বিশ্বকাপের রঙ্গ
২০১৪ সালে ব্রাজিলে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালে সেখানকার গরিব মানুষেরা স্টেডিয়ামমুখী দর্শকদের নিকট এটা-সেটা বিক্রি করত। খুব স্বাভাবিক। পৃথিবীর সব দেশের গরিব মানুষেরই প্রধান লক্ষ্য থাকে দু’মুঠো খাবার জোগানো। স্টেডিয়ামমুখী ‘দর্শকদের’ নিকট দরিদ্র ব্রাজিলিয়ানদের এই কেনাবেচায় কারো নাখোশ হওয়ার কথা না।
কিন্তু একজন হয়েছিল, বেজায় নারাজ হয়ে ব্রাজিল সরকারকে বলেছিল এইসব ছুঁচকেদের বেচাবিক্রি বন্ধ করতে—ফিফা। ফিফার ভাষ্যমতে স্টেডিয়ামমুখী দর্শকদের নিকট পণ্য বিক্রির ‘অধিকার’ শুধুমাত্র ফিফার স্পন্সর কোম্পানিগুলোর। সো?? এইসব গরিব-কাঙ্গালদেরকে খেদাতে হবে।
মজার ব্যাপার হল সেই বিশ্বকাপে ফিফার আয় ছিল মাত্র ৪.৭ বিলিয়ন ডলার! ওয়েট। সংখ্যাটা মিলিয়ন না, বিলিয়ন! এবং সেটা বাংলাদেশের টাকা না, ডলার। সেই বিশ্বকাপ আয়োজন করতে গিয়ে ব্রাজিলের খরচ হয়েছিল ১৫ বিলিয়ন ডলারের মত।
এবং ব্রাজিলিয়ায় Mane Garrincha স্টেডিয়াম নির্মাণেই ব্যয় হয়েছিল মাত্র এক বিলিয়ন ডলার!! এরচেয়েও সুখের বিষয় হচ্ছে এক বিলিয়ন ডলার মূল্যের স্টেডিয়ামটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে বাসের ডিপো হিশেবে। ফ্রি তে একটা গাবতলি বাসস্ট্যান্ড পেয়ে যাওয়া খারাপ না অবশ্য।
এটি জাস্ট আইসবার্গের চূড়া। একটা বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে কত শত হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়? সেই লেনদেনের ভাগভাটোয়ারা কে কেমন পায়?
…
সেই আলাপে ঢুকা যাক আরেকটা ইন্টারেস্টিং তথ্য দিয়ে। বর্তমান ফিফা প্রেসিডেন্টের বেতন ও আনুষাঙ্গিক খরচ মিলিয়ে বার্ষিক আয় ৩.১৯ মিলিয়ন ডলার বা ৩২ লাখ ডলারের মত। মাসিক ২,৪৫,৩৮৪ ডলার, সাপ্তাহিক ৬১,৩৪৬ ডলার, দৈনিক ১২,২৬৯ ডলার, প্রতি মিনিট ২৫.৫৬ ডলার। ডলার প্রতি ১০০ টাকা করে ধরলে প্রতি মিনিটে তার আয় আড়াই হাজার টাকার উপর।
সেই হিশেবে ৯০ মিনিটের একটা খেলায় পুরো সময়টা চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে যখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে রাত তিনটায় কোথাও গিয়ে গা এলিয়ে দিচ্ছেন, ততক্ষণে তার আয় আড়াই লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। যারা বল লাথাচ্ছে, তাদের আয় হচ্ছে, যারা স্পন্সর করছে, তাদের আয় হচ্ছে।
কিন্তু যে দশ হাজার মানুষ মুহসিন হলের মাঠে বসে ফিফার অফিশিয়াল ফ্যান পেজে ছবির আশায় উন্মাদের মত চেচাচ্ছে, তাদের প্রাপ্তিটা অবশ্য এখনো কোনো গবেষণায় উদ্ধার করা যায়নি। ফলে অর্থমূল্যও নির্ধারণ করা যায়নি। গেলে আমাকে জানাবেন। মানবসভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যটা জানতে না পারলে আমার মানবজন্ম বৃথা।
এক্ষেত্রে আরও মজার বিষয় হচ্ছে ফক্স বিজনেসের তথ্যমতে মার্কিন প্রসিডেন্ট জো বাইডেনের বার্ষিক আয় (প্রেসিডেন্সিবাবদ) চার লাখ ডলার। যেখানে ফিফা প্রেসিডেন্টের প্রেসিডেন্সিবাবদ আয় মাত্র ৩২ লাখ ডলার! কয়জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বেতন একসাথে করলে ফিফা প্রেসিডেন্টের সমান হবে?
…
২০২২ বিশ্বকাপে ফিফার আয় হবে সাড়ে সাত বিলিয়ন। যা বিগত চারবছর সার্কেলের চেয়ে মাত্র এক বিলিয়ন ডলার বেশি। ফিফার অর্থনৈতিক সার্কেল আবর্তিত হয় এক বিশ্বকাপ থেকে আরেক বিশ্বকাপ পর্যন্ত; চারবছর মেয়াদি। প্রতি চারবছর পর সেই সার্কেলের লাভক্ষতির খতিয়ান পেশ করা হয়।
বিশ্বকাপ আয়োজনে আয়োজক দেশের কত শত শত কোটি টাকা লাভ, সেসব হিশাব মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। আয়োজক দেশের অর্থনীতিতে কিরকম গতি সঞ্চার হয়, সেসব। একথা সত্য বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে সে বছর প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে, হাজার হাজার অস্থায়ী চাকরি তৈরি হয়। কিন্তু তা খুবই সীমিত সময়ের জন্য। বেলুন ফুটে গেলে ঠুস।
২০১০ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনকে দক্ষিণ আফ্রিকা বৈদেশিক ঋণচক্রে বাধা পড়ার অন্যতম কারণ হিশেবে দেখা হয়। গ্রীসের মত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ অলিপম্পিক আয়োজন করতে গিয়ে ফতুর হয়ে গেছে। সেসময় নির্মাণ করা স্টেডিয়ামগুলো ভেঙ্গে ফেলতে গ্রিকরা বহু আন্দোলন করেছে। ব্রাজিলেও একই দশা।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেকোনো উদ্যোগ মূল্যায়নের প্রথমেই আসে অপারচুনিটি কস্ট। অর্থাৎ এই টাকাটা এই খাতে ব্যয় না করলে বাকি অন্য কোন কোন খাতে ব্যয়িত হতে পারত। সেখান থেকে কী পরিমাণ লাভালাভ আসত। সেসব।
কাতার বিশ্বকাপের ব্যয় মাত্র ২২৯ বিলিয়ন ডলারের মত। বিশ্বকাপের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত বিশ্বকাপের সম্মিলিত ব্যয়ের চাইতে বেশি!
২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপের ব্যয় ১১.৬ বিলিয়ন।
২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে ব্যয় ১৫ বিলিয়ন।
২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ব্যয় ৩.৬ বিলিয়ন।
এই অর্থ সামাজিক কাজে ব্যয় করলে কী হত, কিংবা বিশ্বকাপ বাদে দেশের অন্যান্য উন্নয়নে ব্যয় করলে কী ঘটত, সেই হিশাবটা ধামাচাপা থেকে যায়। কাতারের ২২৯ বিলিয়ন ডলারের হিশাব নাহয় তোলাই থাকল।
দ্বিতীয় যে বিষয়টা 'অতীব গুরুত্বের সহিত' উল্লেখ করা হয় তা হল আয়োজক দেশের অর্থনীতিতে কত সুদূরপ্রসারী ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ ঘটবে সেসবের ফিরিস্তি। যেমন এবার কাতার ২২৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় বাবদ ২০৩০ সাল নাগাদ আয় করবে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার! প্রভূত আয় বটে।
এবং বিশ্বকাপ আয়োজন বহুদেশের জন্য আয়ের পরিবর্তে গলার ফাঁসে পরিণত হওয়ার নজির কম না। অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থের শ্রাদ্ধ হয়। এক্ষেত্রে ফিফার সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড আছে। আয়োজক দেশগুলো সেই মানদণ্ড অনুসরণ করে হোটেল, মোটেল, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য ফ্যাসিলিটিজ নির্মাণ করতে হয়।
সবচেয়ে চরম খেলাটা চলে ফিফার সাথে। দেশগুলোর করদাতাদের পয়সায় আয়োজিত এই বিশাল-বিপুল কর্মযজ্ঞের পুরো আয়টা যায় ফিফার পকেটে! এবং এই আয় করমুক্ত!! অর্থাৎ স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার পরিবর্তে যদি আপনি দেশের কোনো সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখতেন, এই বাবদ সিনেপ্লেক্স মালিক দেশের সরকারকে কর দিতে হত।
কিন্তু বিশ্বকাপের টিকিট ও অন্যান্য খাত থেকে ফিফার সমস্ত আয় করমুক্ত। সোজা কথায় ২০২২ বিশ্বকাপ উপলক্ষে ফিফা যে সাড়ে সাত বিলিয়ন আয়ের স্বপ্ন দেখছে, সেখান থেকে কাতার সরকার চার আনাও পাবে না। কিন্তু তার ব্যয় হয়েছে মাত্র ২২৯ বিলিয়ন ডলার।
ব্রাজিল বিশ্বকাপে সরকার অবকাঠামো নির্মাণে যে ব্যয় করেছিল, সেই টাকা উসুল করতে গেলে বিশ্বকাপে আসা প্রতিটা ট্যুরিস্টকে ব্যয় করত হবে মিনিমাম এক লাখ ত্রিশ হাজার ডলার। বলাই বাহুল্য ত্রিশ হাজার ডলারের বাইরেই অঙ্কটা যায়নি। জনপ্রতি বাকি এক লাখ ডলার করে গিয়েছে ব্রাজিলের দরিদ্র জনগোষ্ঠির পকেট থেকে, যাদের কপালে স্টেডিয়ামের বাইরে ফুটপাতে বেচাবিক্রির অনুমতিটাও জোটেনি!
এ তো ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের বিশ্বকাপ। কাতারের ২২৯ বিলিয়ন ডলারের বিশ্বকাপের হিশাবটা কত হতে পারে? এই বিশ্বকাপে কাতার নিশ্চয়ই পর্যটন খাত থেকে বিপুল লাভবান হবে। আশা করি।
ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত। তবে হয়নি। বিশ্বকাপের জন্য নির্মিত স্টেডিয়ামসহ বেশিরভাগ অবকাঠামোও ‘ট্যাক্স ফ্রি জোন’! অর্থাৎ এখানকার কন্ট্রাকটরদের থেকে আয়োজক দেশ কোনরূপ ট্যাক্স নিতে পারবে না। আশা করি উন্নত বিশ্বের কন্ট্রাকটরদের জন্য এরকম বিশ্বকাপ চারবছর পর পর না, প্রতিবছর আয়োজনের ব্যবস্থা করা হবে।
…
ফিফার আয়ের প্রধান খাত তিনটি। প্রথমত খেলাধুলা সম্প্রচারের লাইন্সেন্স থেকে। এই খাত থেকে তাদের প্রায় ৫৬ শতাংশ আয় আসে। দ্বিতীয় খাত খেলার ভেন্যুগুলোতে বিজ্ঞাপন। তৃতীয় খাত টিকিট ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক বেচাবিক্রি। শুধু বিশ্বকাপ না, পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য অগণিত ফুটবল আয়োজন করে থাকে ফিফা। ২০২১ সালে ফিফার আয় ছিল ৭৬৬ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বকাপ বছরের বাইরে এটি ফিফার সবচেয়ে বড় আয়।
এই আয়ের অন্যতম একটা উৎস ছিল সেবছর অনুষ্ঠিত আরব কাপ। ধনাঢ্য শেখদের পকেট কেটে ফিফার যাত্রাটা মন্দ হয়নি নিশ্চয়ই। কাতার বিশ্বকাপে টিকিট বিক্রি হয়েছে মাত্র তিন মিলিয়ন বা ত্রিশ লাখ। প্রতিটি টিকিটের মূল্য ১০০ থেকে ১১০০ ডলার পর্যন্ত। ফিফা আশা করছে এটিও হবে তাদের আরেকটি ‘বাম্পার’ ইয়ার। এবং আগামি সার্কেল থেকে ফিফার আয়ের টার্গেট মাত্র দশ বিলিয়ন ডলার।
এসব আয় অবশ্য যথেষ্ট না। ১০ বিলিয়ন ডলার আয়ের জন্য ফিফা নতুন খাত অন্বেষণ করছে। তাই তিনটি প্রধান খাতের সাথে আরেকটি আলাদা সেকশন খোলা হবে—নারী বিশ্বকাপ। যদিও ১৯৯১ সাল থেকে নারী বিশ্বকাপ হয়। কিন্তু এখন থেকে ফিফা একে স্বতন্ত্র ইভেন্ট হিশেবে ব্র্যান্ডিং করবে এবং একে কেন্দ্র করে নতুন লাইসেন্স, নতুন স্পন্সরসহ সবকিছু আলাদা সেকশনে করা হবে।
…
ফিফা গঠিত হয়েছিল ১৯০৪ সালের ২১ শে মে। বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্সসহ ইউরোপের সাতটি দেশের সমন্বয়ে। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ফরাসি সাংবাদিক Robert Guerin. ফিফার প্রকৃত নামটাও ফরাসি— Fédération Internationale de Football Association. বিশ্বব্যাপি নিউ-ইম্পেরিয়ালিজম, নর্দারনার্সদের দৌরাত্ম্য এবং সেই ইম্পেরিয়ালিজমের টুলগুলো সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে, বিশ্বকাপের স্বরূপ বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা না, উচিতও না।
সবচেয়ে মজা পাই যখন দেখি প্রবল পশ্চিম বিরোধি, তীব্র সাব অল্টার্ন এবং প্রচণ্ড বিপ্লবী বামরাও আপাদমস্তক ‘ফ্যানবয়’। আক্ষরিক অর্থেই ধন্দে পড়ে যাই এখানে আসলে ক্লাউনটা কে—ফিফা? মিডিয়া? বিপ্লবীরা? নাকি আমি নিজে?
…
এ ছিল জাস্ট বিশ্বকাপকেন্দ্রিক ফিফারঙ্গ। সাথে আছে আরও বহুধাপের স্পন্সর, বিশ্বকাপ স্পন্সর, শত শত কন্সট্রাকশন কোম্পানি, বিশ্বজুড়ে ডজন ডজন ইভেন্টসহ অত্যন্ত জটিল এক জগত। যেই জগতে আপনার আমার প্রবেশাধিকার নেই। এক ভিন্ন জগত। সেই জগতে বাস করেন পৃথিবীর ‘প্রভুরা’। আপনি-আমি সর্বোচ্চ যেটা পারি—স্ক্রিনের সামনে বসে চিৎকার করে করে প্রভুদের ‘ইবাদাতে’ মনোনিবেশ করা; উন্মাদের মত লম্ফঝম্ফ করে প্রভূর সমীপে নিজের ‘হাজিরি’ ঘোষণা করা।
লেখক : রাকিবুল ইসলাম
Comments
Post a Comment