়ে আসছিলেন, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ)। সেদিন আল্লাহর এ-আদেশ পাবার পরে তাঁরা তা মেনে নিয়েছেলেন। আনুগত্যের শিরকে পরিপূর্ণভাবে নত করে দিয়েছেন আল্লাহর কাছে। তাঁর হুকুমের কাছে।
শুধু এ-আয়াত না। এমন অসংখ্য আয়াতে কারিমাহ আছে পবিত্র কালামে হাকিমে, যেখানে আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশের আদেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের মাধ্যমে যা আসে, তা বিনাবাক্যে মেনে নিতে আদেশ করেছেন। আর যদি কেউ তা মেনে না নেয়, গ্রহণ না করে, তাহলে তারজন্য কঠিন শাস্তির সংবাদ ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “রাসুল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাকো এবং তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।”
কেউ যদি অনেক আমল করার পরেও দুয়েকটা ক্ষেত্রে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের আনুগত্য পরিত্যাগ করে, তাহলে তার আমলসমূহ বরবাদ হয়ে যাবে। বিনষ্ট হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং রাসুলের আনুগত্য করো, আর তোমরা তোমাদের আমলগুলো বিনষ্ট করো না।”
আল্লাহ এবং রাসুলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের অবাধ্যতার পরিণামে জাহান্নাম-ই হবে তার ঠিকানা। সোজাকথায় রাসুলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের অবাধ্য হওয়া, আল্লাহর আদেশের লঙন করার ফলাফল হচ্ছে জাহান্নাম। বিষয়টি কুরআন মাজিদে এভাবেই এসেছে,
“শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে পৌঁছানো এবং তাঁর রিসালাতের বাণী প্রচারই আমার দায়িত্ব। আর যে- কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।”
“কাজেই যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপদ বা বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
দ্বীনে পরিপুর্ণভাবে দাখিল হবার আরো একটা অন্যতম শর্ত হচ্ছে এই যে, আমরা আমাদের সকল কাজের ফায়সালা একমাত্র আল্লাহ-রাসুলের সামনেই পেশ করবো। এবং নিজেদের ছোটোখাটো ঝগড়াঝাঁটিও । কোনো কাজেই নিজেদের খায়েশের অনুগত হবো না। সকল কাজেই যদি আল্লাহর রাসুলের করে যাওয়া বা দেওয়া সীদ্ধান্ত মেনে না নিই, তাহলে আমরা ঈমানদার হতে পারবো না। পবিত্র কুরআনে এর সমর্থনে আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা বলেন,
“আপনার রবের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের ঝগড়া-বিবাদের বিচারের ভার আপনার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার মীমাংসা সম্পর্কে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।”
এবার তা একজন মানুষ হিসেবে আমার চিন্তার সাথে যাক বা না যাক। আমার পছন্দ হোক বা না হোক। মনঃপুত হলেও মানতে হবে, না হলেও। এবং তা বিনাবাক্য ব্যয়ে মানতে। সোজা কথায় শুনলাম আর মেনে নিলাম। এটাই আল্লাহ তাঁর কালামে পাকে ইরশাদ করেন।
“মুমিনদের উক্তি তো এই, যখন তাদের মধ্যে বিচার-ফায়সালা করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের দিকে ডাকা হয়, তখন তারা বলে, ‘আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য করলাম।’ আর তারাই সফলকাম।”
কিছু অংশ মানলাম আর কিছু অংশ মানলাম না, তা হলে আমরা কখনো আল্লাহর আজাব থেকে রক্ষা পাবো না। আল্লাহ এভাবে ইচ্ছে করে কিছু মানা আর কিছু না মানার ফলাফল স্বরূপ জাহান্নামের আজাবে নিক্ষিপ্ত হবার কথা বর্ণনা করেছেন পবিত্র কুরআন মাজিদে। এবং এই যে দ্বীনের কিছু অংশ মানা আর কিছু অংশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া, এটা একটা বনী ইসরাঈলের ইহুদীদের স্বভাব। তারাও হুবহু একই কাজ করতো। এ-বিষয়ে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন,
“স্মরণ করো, যখন ইস্রাঈল-সন্তানদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো ‘ইবাদাত করবে না, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও দরিদ্রের সাথে সদয় ব্যবহার করবে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করবে, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে ও যাকাত দিবে, তারপর তোমার মধ্য হতে কিছুসংখ্যক লোক ছাড়া তোমরা সকলেই অবজ্ঞা করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো।
যখন তোমাদের প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, তোমরা একে অপরের রক্তপাত করবে না এবং একে অন্যকে স্বদেশ থেকে বহিস্কার করবে না, তারপর তোমরা তা স্বীকার করেছিলে, আর তার সাক্ষ্য দিচ্ছিলে।
তোমরাই তারা যারা অবশেষে একে অন্যকে হত্যা করছ এবং তোমাদের একদলকে তাদের দেশ থেকে বহিস্কার করছ, তোমরা একে অন্যের সহযোগিতা করছ তাদের উপর অন্যায় ও সীমালংঘন দ্বারা এবং তারা যখন বন্দিরূপে তোমাদের কাছে উপস্থিত হয় তখন তোমরা মুক্তিপণ দাও; অথচ তাদেরকে বহিস্কার করাই তোমাদের জন্য অবৈধ ছিল। তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ্বাস কর আর কিছু অংশকে কর অবিশ্বাস? তাহলে তোমাদের যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ও অপমান এবং কেয়ামতের দিন তারা ফিরিয়ে নেয়া হবে কঠিনতম শাস্তির দিকে। আর তারা যা করে আল্লাহ্ সে সম্পর্কে অমনোযোগী নন।
আমরা যেহেতু ঈমান এনেছি। ইসলাম গ্রহণ করেছি। তাই আমাদেরকে ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে অবস্থান করা চাই। আমরা ঈমান সম্পর্কেও সুন্দর এবং স্পষ্ট ধারণা রাখি না। যার কারণে ঠিকমতে ইসলামের বিধানও মানতে পারি না। ঈমান নিয়ে সবচেয়ে চমৎকার একটা কথা বলেছেন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ)। তিনি বলেন, বলেন, ঈমানের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। আর সেটা অর্জিত হবে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ ও সাথে সাথে তাকে আমলে পরিণত করার মাধ্যমে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, শুধু কতগুলো আক্বিদা-মতাদর্শ, কতেক আমল আর আসারের পালনের নাম ইসলাম নয়; বরং ইসলাম হচ্ছে একটি সার্বজনীন স্বীকৃত জীবনব্যবস্থা। ইসলাম তো শুধু ধর্ম নয়, এটা আমরা সকলেই জানি। ইসলাম পরিপূর্ন জীবনবিধান। অন্যান্য ধর্ম স্রেফ ধর্ম, কিন্তু ইসলামের রূপ হলো পূর্ণাঙরূপ। তাই ইসলামের উপস্থিতি থাকবে সর্বত্র। রাষ্ট্র থেকে সমাজ। পরিবার থেকে বিচারালয়। পৌরণীতি থেকে অর্থনীতি, ইসলাম সব জায়গায় সবখানেই কথা বলবে। বলে।
আল্লাহ যেনো আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আমল করার তাওফিক দান করেন। দ্বীনের বিধান মেনে পরিপূর্ণ দ্বীনদার এবং ঈমানদার হবার তাওফিক দান করেন। আমরা ইসলামের মতো এমন সুন্দর নেয়ামত পেয়েও যদি সেটার কদর করতে না পারি, তাহলে এরচেয়ে বড়ো দুর্ভভাগ্য, এরচেয়ে বড়ো হতাশার আর কিছুই হতে পারেনা। আমরা জানি কষ্টের পরেই সাফল্যের স্নিগদ্ধ ছোঁয়া থাকে। ক্ষণিকের এ-দুনিয়ায় যদি কিছুটা কষ্ট মেনে নিয়ে আমরা আমাদের ঈমান এবং আমলের ওপর অটল-অনঢ় থাকতে পারি, আমাদের জীবনের সবদিকেই দ্বীন কায়েম করতে পারি, তাহলে অনন্ত আখেরাতের যে সুখ; সে সুখ কেবলই আমাদের হবে। হ্যাঁ, আমাদেরই ! আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনে পূর্ণভাবে দাখিল হবার তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন !
//দ্বীনে দাখিল হও পূর্ণরূপে//
~রেদওয়ান রাওয়াহা
২৬.১০.২১
Comments
Post a Comment