আমাদের কৌশল ও কর্মনীতি কেমন হবে?



তুরস্কের বাস্তবতা, মিশরের বাস্তবতা, বাংলাদেশ কিংবা উপমহাদেশের বাস্তবতা তো এক না। এক না সৌদি আরবের পরিবেশ, মিশর, তুরস্ক কিংবা আমাদের পরিবেশও। অন্যদিকে এসব জায়গার পরিবেশ কিংবা বাস্তবতা থেকে আমেরিকা, চীন ও রাশিয়ার পরিবেশও সম্পূর্ণ ভিন্ন। 

এখন আমরা যদি তুরস্ক-মিশর, ইউরোপ-আমেরিকার পরিবেশ এবং বাস্তবতাকে সামনে রেখে আমাদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করি, তাহলে তা কি ঠিক হবে? হবে না তো। নিঃসন্দেহে তা ভুল হবে এবং বহু ফিতনার জন্ম দেবে।

আমাদের উপমহাদেশের সব ঘরনার আলিম এবং ইসলামি আন্দোলন-সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ এবং ওলামায়ে কেরাম আমাদের সম্মানিত দীনি বোনদেরকে মিডিয়ায় এসে, নিকাব না করে কখনোই বক্তৃতা করা, আলোচনা করা কিংবা কথিত দাওয়াতি কাজ করাকে উৎসাহ দেয় না। কখনো দেয়নি। 

যেমন জামায়াতে ইসলামী কিংবা ছাত্রীসংস্থার দিকেই যদি তাকাই—  তাহলে দেখবো যে, এখানে কখনোই তাদের কোনো দায়িত্বশীল নেত্রী সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে নিকাববিহীন বক্তব্য দেননি। পাবলিক প্লেসে এসে দাওয়াতি কাজও করেননি। অথচ জামায়াতে ইসলামীতে মহিলাদের মধ্যে মোটামুটি ভালোই কাজ আছে। কোনো কোনো জায়গায় জামায়াতের পুরুষ রুকনদের চেয়ে মহিলা রুকনের সংখ্যাই বেশি।

জামায়াতের নেত্রীদের মধ্যে খুব পরিচিত বা নামকরা যাঁরা ছিলেন— যাঁরা একাধারে যেমন সংগঠক ছিলেন এবং লেখনীর মাধ্যমেও দাওয়াতি কাজ করেছেন, তাদের অন্যতম হলেন মুহতারিমা হাফেজা আসমা খাতুন, মুহতারিমা শামসুন্নাহার নিজামী; ওনাদের কেউই কিন্তু পাবলিক প্লেসে এসে বক্তৃতা করেননি। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে আলোচনা করেননি। তাঁরা তাদের ঝরঝরে লেখনী দিয়েই আ'মভাবে দাওয়াতে দীনের কাজ করে গিয়েছেন। আবার মহিলাদের অঙ্গনেও ব্যাপকভাবে তালিম-তারবিয়াত করেছেন। মা-বোনদেরকে ঈমান-আমল-আখলাকে গঠন পরিগঠন ও উজ্জীবিত করেছেন।

এই যে উল্লেখিত দুইজন সম্মানিতা ব্যক্তি, ওনারা উভয়ই জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি ছিলেন। ওনারা দায়িত্বে থাকাকালীন, বয়োবৃদ্ধ হবার পরেও কোনো ফিতনার জন্ম দেননি। শিবিরের ছেলেরা বয়সে তাদের সন্তানতূল্য হবার পরেও ছেলেদের প্রোগ্রামে তাঁরা এসে বক্তৃতা করেননি। তাদের উস্তাদা হিসেবে আবির্ভূত হবার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করেননি। প্রয়োজন মনে করেননি নিজেকে মিশরের ড. হেবা রউফ ইজ্জত কিংবা জয়নাব আল গাজালি বা হাল আমলের খাদিজা গরমেজ ও ইয়াসমিন মুজাহিদ হিসেবে উপস্থাপন করার। আগেই বলছিলাম, তাদের কেউই মিডিয়ায় এসে, চেহারা প্রদর্শন করে বক্তৃতা করেননি।

আর সত্যি বলতে কী, এটা আসলে ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েজও না। যদি এটা যুক্তির খাতিরে কিংবা ইখতেলাফপূর্ণ মাস'আলা হিসেবে শরীয়ায় জায়িজও হয়ে থাকে, তবুও তা কিন্তু তাক্বওয়ার খেলাপ। 

যারা বাহিরের উদাহরণ টেনে আনে, তাদের এই বিষয়ে স্বয়ং সাইয়েদ মওদূদী (রহ.)-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিষ্য, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমীর মুহতারাম আব্বাস আলী খান রহিমাহুল্লাহ বলেন— বাইরে কে কোথায় কোন দেশে কী করলো, কে কী বই লিখলো তা বড়ো কথা নয়। তাফহীমুল কুরআন আপনারা পড়েছেন, পড়ছেন, আরো পড়বেন। সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দু যদি মুখমন্ডল হয়, মুখ যদি বেশি আকর্ষনীয় হয় তাহলে তা সবসময় উম্মুক্ত রাখা হলে সঠিকভাবে পর্দা মানা হয় না।

শেষ কথা মনে রাখবেন, আল্লাহ যেন আমাদের কথা কাজে খুশি থাকেন—  এই প্রায়োরিটি সামনে রেখেই আমাদের সব কাজ করতে হবে।”

আমাদের কাছে একটা বিরাটরকমের অনুপ্রেরণার বিষয় হচ্ছে এই যে, আমরা পিচ্চিকালে যেসব মেয়ে শিশুশিল্পীদের ইসলামি গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি, তাদেরকেও পরবর্তীতে আর মিডিয়ার সেলিব্রিটি হিসেবে দাঁড়াতে দেখিনি। মনে আছে—  
আমরা হাসনাহেনা আফরিন, জনাবা খাদিজা আক্তার রেজায়ী এবং কয়েক বছর আগেও মারিয়া তাসকিন উমানির ইসলামি গানে ভীষণভাবে মুগ্ধ হয়েছি। সময়ের আবর্তে তাঁরা বড়ো হয়েছেন আর আল্লাহর বিধান পর্দার অন্তরালে নিয়ে গিয়েছনে নিজেদেরকে। 

আজকের সময়ের তুমুল  সাড়াজাগানো শিশুশিল্পী জাইমা নূরের মতো প্রতিভাবান শিল্পীকে যখন সাইফুল্লাহ মানসুর ভাইয়া জিজ্ঞেস করছেন যে, এক সময় তো তুমি বড়ো হয়ে যাবে, তখন তুমি কী করবে? তুমি তো তখন সবার সামনে এসে গান গাইতে পারবে না! তার উত্তর ছিলো খুবই সুন্দর এবং সিম্পল। সে বলেছে, আমি তো মুসলিম। আল্লাহর বিধান তো মানতেই হবে। আমি তখন আপুদের ও খলামানীদের সামনে তাঁদেরকে গান গেয়ে তো শোনাতে পারবো। এবং আমি তাদেরকেই শোনাবো। (এই টাইপের একটা সুন্দর উত্তর ছিলো। পুরোপুরি মনে নেই)।

এই যে, আমাদের দেশের এমন সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ একটা উদাহরণ, এখন এটাকে যদি আপনি চ্যালেঞ্জ করতে চান, আপনি যদি তাকে বা তাদের বলতে চান— দ্যাখো দ্যাখো অমুক দেশে তো এমন হয়, তমুক দেশে তো তমুকটা আছে, অমুক মহিলা স্কলার তো নিকাব করেন না, তমুকে তো পাবলিকলি লেকচার প্রদান করে, পুরুষের সাথে পাশাপাশি বসে আলোচনা করেন, ইখওয়ান কিংবা পবিত্র ভূমির অথবা তুর্কিয়েতে তো অনেকে জিন্স পরেই সাংগঠনিক কাজ করে; তুমি করলে সমস্যা কী? তুমিও করো। কিংবা আমিও করবো! এই যদি হয় আমাদের কারো চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি; তাহলে নিঃসন্দেহে এটা কোনো ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না। বিশৃঙ্ক্ষলার জন্ম দেবে তা। হবে সবদিকেই ক্ষতিকর।

এছাড়াও আপনি পক্ষান্তরে এমন দৃঢ় তাক্বওয়ার অধিকারী মানুষদেরকে ফতোয়ার বদৌলতে কিছুটা হলেও তাক্বওয়ার পথ থেকে, উত্তম আখলাক আর আমল থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন, অথচ আপনার ভাষা হচ্ছে আপনি নাকি আখলাক শেখান। তাক্বওয়ার পথ দেখান। আখলাক আর তাক্বওয়ার দাবিই তো হলো মানুষকে দিনে দিনে উন্নত মুসলিমে পরিণত করা। অথচ আপনিই বলুন, আপনার মাধ্যমে যাঁরা পূর্বের দীনি অবস্থান পরিবর্তন করছেন, করে যাচ্ছেন, তা কি আদৌ উত্তম কিছুর পরিচয় হচ্ছে? নাকি ফিতনারই সৃষ্টি হচ্ছে কেবল? অথচ রাব্বে রাহিম পবিত্র কুরআনে বলেছেন,"ফিতনা হত্যার চেয়েও জঘন্য" (সূরা আল-বাকারা:১৯১)।

 সেজন্য আমার কথা হলো ফিতনা-ফাসাদে না জড়িয়ে আমাদের মূলনীতি-কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে হলে আর কিছু না হোক, অন্তত স্থানীয় বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই ঠিক করতে হবে। তাক্বওয়ার মানদণ্ডে যেটা উন্নত আর উত্তম, সেটাকে মাথায় রেখেই ঠিক করতে হবে। যদি এমনভাবে কাজ করতে পারেন, তাহলে এতে অনেক ফাসাদের মুখোমুখি হওয়া থেকে মুক্ত থাকা যাবে, যায়ও।

তবে শেষ পর্যায়ে আবারও বলি, আমাদের জন্য আদর্শের সর্বোচ্চ সুন্দর নমুনা যেটা, তাকওয়াপূর্ণ উদাহরণ যা, সেটাই গ্রহণ করা উচিৎ নয় কি? বিবেক কী বলে? নাকি অন্যকোনো দলের অথবা দেশের  মডারেটপূর্ণ অবস্থান, শিথিলতাপূর্ণ দিকগুলোর আমলই আমরা গ্রহণ করবো? একঝাঁক দীন প্রতিষ্ঠাকাঙ্ক্ষী নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনীর কোন বিষয়টা গ্রহণ করা উচিৎ? 


~রেদওয়ান রাওয়াহা
২০/০১/২২ ইং

Comments

  1. মাশাআল্লাহ্ ❤! চমৎকার বিশ্লেষণ। আরশের মালিক লেখনীতে বারাকাহ দান করুন (আমীন)!

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ