"শাইখুল মুজাহিদিন উমর আল মুখতার রহিমাহুল্লাহ”







মরু সিংহখ্যাত শাইখুল মুজাহিদিন উমর মুখতার রহিমাহুল্লাহ। তিনি ২০ আগস্ট ১৮৫৮ (মতান্তরে ১৮৬২ সালে) সালে লিবিয়ার সিরনিকার আল-বুতনান জেলায় জানযুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
আল্লাহর দ্বীনের এই মুজাহিদ, দখলদার ও সাম্রাজ্যবাদীদের এই ত্রাশ ছোটোবেলায়ই নিজ বাবা-মাকে হারান।
তাঁকে লালনপালন করেন শারিফ আল গারিয়ানী নামক এক ব্যক্তি। মূলত উমর আল মুখতারের বাবা মারা যাওয়ার পরে এতিম উমর আল মুখতারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শারিফ আল-গারিয়ানি।
দখলদারদের জম এই মর্দে মুজাহিদ ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টম্বর সাম্রাজ্যবাদী দখলদার ইতালীয় কা ফি র সেনাদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাতের অমিয় সুধা পানে যখন তিনি ধন্য হন, সে সময় তাঁর বয়স ছিলো ৭২ বছর।
মরু সিংহ উমর মুখতারের জীবনটাই কেটেছে দাওয়াত-তারবিয়াত ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মাধ্যমে। তিনি ১৮৯৯ সালে সুদান থেকে সাম্রাজ্যবাদী বর্বর ফরাসি কা ফি র দের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য চাদে গিয়েছিলেন। উসমানি সালতানাতের পক্ষেও তিনি একইভাবে জি হা দ করেছেন।
মুসলিম ভূখণ্ড দখলকারী সা ম্রা জ্য বা দি ক্রু সে ডার সেনারা যখন উমর আল মুখতারকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে, তখন মানবতার দুশমন মুসোলিনির ইটালিয়ান এক সেনা অফিসার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলো:
তুমি কি জানো তোমার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড?
জবাবে উমর মুখতার বলেছিলেন, হ্যাঁ জানি।
ওই অফিসার বললেন—তুমি যা করেছো সেটার জন্য তুমি কি অনুতপ্ত?
উমর মুখতার বললেন:
প্রশ্নই হয় না, আমি আমার ভূখণ্ড আর মানুষের জন্য লড়েছি।
সেনা আদালতের বিচারক তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে— তোমার মতো লোকের এমন পরিণতি দেখে আমি দুঃখিত।
শাইখুল মুজাহিদিন বললেন,
"কিন্তু এটাই তো জীবন শেষ করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। মহান আল্লাহ তাআলাকে ধন্যবাদ তিনি আমাকে এভাবে বীরের মতো শহীদ হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন।”
এরপর বিচারক তাঁকে অফার দিলো যে, তাঁকে মুক্ত করে দেওয়া হবে যদি তিনি মুজাহিদদের কাছে এই মর্মে চিঠি লেখেন যেন মুজাহিদরা তাদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করে। তখন উমর মুখতার বিচারকের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন:
"যেই শাহাদাত অঙ্গুলি দিয়ে আমি প্রতিদিন সাক্ষ্য দেই যে এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। সেই আঙ্গুল দিয়ে অসত্য কোনো কথা লিখতে পারবো না। আমরা এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে আত্মসমর্পণ করি না। আমরা হয় জিতি, না হয় মরি।"
সত্যিই তিনি প্রাণভয়ে ভীত হয়ে বাতিলের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন— হয় জিতি না হয় মরি ! এই মরাটাও কিন্তু এক প্রকার জিতে যাওয়া। যেই জেতাটা অনন্তকালের জন্য! যার চূড়ান্ত সমাপ্তি হয় জান্নাতুল ফিরদাউস প্রাপ্তির মাধ্যমে।
 আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, এই মহান মানুষটি শৈশবেই নিজ পিতা-মাতাকে হারান। তাঁর বাবা মারা যান তখন, যখন তাঁর বয়স মাত্র ষোলো বছর। তিনিও ছিলেন একজন সৌভাগ্যবান সুপুরুষ, হজ করতে গিয়েই তিনি ইন্তেকাল করেন।
লিবিয়ায় সেনুসি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন হুসেন আল-গারিয়ানি। তিনি শারিফ আল-গারিয়ানির চাচা। ১৮৪৪ সালে লিবিয়ার বেইদাতে তিনিই সাইয়িদ মুহাম্মদ ইদ্রিস বিন মুহাম্মদ আল-মাহদি আস-সেনুসির সাথে মিলে সেনুসি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ছিলো লিবিয়ার বেইদাতে সর্বপ্রথম কোনো সেনুসি মাদ্রাসা।
উমর আল-মুখতার রহ. সেনুসিদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ। জাগবুবের সেনুসি বিশ্ববিদ্যালয়েও ৮ বছর পড়াশোনা করেন তিনি। তখনই তিনি পবিত্র কুরআনুল কারিম হিফজ সম্পন্ন করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করার পরে তিনি স্থানীয় সেনুসি বিদ্যালয়ে কুরআনের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা, চাকরি; ইত্যাদি সবকিছুতেই তাঁকে পরিপূর্ণ তত্ত্বাবধান করেন শরিফ আল গারিয়ানি।
শাইখুল মুজাহিদ সব সময়ই একজন আবেদ ইনসান ছিলেন। অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর জীবনী রচয়িতাদের ভাষ্যমতে —তিনি পাঁচ ওয়াক্ত সলাত জামাতের সাথেই আদায় করতেন। ইবাদাত-বন্দেগি এবং কাজকর্মে এত বেশি নিবেদিত থাকতেন যে, রাতে তিনি তিন-চার ঘণ্টার বেশি ঘুমোতেনই না।
শুরু থেকেই তাঁর জীবন অতিবাহিত হতো সত্যিকারের মুজাহিদদের মতো। তাঁর রাতের শেষাংশ কাটতো তাহাজ্জুদের জায়নামাজে। এমনও শোনা যায় যে, প্রতি সপ্তাহে তিনি একবার পবিত্র কুরআন মাজিদ খতম করতেন। দ্বীনি ইলমে তাঁর ছিলো অগাধ গভীরতা এবং শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন তিনি স্বনামধন্য ও সুপ্রতিষ্ঠিত। যার কারণে সেনুসি কর্তৃপক্ষ তাঁকে কুরআনের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে সুদানে প্রেরণ করে।
সুদানে যাওয়ার কয়েক বছর পরেই তিনি (১৮৯৯ সালে) স্রমাজ্যবাদি বর্বর ফরাসি কা ফি র দের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সেনুসিদের প্রধান, মোহাম্মদ আল-মাহদির নির্দেশে সেনুসি মুজাহিদদের সাথে চাদে গিয়েছিলেন।
১৯১১ সালে ইতালিয়ানরা লিবিয়া আক্রমণ করে। লিবিয়া ছিলো তখন উসমানি সালতানাতের অধীন। ইতালিয়ানরা লিবিয়ার উপকূলে এসে উসমানি সুলতানের কাছে লিবিয়াকে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, উসমানি সালতানাতের খলিফা তখন কোনো ধরনের প্রতিরোধ না করে ইতালিয়ানদের সাথে সমঝোতায় যান, এবং লিবিয়ার একটা অংশকে ইতালির হাতে তুলে দেওয়ার আগ্রহ পোষণ করে।
সা ম্রা জ্য বা দিরা এতেও তুষ্ট হয়নি। যার প্রেক্ষিতে তারা লিবিয়ার ত্রিপলী এবং বেনগাজীতে আক্রমণ শুরু করে। টানা তিন দিন ধরে তারা ত্রিপলী এবং বেনগাজীতে জাহাজ থেকে বোমা বর্ষণ করতে থাকে।
এই যখন অবস্থা, তখন বাধ্য হয়েই প্রতিরোধ-যুদ্ধ শুরু করে উসমানি সৈনিকরা। এরপর মুসলিম ভূখণ্ড কা ফি র দের হাত থেকে রক্ষার্থে তাদের সাথে যোগ দেন স্থানীয় লিবিয়ান এবং সেনুসি সৈন্যরা।
যখন যুদ্ধ ‍শুরু হয়, সে সময়টাতে উমর মুখতার এখানে ছিলেন না। তিনি যখন খবর পেয়েছেন, তখন তিনি ইতালীয় কা ফি র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জি হা দ করার জন্যে একদল মুজাহিদকে সাথে করে নিয়ে আসেন এবং বীর বিক্রমে সিংহ গর্জনে দখলদারদের বিরুদ্ধে জি হা দ করে যান।
১৯১১ সাল থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত টানা বিশটা বছর লড়াই করার পরে ১১-ই সেপ্টম্বর তিনি দখলদার হাতে বন্দি হন। দখলদাররা অনেক চেষ্টা করে তাঁকে বশে আনতে। কিন্তু এই মুজাহিদ-নায়ককে কোনোভাবেই বশে আনতে না পারায় ১৬-ই সেপ্টেম্বরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়।
তাঁর মৃত্যুদণ্ড স্বচক্ষে অবলোকন করতে আসে একজন ইতালীয় কা ফি র জেনারেল। তখন সে এই মুজাহিদ-নায়ককে জিজ্ঞেস করে— তোমরা আসলেই কি ইতালির মতো একটা পরাশক্তির বিরুদ্ধে যু দ্ধ করে বিজয়ী হবার আশা করছো? এর জবাবে উমর মুখতার রহিমাহুল্লাহ যা বলেন, তা অনন্তকাল অবধি আল্লাহর দ্বীনের মু জা হিদ দের ঈমানের অগ্নিস্ফুলিঙ্গটা দাউদাউ করে জ্বালিয়েই যাবে।
তাঁর উত্তরটা ছিলো এমন—
“যুদ্ধ করাটা আমাদের কর্তব্য, আর বিজয় আসবে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে।”
আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে এই মর্দে মুজাহিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন। আ-মী-ন !!

~ রেদওয়ান রাওয়াহা

https://t.me/RedwanRawaha

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ