বায়তুল মোকাররম

 



মসজিদ। মুসলিম উম্মাহর সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে এসে মিটে যায় সব বাধা-ব্যবধান। মিটে যায় বড়-ছোট, সাদা-কালো, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচুর সব পার্থক্য। আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে যখন মদিনাতুল মুনাওয়ারায় হিজরত করেছেন, তখন কুবা নামক স্থানে গিয়ে কয়েকদিন অবস্থান গ্রহণ করেন। আর সেখানেই গড়ে তোলেন মুসলমানদের ইবাদাত-গৃহ। ইতিহাসের পাতায় সেই গৃহটির নাম মসজিদে কুবা হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।


এরপর আল্লাহর বান্দা এবং রাসূলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের উম্মতেরা পৃথিবীর যে প্রান্তে যখনই গিয়েছেন, সেখানেই গড়ে তুলেছেন মসজিদ। 


তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের এই সবুজ জমিনেও অগণিত মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশের এই অগণিত মসজিদের প্রধান মসজিদ তথা জাতীয় মসজিদ হচ্ছে বায়তুল মোকাররম। ঢাকার প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত এ মসজিদটি ধারণক্ষমতার দিক থেকে বিশ্বে ১০ম মসজিদ।


পাকিস্তান আমলের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি জনাব আবদুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি এবং তাঁর ভাতিজা ইয়াহইয়া বাওয়ানি মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আর তাদের সেই সুমহান উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করতে ১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠন করা হয়।


আজকের এই মসজিদটির স্থানে তখন 'পল্টন পুকুর' নামে একটি বড়ো পুকুর ছিলো । অতঃপর পুকুরটি পুরোপুরি ভরাট করে প্রায় সাড়ে আট একর জমির ওপর এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটির কাজের উদ্বোধন করা হয় ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি। উদ্বোধন করেন তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান। মসজিদের নকশা তৈরির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের একজন বিখ্যাত প্রকৌশলী আবুল হোসেন থারিয়ানি। 


১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারিতে জুম'আর সালাতের মাধ্যমে এই মসজিদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দশ বছর পর ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বায়তুল মোকাররমকে জাতীয় মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।


এই মসজিদটির তিনতলার উত্তরপাশে একসঙ্গে ১৫০০ নারীর সালাত আদায়ের ব্যবস্থা আছে। আছে পাঠাগারও। সব মিলিয়ে এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি সালাত আদায় করতে পারে। 


মক্কার কাবার আদলে তৈরি বায়তুল মোকাররম বাংলাদেশের অনান্য যেকোনো মসজিদ থেকেই স্বতন্ত্র। কিছু কিছু দেয়ালে মোঘল শৈলীর নান্দনিক নকশায় ভরপুর। এটি স্থাপত্যের দিক থেকে আধুনিক হলেও মুসলিম সভ্যতার স্থাপত্যকে একেবারেই এড়িয়ে যায়নি। দক্ষিণ এশিয়ার স্থাপত্য শিল্প, পবিত্র কাবা এবং মোঘল আমলের স্থাপত্যের আভিজাত্য এখানে স্পষ্ট। দক্ষিণ এশীয় মসজিদ স্থাপত্যে গম্বুজ থাকাটা স্বাভাবিক, সে দিক থেকে মূল অবকাঠামোতে গম্বুজ না থাকলেও উত্তর এবং দক্ষিণে দুটি প্রবেশ পথের গম্বুজ তার অভাব পূরণ করেছে। মসজিদটিতে মোটাদাগে অলংকরণের আধিক্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।  


আমাদের এই জাতীয় মসজিদটি দেখার জন্য কিংবা এখানে সালাত আদায়ের জন্য দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটকও আসেন। শুক্রবারে জুম'আর সালাতে এখানে মানুষের উপচে পড়া ভিড় নামে। রামাদানে প্রতিদিন থাকে এখানে ইফতারের ব্যবস্থা। তারাবিহর পাশাপাশি শেষ দশকে এখানে কিয়ামুল লাইলেরও ব্যবস্থা করা হয়।


১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বায়তুল মোকাররমের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। উক্ত মসজিদের প্রথম খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিশিষ্ট আলিমে দীন মাওলানা আবদুর রহমান কাশগরী (রহ.)।


মসজিদ প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তাঁর কালামে হাকিমে বলেন,

إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللهِ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللهَ فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِيْنَ-


‘আল্লাহর মসজিদসমূহ কেবল তারাই আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও বিচার দিবসের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে। যারা সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না। নিশ্চয়ই তারা সুপথ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। (তওবা ৯:১৮)।


মসজিদ নির্মাণ প্রসঙ্গে রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ بَنَى مَسْجِدًا لِلَّهِ ، بَنَى اللهُ لَهُ بَيْتًا فِى الْجَنَّةِ.

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মাণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করে দেবেন’। (বুখারি-মুসলিম) 


মহান আল্লাহর কাছে আকুল কণ্ঠে ফরিয়াদ, তিনি যেনো বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের প্রতিষ্ঠাতাসহ সকল মসজিদ নির্মাণকারীদের ফিরদাউসের ফুল বাগানে আশ্রয় দান করেন এবং মসজিদগুলোকে যেনো আমরা এর যথাযথ হক আদায় করে আবাদ করতে পারি। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন!

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ