১১-ই মার্চ: শিবিরের শহীদ দিবস








শিবিরের প্রতিষ্ঠা :

সারা-বিশ্বে তখন সমাজতন্ত্র কমিউনিজম ও নাস্তিক্যবাদের ছড়াছড়ি। মুসলিম যুবক আর তরুণরা দিনকে দিনকে নিজেদের আত্মপরিচয় বিস্মৃত হতে থাকে। আর ঠিক তখনই আত্মভোলা মুসলিম তরুণ সমাজের মধ্যে আত্মপরিচয় জাগিয়ে তুলতে, তাদের হৃদয় গহীনে দ্বীনের উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে দিতে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। 

শুরু হয় ষড়যন্ত্র

জীবন্ত ধর্ম দ্বীন ইসলামের বাণী যখন ছাত্রসমাজের কাছে বিদ্যুৎ-বেগে পৌঁছাতে লাগলো, মেধাবী ও তরুণ ছাত্রসমাজ যখন দলে দলে ছাত্রশিবির নামক আলোর কাফেলার পতাকাতলে সমবেত হতে শুরু করলো, তখনই শুরু হয় শিবিরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। 

১১ মার্চ ১৯৮২ 

১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অনেকবার আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। কিন্তু এর আগে আর কখনো শহীদ হয়নি সংগঠমের কোনো কর্মী। ১১ মার্চ ১৯৮২ সালেই  ছাত্রশিবিরের শহীদদের সবুজ কাফেলার যাত্রা শুরু। 

কী হয়েছিলো সেদিন? 

ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর ঈমানদার ছাত্রসমাজের প্রিয় কাফেলা, আদর্শের অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সারাদেশের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও দ্বীনের পথে ছাত্রসমাজকে আহ্বান জানানোর কাজ করে যেতে লাগলো। তারই ধারাবাহিকতায় তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।


বাধ সাধে বর্বর রাম-বাম ও সন্ত্রাসী সেক্যুলাররা 

নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পূর্ব দিন ছিলো বুধবার। বুধবার থেকেই ইসলামী আদর্শ বিরোধী ও বিদ্বেষী সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা দুষ্কৃতকারী হেলালের নেতৃত্বে শিবিরের কর্মীদের হেনস্তা করা হয়। তাদের হাত থেকে ডাকাতের মতো লিফলে-প্রচারপত্র কেড়ে নিয়ে ছিড়েও ফেলা হয়।


অসীম ধৈর্যের অনুপম নজীর স্থাপন : 

শিবিরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গঠিত ছাত্রলীগ ও বাম-রাম সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সম্মিলিত আক্রমণ এবং উস্কানিমূলক কার্যক্রমের মধ্যেও শিবির কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেনি। ছাত্রশিবির তাদের এহেন আচরণের জবাব না দিয়ে ধৈর্য ধারণ করে নবীন বরণ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌঁছানোর কাজে মনোযোগ প্রদান করে। মনোযোগ দেয় জীবন্ত দ্বীন আল-ইসলামের বাণীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নবাগত ছাত্রদের কর্ণকুহরে পৌঁছে দেওয়ার মহান উদ্দেশ্যের দিকে।


সহনশীলতা জবাবে সন্ত্রাসী :

ইসলামী ছাত্রশিবির যখন ধৈর্য আর সহনশীলতার অনুপম নজির স্থাপন করে নবীন বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজনের দিকে মনোযোগী, ঠিক সেই মুহূর্তেই দুর্বৃত্তদের মনে চলছে বিতাড়িত মরদুদ ইবলিশ শয়তানের কুমন্ত্রণা। 

অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবির নেতাকর্মীদের চোখমুখে আজ আনন্দের উজ্জ্বলতা। তাদের চোখমুখে যেনো স্বপ্নের ভিড় লেগেই আছে। আজকে তারা রাম-বামদের প্রাণকেন্দ্র মতিহারের প্রতিটি ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কানে কানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ইথারে ইথারে পৌঁছে দেবে শাশ্বত সুন্দর জীবন বিধান আল-ইসলামের অমীয় বাণী! 

ইসলামী আদর্শের ঝাণ্ডাবাহী, বিশ্বাসী তরুণ-প্রাণের প্রিয় কাফেলা ছাত্রশিবিরের আয়োজিত প্রোগ্রামে চতুর্দিক থেকে নবীন ছাত্রদের ভিড় জমতে থাকে।   সকাল নয়টা থেকে তাদের প্রোগ্রামের শুরু হবে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে। কুরআনের সুললিত ও সুমধুর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠবে মতিহারের সবুজ চত্ত্বর। 


প্রোগ্রাম শুরুর একটু পরে :

একপাশে শিবিরের অনুষ্ঠানে ছাত্রজনতার ঢল, ঠিক বিপরীত পাশেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিরীহ শিবিরের নেতাকর্মীদেরকে খুন করার উত্তাল উন্মাদনায় জড়ো হতে লাগলো ইসলামী আদর্শের অগ্রসেনানীদেরকে নিশ্চিহ্ন করার নিকৃষ্ট উদ্দেশ্যে গঠিত রাম-বাম-সেক্যুলার আদর্শের সন্ত্রাসী ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগ-সহ তাদের কথিত সংগ্রাম পরিষদ। 

এই কথিত সংগ্রাম পরিষদের বর্বর খুনি সন্ত্রাসীরা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে শিবিরের প্রোগ্রামে গণ্ডগোল সৃষ্টি করে। শিবির তাদেরকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করে। তারা চেয়েছিলো কোনো প্রকার হাঙ্গামা আর রক্তপাত ছাড়া অনুষ্ঠান শেষ করতে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করা যায়নি।


আনা হলো বহিরাগত সন্ত্রাসীও :

সেদিন শিবিরকে নিশ্চিহ্ন করার হিংস্র উদ্দেশ্য থেকে তারা বাইরে থেকেও অনেকগুলো বাসের মাধ্যমে প্রায় ছয়শত সন্ত্রাসীকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনলো। এসেই তারা কেন্দ্রীয় মসজিদের কাছে অবস্থানরত শিবির কর্মীদের ঘিরে ধরে আক্রমণ শুরু করলো।

তারপর লাল সন্ত্রাসীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো সরাসরি প্রোগ্রামস্থলে। সেখানে গিয়ে এবার ঠান্ডা মাথায় তারা শিবিরের নেতাকর্মীদেরকে রামদা-রড-ছোরা-বল্লমসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নির্মম আর পৈশাচিকভাবে খুন আর জখম করতে লাগলো !

নরঘাতকদের নির্দয় আক্রমণের মুখে পড়ে ছাত্রজনতা গগণবিদারী চিৎকারে ছুটে চললো দিকবিদ্বিক। শিবির কর্মীদেরকে ইট পাথর বৃষ্টির মতো নিক্ষেপ করতে লাগলো এসব সন্ত্রাসীরা।

আআত্মরক্ষার জন্য অনেকেই তখন মেইন গেটের পাশে বি.এন.সি.সির ভবনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। 
দরজা বন্ধ করেও রক্ষা হলো না শিবিরের। কারণ, সন্ত্রাসীরা দরজা ভেঙেই ঢুকে পড়লো ভেতরে। ঢুকেই লাঠি, ইট, হকিস্টিক, রামদা, কিরিচ ও চাইনিজ কুড়াল দিয়ে বেধড়ক মারধর করে নীরিহ শিবির কর্মীদের। অনেককে নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাতও করা হলো। রক্তে ভেসে ওঠলো পুরো পুরো কক্ষ।

সন্ত্রাসী সংগঠন কর্মীরা শিবির নেতা আব্দুল হামিদকে ধরে  এনে মাথার নিচে একটি ইট রেখে আরেকটি ইট দিয়ে তার মাথাটা চূর্ণবিচূর্ণ করে থেতলে ফেলে।


শিবিরের ইতিহাসে প্রথম শহীদ :

এমন বর্বরোচিত ও অমানবিক নিষ্ঠুর হামলায় অসংখ্য শিবির নেতাকর্মীর আহত হলো। আহত মজলুম ভাইদের নেওয়া হলো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালে তখন ছুটে এলেন অনেকের স্বজনরা। সে হিসেবে তখন হাসপাতালে আসলো সাব্বির আহমেদের বাবাও। সাইকেল চালিয়ে তিনি হাসপাতালে এসেই দেখলেন তার ছেলে সাব্বির শাহাদাতের অমিয় সুধা পানে ধন্য হলো। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১১টা। হুবহু সেই সময়ই শিবিরের ইতিহাসে যুক্ত হলো শহীদের এই নবাগত তালিকা। আর এই তালিকায় প্রথম নাম লেখালেন শহীদ সাব্বির আহমেদ। রহিমাহুল্লাহ।

পরদিন ১২-ই মার্চ মাথার মগজ চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া আব্দুল হামিদও পথ ধরলেন সাব্বির আহমেদের। শাহাদাতের সরাব পান করলেন তিনিও।

হকিস্টিকের আঘাতে জর্জরিত হয়ে চোখমুখ ফুলে বীভৎস হওয়া আইয়ুব আলীর শাহাদাতের সংবাদও ইতোমধ্যে হাসপাতালের পক্ষ থেকে জানানো হলো। এভাবে পরপর তিনটি মেধাবী তরুণ তাজা প্রাণ নিষ্প্রভ হয়ে যায় বাম দুর্বৃত্তদের সন্ত্রাসী হামলায়।

আহত ভাইয়েরা ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে। কিন্তু আব্দুল জব্বার ভাই নামক একজন সুস্থ হলো না। সেদিনের হামলায় আহত আর ক্ষতস্থানের যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করে দীর্ঘদিন কাটানোর পরে সে বছরের ২৮ ডিসেম্বরে নিজ বাড়িতে ১১:৪০ মিনিটে দুনিয়া ছেড়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। ইন্না-লিল্লাহি ওইন্নাইলাইহি রাজিউন।

প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা:

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই পুলিশ অবস্থান করলেও পুলিশকে ততকালীন ভিসি নীরিহ ও নিরস্ত্র শিবির কর্মীদের ওপর হামলা বন্ধের কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুমতি দেননি।


হামলাকারী কতিপয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের নাম:

নৃশংসভাবে নিরস্ত্র ছাত্রশিবিরের ওপর হামলা করে শহীদ  করা কতিপয় খুনির নাম হলো: ছাত্র ইউনিয়নের হেলাল, ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি শিশির, ছাত্রলীগের রানা, আজাদ, সাকুর, ফজলে হোসেন বাদশা, করীম শিকদার, কাদের সরকার, জাসদের ফিরোজ প্রমুখ।

এতোগুলো তরুণ তাজা প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পরেও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নামক তৎকালীন সন্ত্রাসী ও ক্যাডারদের উপযুক্ত কোনো শাস্তি প্রদান করা হয়নি।

তবে, আল্লাহর আদালত থেকে এসব উগ্রবাদী সেকুলার ও বাম দুর্বৃত্তরা রেহাই পাবে না ইন শা আল্লাহ! 

[বি:দ্র: এই লেখাটি শহীদ দিবস উপলক্ষ্যে ভিডিও - ডকুমেন্টারি বানানোর জন্যে লেখা হলো। ইন শা আল্লাহ  এগারো তারিখ সেটা পাবলিশ হবে।]


Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ