"খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু কি মুমিন নারীদের ব্যাবসার আইডল?"

 


উম্মুল মু'মিনীন আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাজ কি পুরুষ সাহাবিদের শিক্ষকতা করা ছিলো? তিনি কি সেই অর্থে পুরুষ সাহাবিদের শিক্ষা দিতেন? খাদিজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা কি মুমিন নারীদের জন্য স্রেফ ব্যাবসার আইডল? তাঁর কাজ কি শুধুই ব্যবসা করা ছিলো? নাকি তাঁর প্রধান পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন আদর্শ সংসারী নারী ও একজন মুহসিনা মুসলিমা অনুগত স্ত্রী এবং নারী?
দ্বীনকে আর ফেমিনিজমকে একই সাথে ম্যানেজ করতে চাওয়া বহু বোনদের মধ্যে এসব নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি আছে, ওনারা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বানায় নারীদের ব্যবসার আইডল, আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে বানায় মহিলা প্রফেসর। পুরুষ সাহাবিদের শিক্ষক। এভাবে অনেক বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তাঁরা সহজ সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করে। অনেক পরিবারের মধ্যে এসব নিয়ে তাদের অনুসারীরা ঝামেলাও সৃষ্টি করে।

আজকে আমরা আমাদের মুসলিম উম্মাহ'র সম্মানিতা মা, খাদিজাতুল কুবরা রাদিআল্লাহু আনহার ব্যাপারটি নিয়েই আলোচনা করবো ইন শা আল্লাহ!
আমরা যদি আম্মাজান খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার দিকে দৃষ্টি দিই, তাহলে দেখবো যে তিনি আসলে সে অর্থে কোনো ব্যবসায়ী ছিলেন না। তাঁর মূল কাজও ব্যবসা ছিলো না। তাহলে বিষয়টা কী ছিলো?

বিষয়টা হচ্ছে তিনি তাঁর পৈত্রিকসূত্রে সে সমস্ত সম্পদের মালিকানা লাভ করেছেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন বড়ো মানের ব্যবসায়ী। ভালো ম্যানেজিং ক্যাপাসিটিও ছিলো তাঁর। কিন্তু তিনি যখন বার্ধক্যে উপনীত হলেন, তখন কিন্তু তাঁর দ্বারা আর ব্যবসা দেখাশোনা সম্ভব হয়ে ওঠলো না। তিনি যে তাঁর ব্যবসায়ের দায়িত্ব অর্পন করবেন, এমন ছেলেও তাঁর ছিলো না। তাই তিনি তাঁর গুণবতী কন্যা খাদিজার ওপর ব্যবসায়ের দ্বারা অর্জিত সম্পত্তিগুলোর দায়িত্ব অর্পন করেছেন।

এই দায়িত্ব আম্মাজান খাদিজার ওপর অর্পন হবার পরেও কিন্তু তিনি ব্যবসার কাজ নিজেই করতেন না। মানে তিনি নিজে ঘরের বাহিরে গিয়ে ব্যবসা করতেন না। তিনি সেই সম্পদগুলো বা অর্থগুলো বিনিয়োগ করতেন। সেই বিনিয়োগ দিয়ে ব্যবসার কাজ পরিচালনার জন্য, ব্যবসংক্রান্ত বিষয়াদি দেখাশোনা করার জন্যে তিনি একজনকে নিয়োগ দিতেন। উক্ত নিয়োগকৃত ব্যক্তি তাঁর পণ্য-সামগ্রী নিয়ে দেশে দেশে, বিভিন্ন শহরে শহরে সফর করতেন। ব্যবসা করে লাভ্যংশটা এনে বুঝিয়ে দিতেন আম্মা খাদিজাকে। এভাবেই তাঁর সাথে আমাদের প্রিয় নবি সাইয়্যিদুল মুরসালিন মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের সাথে পরিচয় ও চূড়ান্ত জানাশোনা হয় এবং রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সততায় মুগ্ধ হওয়ায় পরবর্তীতে বিবাহও হয়।
এবং আম্মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বিবাহের পরে আর ব্যবসার কাজ পরিচালনা করেননি। তিনি তাঁর সমুদয় সম্পত্তি দান করে দিলেন নিজের স্বামী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামকে। আর মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামও দ্বীন প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কাজে সেই সম্পত্তিগুলোকে ব্যবহার করেছেন। ব্যবহার করেছেন সেই সম্পদকে ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্ত করার কাজে, রিক্তহস্তদের সাহায্যের কাজে, এতিমদের প্রতিপালনের কাজে। মুসলমানদের মধ্যে যারা মক্কা থেকে সবকিছু ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করে আসেন, প্রিয়নবী তাদেরকে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহার সম্পদ থেকে সাহায্য করেন।

সোজা কথায়, তিনি যেভাবে ভালো মনে করেন খাদিজার সম্পদ সেভাবেই খরচ করেন। এতে আম্মা খাদিজা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহা বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপও করেননি। কোনো কথাও তোলেননি।

তাহলে দেখা গেলো যে, খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বিয়ের পরে এবার সেই অর্থে আর মোটেও ব্যবসায়ী থাকেননি। তিনি তাঁর ঘর-সংসারের কাজে মনোযোগী ছিলেন। করেছেন তাঁর স্বামীর কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা!
মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন, তখন এই খাদিজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা-ই কিন্তু সেই গুহায় গিয়ে খুব কষ্ট স্বীকার করে খাবার দাবার দিয়ে আসতেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ওহী নাজিল হবার কালে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়েছিলেন, ভীষণ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তখন কিন্তু এই খাদিজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা-ই তাঁকে সাহস যোগাতেন। তাঁর সব কথাকেই তিনি বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিতেন। মুশরিকদের সব অমার্জিত আচরণকে, যেসব আচরণে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কষ্ট পেতেন, সেসব আচরণকে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হালকা ও তুচ্ছভাবে তুলে ধরতেন। এক কথায় তাঁর মনে সবরকমভাবে শক্তি সঞ্চয় করতেন। তাঁকে উদ্দীপ্ত রাখতেন।

ইসলাম এবং ফেমিনিজমকে সমন্বয় করতে চাওয়া আমাদের সেই বোনেরা কিন্তু এভাবে স্বামীর জন্য এমন কষ্ট স্বীকার করতে চান না। ভীষণ অনাগ্রহী এতে তাঁরা। দিনের পর দিন এভাবে এতো দূরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসাটাকে তাঁরা অনেকে দাসীর সাথেও তুলনা করতে দ্বিধাবোধ করেন না। সাংসারিক কাজকর্ম তাদের কাছে কথিত দাসত্বেরই চিহ্ন! এই এরাই আবার ব্যবসায়ী হবার জন্য খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকেই উদাহরণ হিসেবে পেশ করে। অথচ তিনি স্বামী-সংসারের জন্য কীভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, কীভাবে দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হাজব্যান্ডকে নিবেদিত প্রাণ হয়ে সহযোগিতা করেছেন, সেটা ভুলে যায়!

এখানে একটা বিষয় বলে রাখি— নবুওয়াতি জিন্দেগীর পূর্বেকার কর্ম নবুওয়াতি পরবর্তী সময়ের জন্যে দ্বীন-শারিয়ার দলীল হতে পারে না। নবুওয়াতি জিন্দেগীর সময় তিনি যা করেছেন, একজন মুমিনের কাছে সে-সবই হবে শরীয়াহ পালনের দলীল। তবুও আমরা যদি তাঁকে (খাদিজা রা.) ব্যবসায়ীর উদাহরণ হিসেবে পেতে চাই, তা-ও সেই অর্থে আর উদাহরণ হিসেবে তা টেকে না।

এর কারণ, তিনি কোনো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে বা সাধারণ কোনো উদ্যোক্তা হিসেবেও তাঁর জীবন শুরু করেননি। তিনি ব্যবসায়ের ভার পেয়েছেন তাঁর ভাই না থাকায় পিতার থেকে। কেউ কেউ বলেন স্বামীর ইন্তেকালের পর তিনি তাঁর স্বামীর সম্পদের মালিকানা লাভ করেছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারমানে কি এই, যে নারীদের জন্যে ব্যবসা-বানিজ্য কিংবা সাবলম্বী হওয়া নিষিদ্ধ? অবশ্যই না। এটা হারাম বা নিষিদ্ধ নয়। তবে এটা এমনও নয় যে, তাদেরকে কথিত সাবলম্বী হবার নাম করে তাদের যেটা মূল কাজ, তা বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। কিংবা ক্যারিয়ার ও ব্যবসা-বানিজ্যকেই বড়ো করে দেখা হবে। আর এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে উম্মুল মুমিনীন খাদিজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহাকে।

নারীদের উপার্জন, ব্যাবসা-বানিজ্য ইত্যাদি বিষয়াদি অবশ্যই প্রয়োজনের ওপর নির্ভরশীল। যে নারীর স্বামী নেই, যিনি বিধবা, উপার্জনক্ষমও কেউ নেই, বাবা বা ভাই-ও নেই, থাকলেও তারা দায়িত্ব পালন করেন না, তার প্রতি খেয়াল রাখেন না; অথচ বাচ্চাগুলো ছোটো ছোটো, তারা জীবীকা নির্বাহ করার মতো বয়সেও উপনীত হয়নি, তখন সে নারীর জন্য অবশ্যই উপার্জন করার মতো কিছু একটা করতে হবে। আর সেটা হতে হবে পর্দার অন্তর্ভুক্ত থেকে। হালালপন্থায়। হতে পারে সেটা ব্যাবসা কিংবা শরীয়াহ সম্মতপন্থায় ভিন্ন কিছু! কিন্তু আমাদের কাছে দ্বীন আর ফেমিনিজমকে ধারণ করতে চাওয়া মানুষগুলো যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করে, বিষয়টি মোটেও সেরকম কিছু নয়। সেটা অবশ্যই প্রয়োজন আর বাস্তবতার সঙ্গেই সম্পর্কিত।

যাহোক, এর বাহিরেও যদি আপনি ব্যবসা করার বা উদ্যোক্তা হবার ইচ্ছে পোষণ করেন, কিংবা সে লক্ষ্যে কাজ করেন, তবে সেটা অবশ্যই আপনার নিজস্ব ইখতিয়ার। কারণ এটা সুস্পষ্ট হারামও নয়, আবার ইসলাম এটাকে যে খুব দারুণভাবে উৎসাহিত করে— তা-ও না। তাই সেটা আপনি করতে চাইলে করুন। কিন্তু সেটার সাথে কখনোই উম্মুল মুমিনীন খাদিজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহাকে যুক্ত করবেন না। ওনাকে কথিত নারীদের ব্যবসার মডেল হিসেবে উপস্থাপনও করবেন না প্লিজ!

তাকে আইডল হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে একজন স্ত্রী হিসেবে। স্বামীর অনুগত একজন সংসারী নারী হিসেবে। একজন আদর্শ মা হিসেবে। একজন মুহসিনা-মুত্তাকি মুসলিমাহ হিসেবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদেরকে সঠিক বুঝ প্রদান করুন। আ-মী-ন!


|| উম্মুল মুমিনীনদের জীবনীর ভুল পাঠ-০১||
~রেদওয়ান রাওয়াহা


"

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ