সাঈয়েদ কুতুব শহীদ : ইনকিলাবের ইমাম




সাঈয়েদ কুতুব ছিলেন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর একজন মুখলিস মুজাহিদ। তিনি ছিলেন ইসলামি জাগরণ বা মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূত। তাঁর চিন্তাধারা, তাঁর লেখাজোখায় মুসলিমদের জং ধরা কলবে এক তীব্র ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়। আত্মভোলা মুসলিমদের তিনি ঝাঁঝালো কলম দিয়ে জাগ্রত করেন। তাঁর এই জাগরণী জোয়ার রুখে দেওয়ার জন্যে তৎকালীন মিশরীয় স্বৈরাচার, ইসলাম বিরোধী অপশক্তিদের ক্রীড়নক সরকার ১৯৬৫ সালের ২৯-শে আগস্টে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর এই অধিনায়ক, তাকওয়াবান তাত্ত্বিক, কুরআনে হাফেজ নেতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করে দেয়। খোদাদ্রোহী জালিমদের দ্বারা বিচারিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ইনকিলাবের এ ইমাম। 


সাঈয়েদের যে বইটা পৃথিবীর সকল খোদাদ্রোহী জালিমদের কলিজায় কম্পন আর ভীতির সৃষ্টি করে, সে বইটা হচ্ছে معالم فى الطريق -ইংরেজি: Milestones, যেটা বাংলায়  "ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা"। সাঈয়েদের চিন্তার সাথে পরিচিত হতে তাঁর রচিত তাফসীরগ্রন্থ ফি যিলালিল কুরআন এবং উক্ত বইটা অধ্যয়ন করা আবশ্যক।


কারণ, معالم فى الطريق নামক এই একটা বই, এই একটা তত্ত্ব তাঁকে শাহাদাতের পেয়ালা পান করিয়েছে।


কুতুবের লেখনি এতোটাই শক্তিমান ছিলো যে, যে ব্যক্তিই তাঁর লেখাগুলো বা তাঁর বই অধ্যয়ন করতো, সে-ই তাঁর আদর্শ এবং চিন্তার অনুসারী হয়ে যেতো। সেজন্যই যখন সাঈয়েদকে শহীদ করা হয়, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়, সেদিন হাইওয়ানেরা তাঁর রচিত তাফসির 'ফি যিলালিল কুরআন'-এর প্রায় ৬৪ হাজার ভলিয়ম পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।


রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়- যার কাছে সাইয়েদ কুতুবের কিতাবাদি পাওয়া যাবে তাঁকে দশ বছর জেল হাজতে থাকতে হবে।


জালিমদের এই ঘোষণা উস্তায কুতুবের প্রতি মানুষের কৌতূহলের পারদ আরো বাড়িয়ে দেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে যে বছর সাইয়েদ কুতুবকে শহীদ করা হয়  সে বছরেই যিলালিল কুরআনের সাত সংস্করণ ছাপা হয়। উস্তায সাঈয়েদ কুতুবের চিন্তাগুলো ছড়িয়ে পড়ে বারুদের মতো। তিনি মানুষের অধঃপতনের সুলুক সন্ধান করতে পারেন। তাই তো তিনি বলেন, মানবজাতি আজ যে বিপদের সম্মুখীন তার মূল কারণ হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের সার্বিক উন্নয়ন ও সত্যিকার অগ্রগতির জন্য জীবনের যে মূল্যবোধ প্রয়োজন, তা হারিয়ে ফেলেছে। পশ্চিমের প্রতি আমাদের যে রাশি রাশি মুগ্ধতা, তাদের সভ্যতাকে যেভাবে আমরা শ্রেষ্টত্বের আসনে সমাসীন করিয়ে রেখেছি, তাদের বেঁধে দেওয়া সভ্যতার যে ফ্রেম আমরা এঁটে রেখেছি মগজের ভাঁজে ভাঁজে, সাঈয়েদ কুতুব আমেরিকায় পড়েও সেরকম হননি। বরঞ্চ তিনি তাদের বস্তুবাদি সভ্যতার যে অসারতা, সেটা বুঝতে পারেন, সে বিষয়ে জনতাকে সচেতনও করেন। তিনি ইসলাম ছাড়া সভ্যতার কোনো কনসেপ্টকে স্বীকারই করতেন না। তিনি বলেন, ইসলামই সত্যিকারের সভ্যতা । একমাত্র ইসলামী সমাজই সুসভ্য সমাজ !


ইনকিলাবের এই ইমাম জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯০৬ সালের ৯ অক্টোবর মিসরের উসইউত জেলার মুশা নামক গ্রামে । তাঁর মহীয়সী মায়ের আগ্রহেই ছোটবেলাতেই তিনি কুরআনে হাফেজ হন। এরপর গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ভর্তি হন তাজহিযিয়াতুদ দারুল উলুম মাদরাসায়। অতঃপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন কায়রো দারুল উলুম থেকে। এরপর তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমান উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে। দেশে ফিরে এসে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। তবে তিনি তাত্ত্বিকতায় কিংবা লেখালেখিতেই সীমিত থাকেননি। তিনি ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলনে নিবেদিত হন। নিয়োজিত হন জিহাদ ফি সাবিল্লাহর আন্দোলনে। আর এই আন্দোলন ও লেখালেখিই তাঁর জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় ( যদিও শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা সর্বোচ্চ সাফল্য), হয়ে পড়েন তিনি ফেরাআউনি প্রেতাত্মাদের চক্ষুশূল। যার জন্যে তাঁকে জালিমেরা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। মুছে দিতে চেয়েছে তাঁর চিন্তা ও আদর্শকে এই জমিন থেকে। কিন্তু 

আজকে এতোটা বছর হলেও সাঈয়েদ আমাদের হৃদয় থেকে মুছে যায়নি। তাঁর চিন্তার প্রভাব কমে যায়নি। বরঞ্চ ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর চিন্তা, তাঁর আন্দোলন ও আদর্শ।  আল্লাহ তা’আলা ইনকিলাবের এই মহান ইমামকে এবং তাঁর সকল কাজকে কবুল করুন। সাথে সাথে আমরাও যেনো তাঁর রেখে যাওয়া বাকি কাজটুকুন বাস্তবায়ন করতে পারি, অন্ততপক্ষে তাঁর সেই সংগ্রাম মুখর পথে যেন অনড়-অবিচল থাকতে পারি। আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন।  আ-মী-ন!


~রেদওয়ান রাওয়াহা

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ