ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজে একজন আদর্শ মুসলিমের করণীয় কী?
পশ্চিমা এনলাইটেনমেন্টের কাছে ইসলামি বিশ্ব পরাজয়ের আগ পর্যন্ত মুসলমানদের দীন ও রাষ্ট্র কখনো আলাদা ছিলো না। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো বিভাজন ছিলো না। কিন্তু যখনই পাশ্চাত্য সভ্যতা বিজয়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, তখনই তারা তাদের নির্জীব ধর্ম থেকে রাষ্ট্রেকে পৃথক করে ফেলে। ধর্মকে তারা এক প্রকার বন্দী করে ফেলে। সেই থেকে তাদের জীবন-দর্শনে ভোগবাদ-বস্তুবাদ, ধর্ম-দর্শনে আজ্ঞেয়বাদ ও নাস্তিকতা, অর্থনৈতিক দর্শনে এক সময় সমাজতন্ত্র অন্য সময় পুঁজীবাদ জায়গা করে নেয়। এই দুয়ের মধ্যে দন্দ্ব সংঘাতও ঘটে ব্যাপকভাবে। এরপর তারা সমাজ-রাষ্ট্র-নৈতিক জীবনে সেকুলারিজম ও লিবারেলিজমের কোলে আশ্রয় গ্রহণ করে সেগুলোকে আপন করে নেয় । সাথে সাথে তারা তাদের এসব ব্যর্থ-মূল্যহীন মানবতা ও ঈমান বিধ্বংসী মতবাদগুলো মুসলিম দুনিয়া রপ্তানি করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে।
পরাজিত মুসলিমরাও নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে সেসব মতবাদকে আঁকড়ে ধরে নিজেদেরকে যুগোপযোগী আর প্রগতিশীল প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। তারাও বস্তুবাদ-ভোগবাদকে জীবনের কামনা মনে করে সেসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ভোগবাদ-বস্তুবাদ-পূঁজীবাদের শেকড় উচ্ছেদকারী দীন আল-ইসলামই যেহেতু তাদের প্রধান ও একমাত্র প্রতিপক্ষ, তাই তারাও রাষ্ট্রীয় জীবনে সেকুলারিজমকে আপন করে নেয়। রাষ্ট্র থেকে দীনে হক আল-ইসলামকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
এই যে মুসলমানদের এমন আত্মঘাতী কর্মপদ্ধতি, এই নীতি-পদ্ধতির ব্যাপারে আমাদের প্রিয় নবী রাসুলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বেই (ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক করার ব্যাপারে) সতর্কবাণী দিয়ে গেছেন। ঠিক করে দিয়ে গেছেন ধর্মনিরপেক্ষ-রাষ্ট্রে বসবাসরত মুমিনদের কর্মপদ্ধতি। আসুন, দেখে আসি সেকুলারিজম নিয়ে কী সেই সতর্কবাণী করেছেন, কী কর্মপদ্ধতি বাতলিয়ে দিয়ে গেছেন রাসুলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম।
আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
“সাবধান! ইসলামের চাকা ঘূর্ণায়মান, তোমরাও ইসলামের সাথে ঘুরতে থাকবে। সাবধান! অচিরেই কুরআন ও ক্ষমতা আলাদা হয়ে পড়বে, অর্থাৎ দীন থেকে রাষ্ট্র অচিরেই পৃথক হয়ে যাবে। (মানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়া হবে, তখন) তোমরা আল্লাহর কিতাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ো না।
সাবধান! অচিরেই তোমাদের ওপর এমন শাসক চেয়ে বসবে যারা নিজেদের জন্য এমন ফয়সালা করবে যা তোমাদের জন্য করবে না, তোমরা যদি তাদের আনুগত্য না করো তারা তোমাদের হত্যা করবে, আর যদি আনুগত্য করো তবে তোমাদের পথভ্রষ্ট করবে।”
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমরা তখন কী করবো? জবাবে তখন রাসুলুল্ললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন , ‘তোমরা সেটাই করবে, যা করেছেন ঈসা ইবনে মরিয়ম আলাইহিস সালামের অনুসারীগণ। তাদেরকে করাত দিয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এবং শূলে চড়ানো হয়েছে এরপরও তারা আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে যাননি। আল্লাহর নাফরমানী করে বেঁচে থাকার চেয়ে তাঁর পথে তাঁর আনুগত্য অবস্থায় মারা যাওয়া অনেক শ্রেয়।’★
রাসুলের (সা.) সতর্কতামূলক নির্দেশনা থেকে আমরা যে বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে শিখতে পারি, সেগুলো হচ্ছে:
০১. কৌশলের নাম করেও সেকুলারিজমকে আঁকড়ে ধরা যাবেনা।
০২. জীবন চলে গেলেও, করাত দিয়ে মাথা দুই ভাগ করে ফেলা হলেও কুরআন থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক করার মতো নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থামানো যাবে না।
০৩. প্রাণ দিয়ে হলেও দীনকে জীবন-বিধান , কুরআনকে রাষ্ট্রের সংবিধানরূপে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
০৪. ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের আনুগত্য করলে তারা একজন মুসলিমের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ ঈমানকে নষ্ট করবে। পথভ্রষ্ট আর বিপথগামী করে ছাড়বে।
০৫. মুসলমানের সামনে আল্লাহর নাফরমানী আর মৃত্যু- এই দুটো যখন আসবে, তখন মুমিনের ঈমানের দাবি হচ্ছে আল্লাহর নাফরমানীর পরিবর্তে আনুগত্য করা অবস্থার মৃত্যুকেই বেচে নেওয়া। কারণ, মুমিন এই অবস্থায় মরলে পাবে শাহাদাতের মর্যদা, হবে শহীদ। আর একজন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীর আশ্রয় নিশ্চয় লাঞ্চনাই হবে পরকালীন জীবনে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে দীন প্রতিষ্ঠার কাজে শুহাদা-আলান নাস ( জগৎবাসীর জন্যে সত্যের সাক্ষ্য) হবার তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন।
তথ্যসূত্র :
★ শাইখ ইউসুফ'কারযাভী রহিমাহুল্লাহ রচিত 'ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা তত্ত্ব ও প্রয়োগ' গ্রন্থ থেকে। তিনি নিয়েছেন ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী প্রণীত আল মাতালিব আল আলিয়া নামক গ্রন্থ থেকে। উক্ত গ্রন্থটি কুয়েতের ধর্ম-মন্ত্রণালয় প্রকাশিত।
আর "ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা তত্ত্ব ও প্রয়োগ" নামক গ্রন্থটি বিআইআইটি থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত। উক্ত বইয়ের অনুবাদ করেছেন বিশিষ্ট আলিম, অনুবাদক ও লেখক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান)
~রেদওয়ান রাওয়াহা
০৩.০১.২৩ ইং
Comments
Post a Comment