|| বদলে যাওয়া বদলে দেওয়া-পর্ব : ০৪ ||
জাহিলিয়াতের ঘোর অমানিশা তাদের কী পরিমাণ গ্রাস করলে পরে একজন
বাবা তার সন্তানকে নিজ হাতে জ্যন্ত মাটিতে পুতে ফেলতে পারে। তারা
এবং তাদের সসমাজব্যবস্থা ছিলো এতোটাই নির্দয় যে,
মায়ের গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ট হবার সময়ই একটা গর্ত খুঁড়ে রাখা হতো।
যদি সন্তানটি মেয়েই হতো তখন তাকে সেই গর্তেই চাপা দিয়ে ফেলা হতো। বর্বরোচিত এই
কর্মের কোলাহলে তারা এতোটাই ডুবে রয়েছিলো যে, এই হীন কর্মকে
তারা কোনো রকমের অন্যায় বলে মনে করতো কি-না তা আল্লাহই অধিক অবগত। এই ঘৃণিত কর্মের
জন্যে তারা মোটেও লজ্জিত হতো না। সমাজের মানুষ কিংবা পরিবারের, কেউই তাদের এহেন জঘন্যতম কর্মের কোনোরকম তিরস্কার কিংবা নিন্দে করতো না।
শাসন কিংবা বারণের তো প্রশ্নই আসতো না। কখনো কখনো যদিও মায়ের অথবা কোনো একজন দরদী মনের অধিকারী স্বজনের
সহমর্মিতা ফুটে ওঠতো, সেই দরদ বা সহমর্মিতা থেকে তারা
বাধ সাধার পর কিছুকাল লালনপালন করলেও একসময় ঠিকই সমাজে তার মর্যাদা-গ্রহণযোগ্যতা
বলে কিছুই থাকতো না। তাই দেখা যেতো সন্তানটির বাবা কিছুদিন পরে ঠিকই তাকে কোথাও নিয়ে কুয়োর ভেতর ফেলো দিতো। মাটি চাপা দিয়ে চলে আসতো। অথচ
তারা না ছিলো কোনো দোষে দুষ্ট, না
ছিলো পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হবার পেছনে তাদের কোনো হাত। তাদের যদি দোষ হয়েই থাকে,
তা হলে তা ছিলো মেয়ে হিসেবে জন্মগ্রহণ করা(!)। এই দোষে দোষী (!!)
হবার অপরাধেই তাদেরকে পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে চিরকালের জন্যে নিঃশেষ করে দেওয়া
হতো। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বিষয়টিকে এভাবেই উপস্থাপন করেছেন,
'... জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কী অপরাধে
তাকে হত্যা করা হয়েছিল?'
উক্ত
আয়াতে কারিমার তাফসিরে ইমাম সাইয়িদ মওদূদী ররহিমাহুল্লাহ বলেন,
"এই আয়াতের বর্ণনাভঙ্গীতে মারাত্মক ধরনের ক্রোধের প্রকাশ দেখা যায়। যে
পিতা বা মাতা তাদের মেয়েকে জীবিত পুঁতে ফেলেছে আল্লাহর কাছে তারা এত বেশি ঘৃণিত
হবে যে, তাদেরকে সম্বোধন করে একথা জিজ্ঞেস করা হবে না,
তোমরা এই নিষ্পাপ শিশুটিকে হত্যা করেছিলে কোন অপরাধে? বরং তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ছোট্ট নিরপরাধ মেয়েকে জিজ্ঞেস
করা হবে, তোমাকে কোন অপরাধে মেরে ফেলা হয়েছিল? তখন সেই পিচ্চি নিরপরাধ শিশু কন্যাটি নিজের
সাথে ঘটে যাওয়া কাহিনি শুনাতে থাকবে। তার জালিম বাবা-মা কীভাবে তার ওপর জুলুম
করেছে, কীভাবে তাকে মাটিতে পুতে ফেলা হয়েছে সেই কাহিনি
সবিস্তারে আল্লাহর আদালতে বর্ণনা করবে"
এই
যে এক ঘোরতর আধার-অমানিশা, এই যে সমাজব্যবস্থা এবং মানুষগুলোর এমন ভয়ালরূপ। এই
যে কন্যা সন্তান নিয়ে এতোটা হীনমন্যতা আর অমানবিক অমানিশার ঘনঘটা, যেই অমানিশার ডুবো চরে ডুবে পড়ে তারা নিজ সন্তানকে পর্যন্ত জীবন্ত দাফন
করতো, হুবহু এমনই একটি সমাজের মধ্যে ইসলাম নামক আলোর
উদ্ভব হয়েছে। যেই আলোর পরশে স্পর্শিত হয়ে তারা হয়েছিলো তাবত দুনিয়ার সকল মানুষের
জন্যে প্রেরণার পিরামিড।
তেমনি এক প্রেরণার পিরামিডের নাম সায়িদ বিন যায়িদ। তিনি যদি কখনো কোনোভাবে
শুনতে পেতেন কোনো কন্যা সন্তানকে হত্যা বা দাফন করা হচ্ছে বা হবে কোথাও, তখন তিনি তা শুনে হনহনিয়ে ছুটে যেতেন তার অভিভাবকের
কাছে। ফিরিয়ে নিয়ে আসতেন সন্তানটিকে নিজ দায়িত্বে।
রাখতেন নিজের কাছেই। এরপর সেই কন্যা সন্তানটি বড়ো হলে তার পিতার কাছে নিয়ে গিয়ে
বলতেন, ইচ্ছে করলে এখন তুমি তাকে নিজ দায়িত্বে নিতে পারো
অথবা আমার দায়িত্বেও ছেড়ে দিতে পারো। এমনি করেই নিঃস্বার্থভাবে লালনপলনের
বন্দোবস্তো করতেন অসংখ্য নির্মমতার মুখে নিপতিত হতে যাওয়া নিস্পাপ মায়াবতী কন্যা
সন্তানদের।
দেখুন, যেখানে
পুরো সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থায় কন্যা সন্তানকে ভাবা হতো নিতান্তই নগন্য এক বোঝা
হিসেবে। নিজ গর্ভজাত-ঔরসজাত সন্তানকেও যেখানে নির্মভাবে নিহত করা হতো, সেখানে তিনি অন্য আরো আট-দশটা মানুষের কন্যাকে এনেও লালনপালন করতেন,
দায়িত্ব নিয়ে। নিঃস্বার্থভাবে। দুনিয়াবী সকল চাওয়া-পাওয়া ও
স্বার্থের উর্ধ্বে ওঠে। এই হলো সত্যিকারের বদলে যাওয়া আর বদলে যাওয়ার আরেক মানবিক
মানচিত্রের মনোহর নমুনা।
|| বদলে যাওয়া বদলে দেওয়া-পর্ব : ০৮ ||
~রেদওয়ান রাওয়াহা
Comments
Post a Comment