"দুটো বিষয়ই যদি জায়েজ হয় : এক্ষেত্রে করণীয় কী?"
ইসলামি শরীয়ায় দুটো জিনিসই যদি জায়েজ হয়, সে দুই জায়েজ জিনিসের কোনো একটি বিষয় যদি কোনো একটি অধিক প্রচলিত থাকে, থাকে প্রতিষ্ঠিত, তো সে সমাজে বা সে অঞ্চল কিংবা দেশে সেটার মধ্যে অন্য আরেকটা জিনিস ফতোয়া দিয়ে ঢুকিয়ে সমাজের মধ্যে বিভেদ-বিশৃঙ্ক্ষলা সৃষ্টি না করাটাও এক উত্তম আখলাকের পরিচয়। এক জায়েজ-এর ভেতর অন্য কম-প্রচলিত, অপ্রতিষ্ঠিত জায়েজ বিষয়টাকে ফতোয়া দিয়ে প্রচলন করতে চাওয়া, প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করতে চাওয়াটা কখনোই ভালো আর উম্মাহ দরদী বিচক্ষণ মানুষের পরিচয় হতে পারে না। এসব যারা করে, এদের নিয়ত যা-ই হোক, এরা আদতে ফিতনাবাজ। উম্মাহর মধ্যে সংকট সৃষ্টিকারী, বিশৃঙ্খলা তৈরিকারী। এদেরকে কোনো ধরনের স্পেস না দেওয়াটাই কল্যাণকর!
যেমন ধরুন, তারাবিহর সালাত, এটা ৮/২০ সবই জায়েজ এবং সুন্নাহভিত্তিক আমল।কিন্তু এখন যেখানে নিয়মিত ইখলাস-সহকারে বিশ রাকাআত হয়, কেউ যদি এখন এখানে অতি শুদ্ধবাধিতা দেখাতে এসে আট রাকাআত চালু করতে চায়, সে নিঃসন্দেহে ভুল কাজ করবে। তার দ্বারা অন্তত ঐক্য আর কল্যাণ বয়ে আসবে না মুসলিম উম্মাহর মধ্যে।
আবার ধরুন, নারীদের নিকাব করা, অধিকাংশ আলিমের মত হচ্ছে নিকাব করতে হবে। মুখখোলা রাখা যাবে না। কিংবদন্তী ইমাম মওদূদীর মতও তা। এবং অধিক সত্য আর ইখলাস এবং তাক্বওয়াওয়ারও অধিক নিকটবর্তী বিষয়ও হচ্ছে তা! কিন্তু এর বাহিরেও কিছু কিছু আলিম শর্তসাপেক্ষে মুখখোলা রাখার অনুমোদন দিয়েছেন বা মতামদ প্রদান করেছেন। এখন যেখানে নিয়মিত অধিকাংশ নারীই নিকাব করেন, মুখ ঢেকে পর্দা করেন, আপনি অতি উদারবাদিতা আর সহজীকরণের নামে, কিংবা কথিত ইন্টেলেকচুয়ালিটি প্রদর্শন করতে গিয়ে যদি বলেন যে নাহ এটাও জায়েজ, তুমি তা করো।
আপনি যদি তাদেরকে দলিল-আদিল্যা দেখিয়ে বলেন যে, দ্যাখো, অমুক স্কলার এটা বলেছেন, তমুক স্কলার সেটা বলেছেন। এই যে উনিও জায়েজ বলেছেন; এই যদি হয় আপনার চিন্তা ও কর্ম এবং অবস্থান- তবে নিঃসন্দেহে আপনি ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছেন এবং বড়োসড়ো একটা বিশৃঙ্খলার উস্কানি দিচ্ছেন। আপনি ফতোয়ার বদৌলতে তাক্বওয়ার নিকটবর্তী অবস্থান থেকে মানুষকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করতেছেন। অথচ একজন ভালো মুসলিম হিসেবে আপনার কাজ ছিলো ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে ইখলাস আর তাক্বওয়ার উন্নতি ঘটানো। আখলাকি সংকট দূর করতে গিয়ে নিজেই এক প্রকার আখলাকি সংকট সৃষ্টি করছেন। যেটা কখনোই উম্মাহর জন্য কল্যাণকর নয়।
আপনি যাদেরকে আলিমদের ভিন্নমত দেখাচ্ছেন, আপনার উচিৎ হচ্ছে তাঁদের মতামত পরিপূর্ণভাবেই দেখানো ! মনে করুন যারা চেহারা খোলা রাখার পক্ষে, তাঁরা কিন্তু আজকের যুগে যেভাবে সাজগোজ করে সৌন্দর্যের সর্বোচ্ছটুকুন প্রকাশ করে চেহারা প্রদর্শন করা হয়, এটার পক্ষে না। কুরআনের সেন্স থেকেও এই বিষয়টি উপলব্ধ হয়। চেহারা খোলা রাখতে হলে কোনো ধরনের প্রসাধনী এবং সৌন্দর্য-বিকাশের সব কিছু হাইড করেই স্বাভাবিকভাবেই খোলা রাখাতে হবে বা প্রকাশ করতে হবে। এই মূল বিষয়!
কিন্তু আপনি আলিমদের এইসব মতামত কি সামনে আনেন? আনেন না, বরং এতোটুকুই আনেন, যেটাতে শুধুই চেহারা প্রদর্শনের অনুমতি আছে। এটা উচিৎ নয়।
আপনি যদি আমাদের সালাফদের জীবনীর দিকেও তাকান, দেখবেন যে, যেখানে যেই আমল ( শরীয়ত সম্মত বা ইখতেলাফি আমল) প্রচলণ আছে, সেখানে গেলে আমাদের সালাফগণ উক্ত আমলটাকেই প্রাধান্য দিতেন। তাকওয়ার নিকটবর্তী আমলটাকেই নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতেন। যেমন আসরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাধারণত নফল নামায পড়া মাকরূহ।
এ ভিত্তিতে ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয় যে, যদি কোনো ব্যক্তি আসরের নামাযের পর (যেমন ধরুন, মগরিবের আযানের বেশ কিছুক্ষণ আগে) মসজিদে প্রবেশ করে, তার জন্য তাহিয়্যাতুল মসজিদের নামায পড়া জায়িয হবে কি না?
এ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মালিক (রাহ.) প্রমুখের মতে- আসরের নামাযের পর কোনো ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করলেও তার জন্য তাহিয়্যাতুল মসজিদের নামায পড়া জায়িয নয়; পক্ষান্তরে ইমাম শাফি‘ঈ (রাহ.)-এর মতে তা জায়িয।
একবার ইমাম মালিক (রাহ.) আসরের নামাযের পর মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলেন এবং তিনি তাঁর মতানুসারে তাহিয়্যাতুল মসজিদের দু রাক‘আত নামায না পড়েই বসে গেলেন। এ সময় একজন বালক ——যে শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী এবং যেখানে আসরের সালাতের পরে মসজিদে ঢুকে সালাত আদায় করে না মুসল্লিগণ——তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “শাইখ! ওঠে দু রাক‘আত নামায আদায় করুন!”
আচ্ছা, প্রশ্ন আসেনা যে, মুহতারাম ইমাম তখন কী করলেন? হ্যাঁ, তিনি সেখানে যে ইমামের মতটা প্রচলিত বা বেশি চলে, সে অনুযায়ীই আমল করলেন। নিজের অহংবোধ আর আভিজাত্য ধরে রাখার জন্যে তিনি চুপসে থাকেননি। ওই বালকের ওপর তেঁতে যাননি। তিনি তৎক্ষণাৎ ওঠেই দু রাক‘আত নামায আদায় করলেন।
এখন আমাদের ওলামায়ে কেরাম ২০ রাকাআত তারাবিহর পক্ষে, পর্দার ক্ষেত্রে চেহারা ঢেকে রাখার পক্ষে, এবং চেহারা ঢাকাকে ফরজ মনে করেন, ফ্রি-মিক্সিং তথা ছেলে-মেয়ের একসাথে প্রোগ্রাম করাকে হারাম মনে করেন, আপনি ইন্টালেকচুয়ালিটি দেখাতে গিয়ে অমুক দেশের তমুক স্ক্লারের উদাহরণ আনলেন, এনে এটা অনুযায়ী আমলের উৎসাহ দিলেন, এটা কখনোই উত্তম আখলাকের পরিচয় নয়। আমাদের সালাফরা এমনটা করেননি, যেমনটা আপনারা বা আমরা করি!
Comments
Post a Comment