আদর্শপ্রীতি বনাম ব্যক্তিপ্রীতি
১.
আমরা জানি, এক অসম যুদ্ধে মক্কার মুশরিক সম্প্রদায় বদরের প্রান্তরে মুসলিম মুজাহিদদের নিকটে পরাজয় বরণ করেছে। পরাজিত হবার পর থেকেই মুসলমানদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের মানসিকতায় বন্য হায়েনার মতো উন্মাদ হয়ে ছিলো তারা। তাদের চোখে-মুখে হিংসা-ক্রোধ-ক্ষোভের উত্তাল লেলিহানশিখা বিরাজিতই থাকতো সব সময়, সর্বদা। তারা মুহাম্মাদﷺ-এর নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্র, এবং সে-রাষ্ট্রের সফলতা ও অগ্রযাত্রা কোনো ক্রমেই মানতে পারছিলো না। মুহাম্মাদ মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে সমূলে নাশ করার নানান ফন্দি-ফিকির তারা এঁটে যেতে লাগলো। সেই ধারাবাহিকতায় তারা ওহুদের প্রান্ত্ররে জুড়ে দেয় সম্মুখ-সমরে যুদ্ধ।
সে যুদ্ধ এবং যুদ্ধের কলাকৌশল আমরা জানি । তো যখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো, ঝাঁপিয়ে পড়লো যখন মুশরিকরা মুসলিমদের ওপর, প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম বীরযোদ্ধারা মুশরিকদেরকে বীরবিক্রমে প্রতিরোধ করে হারিয়ে দিতে পারলেও পরক্ষণেই মুসলিমগণ নিজেদের ছোট্ট একটা ভুলে পরাভূত যায়। মূলত তৎকালীন মুশরিক সেনাপতি জেনারেল খালিদ বিন ওয়ালিদই আতর্কিত আক্রমণ করে মুসলিমদের হারিয়ে দেয়। এরপর থেকে খুন আর জখম হতে থাকে মুসলিম মুজাহিদগণ। মুশরিকদের আক্রমণে পর্যুদুস্ত হয়ে মুসলিম বাহিনী একে একে আহত আর শাহাদাতের সরাব পান করছে। সেদিনের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেন না রাসুল ﷺ নিজেও।
স্বশরীরে ময়দানে যুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহর রাসুল ﷺ। তাই তো মানবতার বন্ধু, মায়ার মহানবি মুহাম্মদ ﷺ-কে কাফিররা হত্যা করতে পেরেশান হয়ে আছে। একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে নবিজিকে হত্যা করতে যারপরানই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
উতবাহ বিন আবু অক্কাস। এই হতভাগা রাসুল ﷺ-কে দেখেই হিংস্র গতিতে পাথর দ্বারা আঘাত করলো। পাথরের আঘাতে একপাশে ঢলে পড়লেন প্রিয় নবিজি। সেই আঘাতে তাঁর ডান পাশের ওপর-নিচের চারটে দাঁত ভেঙ্গে যায়। কোত্থেকে তেড়ে এসে আব্দুল্লাইবনে শিহাব যুহরী। এসেই আঘাত করে নবিজির কপাল বরাবর। ঘোড়সাওয়ারী বনী হারিছ গোত্রের ইবনে কামিয়াহ। আল্লাহর রাসুলকে পরখ করলো। প্রিয় নবিজির দেহ মুবারকে কাঁধ বরাবর তরবারি দিয়ে খুব জোরেশোরেই আঘাত করলো এই জালিম ! [০১]
ভীষণ রকম আহত রাসুল্লাহ ﷺ। বিপর্যস্ত মুসলিম বাহিনী। এর মধ্যে চারদিকে কাফিররা রটিয়ে দিলো যে মুহাম্মাদকে আমরা নিহত করে ফেলেছি! এমন সংবাদে ভীষণ রকম হতাশায় পড়ে গেলো মুসলমানগণ। দিকদ্বিক দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে সবাই। ভেঙ্গে গেলো তাঁদের মনোবল পুরোপুরিভাবেই। হারিয়ে গেলো তাঁদের অবশিষ্ট্য সাহস এবং ধৈর্যও। দুঃখ-বেদনায় তাঁরা ভারাক্রান্ত । মুজাহিদগণ প্রবল পেরেশানিতে পড়ে গেলেন। মুহাম্মাদ ﷺ মারা যাবেন, পৃথিবী থেকে চলে যাবেন; এটা যেনো তাঁরা মোটেও মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এই মানুষটিকেই তো ভালোবাসে! এখন সেই মানুষটাকে হারাবার যে পীড়ন, যেই দুঃখ, সেই দুঃখ আর পেরেশানি থেকে তাঁরা যুদ্ধের সারঞ্জম ফেলে রেখে কেউ কেউ চলে যতে লাগলেন এদিক-ওদিক। যাকে সামনে পায় তাকেই তাঁরা জিজ্ঞেস করে তাঁদের প্রিয় নেতা-প্রিয় নবি সম্পর্কে, তিনি কি বেঁচে আছেন নাকি সত্যিই নিহত হয়েছেন। হঠাৎ কেউ একজন আল্লাহর নামের কসম করে বলে ওঠলো, ‘‘যদি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম সত্যিই নিহতই হয়ে থাকে, তা হলে আমি আমার সকলকে আমার বংশধরদের হাতে সোপর্দ করে দেবো। এই সুযোগে মুনাফিকরাও থেমে নেই। তারাও মুসলমানদের ঈমানহারা করার কোশেশ করতে চেষ্টার ত্রুটি করছে না। তারা রসিয়ে রসিয়ে আগুনে ঘি ঢালার মতো আচরণ করতে লাগলো। বলতে লাগলো যে— মুহাম্মাদ যদি নবিই হবে, তা হলে মারা গেলো ক্যান? চলো আমরা পূর্ব-ধর্মে ফিরে যাই! কেউ কেউ এই বলেও আওয়াজ তুললো, “চলো , আমরা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই’র ( মুনাফিক নেতা ) কাছে ফিরে যাই, সে-ই আমাদেরকে মুশরিক নেতা আবু সুফিয়ান থেকে নিরাপত্তা নিয়ে দিবে!’’[০২]
সংশয়ক্লিষ্ট-রোগাক্রান্ত মুসলিমদের অন্তরের অবস্থা আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা ওহী-মারফতে জানিয়ে দিলেন তাঁর প্রিয় হাবিবকে ! অবতীর্ণ করলেন সেই আয়াতে কারিমাহ, যেখানে বলা হয়েছে, ‘‘মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর রাসুল ছাড়া কিছুই না। তাঁর পূর্বেও তো বহু নবি-রাসুল অতিক্রান্ত হয়েছে। তিনি যদি মারা যান, কিংবা নিহত করে ফেলা হয় তাঁকে ; তা হলে তোমরা কি তোমাদের পূর্বেকার অবস্থায় ফিরে যাবে ? যদি তোমরা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাও— তা হলে তোমরা আল্লাহর কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না। ( বরং এতে তোমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করবে ) আল্লাহ অবশ্যই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন’’(সূরা আলে-ইমরান:১৪৪) [ ০৩ ]
ওহুদের ময়দানে এই যখন অবস্থা, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত যখন সকলের মন-মনন-ঈমান, তখন আনাস বিন নযর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মুজাহিদদেরকে স্মরন করিয়ে দিলেন যে, মুহাম্মাদ ﷺ তো স্রেফ আল্লাহর একজন রাসুল কেবল। তিনি সকলকে বলতে লাগলেন, আল্লাহর রাসুল যদি নিহতই হয়ে থাকে তা হলে তাঁর আল্লাহ তো নিহত হননি। আল্লাহর রাসুল নিহত হয়েছে, তোমরা বেঁচে থেকে কী করবা তা হলে? তিনি যে দ্বীনের জন্য জীবন দিয়েছেন তোমরা সেই দ্বীনের জন্য তোমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখো। সেই জিহাদ সংগ্রামে তোমরা লড়াই করো। শহিদ হও। [ ০৪ ]
অনুরূপভাবে সেদিন সাবিত ইবনু দাহদাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নামক অন্য একজন সাহাবিও তাঁর নিজ কওমকে ডেকে ডেকে বলেন, ‘‘যদি মুহাম্মাদ ﷺ নিহত হয়ে থাকেন তবে একথা জেনে রাখো যে, আল্লাহ জীবিত আছেন। তিনি চিরঞ্জীব। তিনি অমর। তিনি মরতে পারেন না।,,
তাঁর এমন ঈমান দীপ্ত ঘোষণা শুনে আনসারদের একদল তাঁর নেতৃত্বে মুশরিকদের বিরুদ্ধে পুনরায় জিহাদে অবতীর্ণ হন। এক পর্যায়ে তিনি শাহাদাতের পেয়ালা পানে ধন্য হন। [০৫]
ইসলাম এসেছে আল্লাহর রাসুলের মাধ্যমে। আমাদের দুনিয়া-আখিরাতের মুক্তির জন্য, মানবতার স্বস্তি ও নিরাপত্তার জন্যই মুহাম্মাদ ﷺ- এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে ইসলাম নামক এক মহা নিয়ামাত দিয়ে ধন্য করেছেন। তিনি চলে গেলেই যদি ইসলামের পথ থেকে সরে গিয়ে কুফুরীর পতাকা তলে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়, তাহলে ইসলামে আসার মানেটা কী? সে-জন্য আল্লাহ কিন্তু মুসলিমদের সতর্ক করেছেন। কড়া ধমক দিয়েছেন!
পবিত্র কুরআনের সূরা আলে-ইমরানের ১৪৪ নাম্বার আয়াতটা আমাদেরকে কী সুন্দর আর স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে,‘মুহাম্মাদ ﷺ স্রেফ আল্লাহর একজন রাসুল। এছাড়া আর কিচ্ছু না। তাঁর মর্যদার কারণ, তাঁকে অনুসরণ করার কারণ এটাই —তিনি আল্লাহর মনোনীত একজন বান্দা ও রাসুল। তিনি ওহী প্রাপ্ত, রিসালাতের গুণে তিনি গুণান্বিত; এটিই তাঁর সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য, এটিই তাঁর সবচেয়ে বড়ো গুণ। এর বাহিরে তিনি মানবীয় গুণাবলির ঊর্ধ্বেও নন, এবং এমনও নয় যে তিনি আল্লাহর গুণের কোনো কিছু প্রাপ্ত হয়েছেন, যার ফলে তাঁকে মৃত্যু গ্রাস করবে না।’ [ ০৬]
মুহাম্মাদ ﷺ আমাদের জন্য নিয়ে এসেছেন সত্য, নিয়ে এসেছেন আলো, এনেছেন আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক আমাদের জন্য মনোনীত জীবনব্যবস্থা, ‘দ্বীনুল ইসলাম’। কিন্তু এ-সত্য, এই দ্বীন কোনো ব্যক্তি নির্ভর নয়। গোত্র কিংবা গোষ্ঠি নির্ভরও নয়। এই প্রসঙ্গে ইমাম মওদূদী (রহ.) বলেন; “সত্যের প্রতি প্রেম যদি তোমাদের জন্য কোনো ব্যক্তি নির্ভর হয়, তোমাদের জন্য আল্লাহর দ্বীন যদি শুধু মুহাম্মাদ ﷺ- এর ব্যক্তিত্বের সাথেই সম্পর্কিত হয়, তোমাদের ইসলাম যদি এতোটাই দুর্বল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে যে, মুহাম্মাদ ﷺ পৃথিবী থেকে বিদেয় হবার সাথে সাথেই তোমরা পূর্বেকার সেই কুফুরীর দিকে ফিরে যেতে চাও, যেই কুফুরীকে পরিত্যাগ করে তোমরা ইসলামের আলয় আশ্রয় গ্রহণ করেছো, তাহলে আল্লাহর এই মহান দ্বীন তোমাদের কোনো-ই প্রয়োজন অনুভব করছে না।” [ ০৭ ]
এখন আমরা যারা আমাদের কোনো প্রিয় মানুষ, প্রিয় শাইখ, প্রিয় আলিম বা প্রিয় নেতা-প্রিয় দায়িত্বশীলদের মৃত্যুতে, কিংবা তাঁদের কোনো বিচ্যুতিতে অথবা বৃহত্তর কোনো প্রয়োজনে তাঁদের স্থানান্তরে মন খারাপ করে, হতাশ হয়ে কিংবা কষ্ট পেয়ে ইসলামের পথ থেকে সরে যাই, আন্দোলনে-আমলে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ি, তাহলে তা কতোটুকু যৌক্তিক এবং শরীয়া সম্মত হতে পারে? আমরা যদি কোনো নেতা, কোনো ইমাম, কোনো আলিমকে বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে ভালোবাসি, সেই ভালোবাসাটা তো নিছক ইসলামের জন্যই হওয়া উচিৎ। ইসলামের মানদণ্ডের বাহিরে গিয়ে আমি কীভাবে সেই মানুষকে চিন্তা করতে পারি? তাঁদের কারো প্রস্থানে কিংবা কারো ব্যক্তিগত জীবনের ভুলের জন্য যদি আমি আল্লাহর দ্বীনের পথ ছেড়ে দিই, ছেড়ে দিই আন্দোলন-সংগ্রাম-সংগঠনের কাজ; সেটা কি আদৌ সঠিক ও উচিত কাজ হবে? ইসলামের কনসেপ্টের সাথে কি তা আদৌ যায়?
যেহেতু স্বয়ং আল্লাহর রাসুলের মর্যাদা আর আনুগত্য হচ্ছে আল্লাহর আনিত দ্বীনের জন্য, রিসালাতের বাহক হবার জন্য; সেহেতু আমরা যে সমস্ত ইসলামি নেতৃত্ব-দায়িত্বশীলদেরকে ভালোবাসবো, তাঁদেরকে তো সেই রাসুলের আনিত দ্বীনের জন্যই ভালোবাসবো। তাই না? এখন তাঁরা কেউ যদি সেই দ্বীন-বহির্ভূত কিছু করে ফেলে, তাহলে সে অভিমানে দ্বীনের কাজ ছেড়ে হাতগুটিয়ে বসে থাকার কোনো মানে হয়? ঈমানের স্বাদ তো সে ব্যক্তিই পাবে, যে ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসলেও আল্লাহর জন্যে বাসবে, ঘৃণা বা প্রত্যাক্ষাণ করলেও আল্লাহর জন্যে করবে।
যেসমস্ত ইসলামি ব্যক্তিবর্গ, আলিম-ওলামা, ইসলামি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ; যাঁরা জালিমদের জুলুমের স্বীকার হয়ে শহিদ হয়েছে, দুনিয়া থেকে চিরকালের তরে বিদেয় হয়ে গেছে; আমাদের কি উচিৎ নয় তাদের রেখে যাওয়া স্বপ্ন ও কাজের আঞ্জাম দেওয়ার জন্য কর্মতৎপরতা আরো দ্বিগুন-তিগুন গতিতে বাড়িয়ে দেওয়া? নাকি সেই পথ, সেই আদর্শ থেকে হারিয়ে যাওয়াটাই সমাধান? রাসুলের সীরাত এবং আল্লাহর কুরআন আমাদেরকে কী শিক্ষা দেয়?
তার মানে কি প্রিয়জন বিয়োগের বেদনায় আমরা ব্যথিত হবো না? কারো বিচ্যুতিতে মন খারাপ হবেনা? প্রিয় দায়িত্বশীলের পরিবর্তনে মনের কোণে হাহাকার কিংবা শূন্যতার সৃষ্টি হবেনা? হ্যাঁ, হবে। অবশ্যই হবে। সবাই কি সব দুর্বলতার ঊর্ধ্বে থাকতে পারে? রক্তে মাংসে গড়া মানুষ বলেই তো মানুষের ভেতর দুর্বলতা ঘুরতে থাকে দুর্নিবার! আমরা তো দেখেছি আল্লাহর রাসুলের সাহাবিদেরও তা হয়েছে, স্বয়ং উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে।
২.
ওহুদে আল্লাহর রাসুল মারা যাবার বিষয়টি তো মিথ্যে রটনা ছিলো, কিন্তু যেদিন সত্যিই আল্লাহর রাসুল ﷺ পৃথিবীর মায়া পরিত্যাগ করে দুনিয়া থেকে চলে গেলেন, সেদিন বিষয়টি উমর ইবনুল খত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কানে যাবার সাথে সাথেই তার কলিজায় কাঁপন ধরে গেছে যেনো! তিনি তা মেনে নিতে পারেননি। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। এতো শক্তিমান আর কঠিন হৃদয়ের মানুষ উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, আল্লাহর রাসুলের ইন্তিকাল তিনি মানতেই পারেননি প্রথমদিকে। সেই বাস্তবতায় তিনি এতোটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে, তরবারি হাতে নিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, “যে ব্যক্তি বলবে মুহাম্মদ ﷺ ইন্তিকাল করেছে, আমি তার মস্তিষ্ককে দ্বিখণ্ডিত করে দেবো!”
যেহেতু আসহাবে রাসুলদের মতো উচ্ছ মাকামের মানুষদেরও এমন দুর্বলতা হয়েছে বা এসেছে, সেহেতু আমাদের মতো মানুষের মধ্যেও বিরহ-ব্যথা, কষ্ট ও হতাশা আসাটা একেবারেই স্বাভাবিক। আমাদের মতো মানুষদেরও এরকম কিছুতে মনটা ভেঙ্গে খানখান-টুকরো টুকরো হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা যেনো সেই ব্যথাতুর মন থেকে আল-কুরআন ও ইসলামের পথ থেকে দূরে সরে না যাই, সে শিক্ষাটাও আল্লাহ তাঁর রাসুলের জীবনীর মাধ্যমে, কুরআনের মাধ্যমে আমাদের দিয়েছেন। এখান থেকে আমরা আরো একটা শিক্ষা পাই; তা হলো এই যে, পরবর্তী যাঁরা ইসলাম-ইসলামি আন্দোলনের ধারক-বাহক হবেন, ইসলামের পূর্ণ বুঝ যাঁর বা যাঁদের আছে, পরবর্তীতে নেতৃত্বের জোয়াল যাঁর বা যাদের কাঁধে আসবে, তাঁরা ইসলামের প্রকৃতরূপ, সঠিক চিত্র-শিক্ষা এবং আসল বুঝটা যেনো অন্যদের সামনে উপস্থাপন করেন। যেভাবে করেছেন ওহুদের প্রান্তরে সাবিত ইবনু দাহদাহ এবং আনাস বিন নযর রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুমা। আর আল্লাহর রাসুলের ইন্তেকালের পরে আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।
৩.
আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লামের ইন্তিকালে যখন সাহাবায়ে কিরাম শোকে মূহ্যমান, স্বয়ং উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুও যখন মেনে নিতে পারেননি এমন বাস্তবতা, তখন আবু বাকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কৌশল অবলম্বন করে রাসুল (সা.)-এর মিম্বারে দাঁড়িয়ে যান, এবং ওহুদে অবতীর্ণ হওয়া সূরা আলে-ইমরানের ১৪৪ নাম্বার আয়াতটি তেলাওয়াত করে শুনান; যেখানে বলা হয়েছে— “আর মুহাম্মাদ ﷺ কেবল একজন রাসুল। তাঁর পূর্বে নিশ্চয় অনেক রাসুল বিগত হয়েছে। যদি তিনি মারা যান অথবা তাঁকে হত্যা করা হয়, তবে তোমরা কি তোমাদের পেছনের জীবনে ফিরে যাবে? আর যে ব্যক্তি পেছনে ফিরে যায়, সে কখনো আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারে না। আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেবেন।” এই সাথে আরো একটি আয়াত তিলাওয়াত করেন,“নিশ্চয়ই তুমি মরণশীল এবং তারাও মরণশলী।” ( সূরা যুমার : আয়াত-৩৯ ) । এর সাথে তিনি ছোট্ট করে একটি বক্তৃতা করেন, সেখানে তিনি বলেন, “যারা মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লামের ইবাদাতকারী ছিলো, তারা জেনে রাখো, মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম ইন্তিকাল করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদাতকারী, তারা নিশ্চিত জেনে রাখো, আল্লাহ চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী।” [ ১০]
সাঈয়িদুনা আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহুর এই সান্ত্বনা এবং বাস্তবিত্তিক এই বক্তৃতা, দায়িত্বশীলসূলভ এই ভূমিকা ও আচরণ দ্বারা সাঈয়িদুনা উমর ইবনুল খত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কীভাবে কতোটা দ্রুত প্রভাবিত হয়েছেন, কতোটা কার্যকরী ছিলো আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর উক্ত ভূমিকা, তা দেখুন;
“ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর কসম! আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তা পাঠ করার পূর্বে লোকেরা যেনো জানতো না যে, আল্লাহ তা'আলা এরূপ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। এরপর সমস্ত সহাবি তাঁর থেকে উক্ত আয়াত শিখে নিলেন। তখন সবাইকে উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনলাম। আমাকে সা'ঈদ ইবনু মুসাইয়্যাব (রহ.) জানিয়েছেন, 'উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আল্লাহর কসম! আমি যখন আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনলাম, তখন ভীত হয়ে পড়লাম এবং আমার পা দু'টো যেনো আমার ভার নিতে পারছিলো না, এমনকি আমি মাটিতে পড়ে গেলাম যখন শুনতে পেলাম যে, তিনি তিলাওয়াত করছেন যে নবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লাম) ইন্তিকাল করেছেন। [১১]
এখন আমরা যারা সত্যের অনুসারী, দ্বীনের অনুগামী, দ্বীনের প্রচার-প্রসার এবং বিজয় যেহেতু আমাদের উদ্দেশ্য, সেহেতু আমরা ব্যক্তির থেকে বেশি প্রাধান্য দেবো সত্যকে, দ্বীনকে, আমাদের আদর্শকে। ব্যক্তির প্রতি মায়া-ভালোবাসা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু সেই মায়া, সেই টান যেনো আমাদেরকে সত্য থেকে টলাতে না পারে, অভিমান হোক বা অভিযোগ; তা হতে যেনো আমরা আল্লাহর পথ ছেড়ে না দিই। আন্দোলন-সংগ্রাম-সংগঠনে আমরা যেনো নিষ্ক্রিয় হয়ে না পড়ি। আমাদের গতি যেনো শ্লথ না হয়ে পড়ে।
এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ যাঁরা আছেন, থাকবেন বা হবেন; তাঁদেরও কিছু ভূমিকা আছে বৈকি! সে ভূমিকা পালনের জন্যে আমরা এ-বিষয় মনে রাখতে পারি যে, আমরা তো মানুষ, মানবিক দুর্বলতা মানুষেরই থাকবে। কারো প্রতি কারো একটু বেশি ভক্তি থাকবে, কারো প্রতি একটু মায়া-আনুগত্য বাড়তি থাকবে, দুর্বলতা থাকবে, কারো যোগ্যতা একটু বেশি থাকবে, কারো থাকবে একটু কম। কেউ একদিকে দক্ষ তো কেউ অন্যদিকে। এটাই মানুষের সমাজ। এটাই মানুষের বৈশিষ্ট্য। আর এ বিষয়টি মাথায় রেখেই দায়িত্বশীল ভাইদের চলা উচিৎ। সিনিয়র-জুনিয়র, সাবেক-বর্তমান কাউকে কোনো কিছু নিয়ে দোষারপ করে কিংবা পাল্টা অভিযোগ তুলে যেনো কাউকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে ঠেলে না দিই। দ্বীনের কাজে নিষ্ক্রিয় করে না দিই। ইসলাম ও ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠাকাঙ্ক্ষী দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের উচিৎ ওহুদের ময়দানে সাবিত ইবনু দাহদাহ এবং আনাস বিন নযরের যেই ভূমিকা ছিলো, আল্লাহর রাসুলের ওফাতের পর আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহুর যে ভূমিকা ছিলো, সেই কালজয়ী দায়িত্বশীলসূলভ ভূমিকা গ্রহণ করতে চেষ্টা করা। যে ভূমিকার বদৌলতে আন্দোলন-সংগঠন ও আদর্শ আরো গতি সঞ্চার করবে। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আ-মী-ন!
// আদর্শপ্রীতি বনাম ব্যক্তিপ্রীতি //
-রেদওয়ান রাওয়াহা
তথ্যসূত্র
......................................................
০১। আর-রাহীকুল মাখতুম -৩০৯ পৃষ্ঠা
০২। তাফসীরে তাবারী-৬ষ্ঠ খ-
০৩। তাফসীরে আহসানুল বায়ান
০৪। তাফসীরে তাবারী- ৬ষ্ঠ খ-
০৫। আসসীরাতুল হালাবিয়াহ- ২খ-
০৬। তাফসীরে আহসানুল বায়ান
০৭। তাফহীমুল কুরআন
০৮। সহীহ বুখারী-৩৬৬৮
০৯। সহীহ বুখারী- ৪৪৫৪
[ লেখাটি ছাত্রসংবাদ জানুয়ারি-২২ সালে প্রকাশিত ]
Comments
Post a Comment