"প্র্যাক্টিসিং মুসলিম ও দ্বীনে ফেরা মানে কী?"




"প্র্যাক্টিসিং মুসলিম ও দ্বীনে ফেরা মানে কী?"


প্র্যাক্টিসিং মুসলিম, দ্বীনে ফেরা—এ-শব্দগুলো এখন একটা ট্রেন্ডে পরিণত হয়ে গিয়েছে। আল্লাহ আমাদের দ্বীনের ওপরেই জন্ম দিয়েছেন। ফিতরাতগতভাবেই আমরা দ্বীন-ইসলামের অনুসারী। এর সমর্থনে আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত একটি হাদিস আছে। যেখানে তিনি বলেন, "রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন প্রত্যেক সন্তানই ইসলামী ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার মাতা-পিতা তাকে ইয়াহুদী, নাসারা অথবা অগ্নিপূজক বানিয়ে ফেলে। যেরূপে চতুষ্পদ জন্তু পূর্ণাঙ্গ জন্তুই জন্ম দিয়ে থাকে, এতে তোমরা কোন বাচ্চার কানকাটা দেখতে পাও কি? এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিলাওয়াত করলেন, فِطْرَةَ اللهِ الَّتِيْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللهِ ذلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّم ‘‘আল্লাহর ফিতরাত, যার উপর তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি রহস্যে কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল প্রতিষ্ঠিত দীন।’’[ বুখারী ১৩৫৮]


এখন তো দেখি কেউ সালাত আদায় করলেই প্র্যক্টিসিং মুসলিম দাবি করে। মানে তাও হুট করেই কয়েকদিন সালাত আদায় করলেই তা দাবি করি। আমাদের অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে, যদি দেখি কেউ একজন সালাত আদায় আরম্ভ করেছে, কেউ একজন হিজাব-নিকাব মেইনটেইন করতে শুরু করেছে, কেউ একজন দাড়ি রাখা শুরু করেছে অথবা হারাম রিলেশন ছেড়ে দিয়েছে; আর তখনই আমরা বলি মানুষটা দ্বীনে ফিরেছে, প্র্যাক্টিসিং মুসলিম হয়েছে। এগুলো দ্বীনে ফেরা না। দ্বীনে ফেরার কিছু পদক্ষেপ বলে মনে করি মাত্র। যে ব্যক্তির কর্মে লা-দ্বীনি ব্যবস্থাকে খতম করার উপাদান নেই, যে ব্যক্তি এখনো জাহালাতের উপায়-উপাদান নিয়ে জীবীকা নির্বাহ করে, সমাজে অবস্থান করে, সে ব্যক্তিও দেখি এখন ফেসবুকে দুয়েক কলম লেখার পরে, দুয়েকটা বই বের করে দ্বীনে ফেরার রাহবার হয়ে ওঠছে। হয়ে ওঠছে প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদের আইডল ! দ্বিনে ফেরা আর প্র্যাক্টিসিং মুসলিম শব্দদ্বয় এখন যতোটা হালকা হয়ে গেছে, যতোটা ঠুনকো হয়ে গেছে সেটা ততোটা হালকা বা ঠুনকো বিষয় নয়....


আমি একটা জিনিস জানতে চাই যে, বর্তমান সময়ে প্র্যাক্টিসিং মুসলিম হওয়া কি আদৌ সম্ভব? ইসলামি খিলাফাহ প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাড়া কি কেউ প্র্যাক্টিসিং মুসলিম হতে পারে? পরিপূর্ণভাবে মুসলিম হওয়া সম্ভব? যেখানে বিশ্বব্যবস্থাটাই ইসলাম বিরোধী। সেখানে ঈমান নিয়ে টিকে থাকাটাই তো সমস্য। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই যদি কেউ বলে আমি দ্বীনে ফিরেছি, প্র্যাক্টিসিং মুসলিম হয়েছি—তখন বিষটা কেমন হয়ে যায় না?

আমি দ্বীনে ফেরা বা প্র্যাক্টিসিং মুসলিম বলতে তাদেরকেই বুঝি—যারা দ্বীনের বিধানকে, তাওহিদকে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বাত্মক সংগ্রাম-সাধনা করেন। প্রচেষ্টা করেন। বিরাম-বিরতিহীনভাবে আল-জি.হা.দ ফি সাবিলিল্লাহয় রতো থাকেন।

আল্লাহ তাঁর রাসুলকে প্রেরণের উদ্দেশ্যই হচ্ছে কা.ফি.র মু.শ.রি.ক.দে.র র.ক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে দ্বীন-ইসলামকে অন্য সকল বিধানের ওপর বিজয়ী করার জন্যে সংগ্রাম করা। আল্লাহদ্রোহী শক্তিকে বর্জন করে আল্লাহর বিধানকে মেনে নিয়ে জীবনযাপন করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা বলেন—
‘নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং ত্বাগূতকে বর্জন করো’ (সুরা নাহল-৩৬)।
পবিত্র কুরআন মাজিদের সূরা আত-তাওবার ৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওতা'আলা বলেন—

তিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত আর সঠিক দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন যাবতীয় দ্বীনের উপর একে বিজয়ী করার জন্য যদিও মুশরিকগণ অপছন্দ করে।

এছাড়াও সুরা ফাতহ-এর ২৮ নং আয়াত ও আসসাফফের ৯ নং আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে,
আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করার দায়িত্ব দিয়েই তিনি রাসুল (সাঃ)-কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সকল নবিরাই আল্লাহর তাওহীদ ও তাঁর বিধান মেনে চলার দাওয়াত দিয়েছেন। এবং বাতিল শক্তি ও তাদের তৈরিকৃত আইন-কানুন-ব্যবস্থাকে পরিত্যাগ করতে বলেছেন। সকল বাতিল ব্যবস্থা, আইন, নিয়ম-কানুন অকেজো করে দিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান কায়েম করা ও বিজয়ী করে দেয়াই রাসুল (সঃ)-কে প্রেরণের উদ্দেশ্য।

আর যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর বান্দা এবং রাসুলের উম্মত হিসেবে দাবি করবে অথচ এই এই সংগ্রাম-সাধনায় নিজেকে নিয়োজত না করেই কিংবাপারতপক্ষে সে পথের পথিকদের সহযোগিতা না করে যদি কেউ নিজেকে প্র্যাক্টিসিং মুসলিম দাবি করে, তাহলে তার দাবি সঠিক নয়। দ্বীনে ফেরা মানেই হচ্ছে দ্বীন বিজয়ের চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করা। তাওহিদের পতাকাকে পৃথিবীতে বুলন্দ করার আকাঙ্ক্ষায় কাজ করে যাওয়া। দ্বীনে ফেরা মানেই হচ্ছে লা-দ্বীনি চিন্তা-চেতনা, তাহজিব-তামুদ্দুন, লা-দ্বীনি শিক্ষানীতি-রাজনীতি-সমাজনীতি; ইত্যাদি উৎখাতের জন্যে চূড়ান্ত সংগ্রাম সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করা, দ্বীন বিরোধী সবকিছুকেই পরিবর্তনের জন্যে বিরাম-বিরতীহীনভাবে কাজ করে যাওয়া। আসহাবে রাসুলের মতো ত্যাগের মহিমায় নিজেকে উজ্জ্বল করা। 

এসব প্রচেষ্টা কিংবা আকাঙ্ক্ষা ছাড়া কেউ দাড়ি যতো বড়োই করুক, জুব্বা যতো লম্বা-ই পরুক না, যতো বই-ই লিখুক, তিনি যতো জানলেওয়ালা-ই হোক না কেন; আমার দৃষ্টিতে সে ব্যক্তির কখনো আল্লাহর আদেশানুযায়ী দ্বীনে ফেরা হয়নি। সে প্র্যাক্টিসিং মুসলিম না। 

আবারো বলি, দ্বীনে ফেরা মানে সে দ্বীন বিজয়ের জন্যে নিজেকে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে উৎসর্গ করবে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল অবধি দ্বীনের প্রাধান্য এবং বিজয়ের জন্য স্বপ্ন বুনবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে যাবে। ইসলামি জামায়াহ-ইসলামি ইমারাহ ছাড়া এককভাবে তা সম্ভব নয়। সে নিজেকে তাই তো সে অনুযায়ী তৈরি করবে। তৈরি করবে তার আশপাশকে। আমি আবারো বলি, দ্বিনে ফেরা আর প্র্যাক্টিসিং মুসলিম শব্দদ্বয় এখন যতোটা হালকা হয়ে গেছে, যতোটা ঠুনকো হয়ে গেছে সেটা ততোটা হালকা বা ঠুনকো বিষয় নয়। এটা একটা বিরাট ব্যাপার....


~রেদওয়ান রাওয়াহা
২৯.১০.২১ ইং

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ