“অপারেজয়”




 

 

একটা মানুষকে পরাজিত করবার জন্যে, একটা মানুষের জীবন-নদীর গতিপথকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য তাবৎ দুনিয়ার যতো আয়োজন আছে, যতো কর্মকৌশল আছে, যতো মেগা পরিকল্পনা আছে, তার সবকয়টিই করেছে তারা।

 

তাঁকে সমাজচ্যুত করা, তাঁর সঙ্গী-সাথিদের হত্যা করা, তাঁর পবিত্র দেহখানিকে আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ও জর্জরিত করা, তাঁর নামে মিথ্যে অপবাদ আর কুৎসা রটনা করা, তাঁকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা, তাঁকে খুন করার মতো নৃশংস আয়োজন; কী না করেছে তারা? এমনকী তাঁর কাজকর্মকে ডিমোরালাইজ করার জন্য তাঁকে এতো বেশিই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে যা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু তাঁর অনুসারী যাঁরা ছিলো, তাঁদের যোগ্যতা-দক্ষতা, সামাজিক আভিজাত্য, পারিবারিক স্টাটাস নিয়েও কথা বলেছিলো তারা। দিয়েছিলো তারা এই বলে নির্মম খোঁটাও যেআরেহ, এর সাথে যারা আসে, এরা তো সমাজের নিচুস্তরের মানুষ! আরেহ এরা তো দাস, গরিব, সমাজ-সংস্থায় একপ্রকার অস্পৃশ্য ও মূল্যহীন!

 

তাঁকে থামিয়ে দিতে, তাঁর পরাজয়কে স্বচক্ষে অবলোকন করতে হেন কোনো কাজ  ছিলো না, যা তারা করেনি। তাদের নির্মম আর নিষ্ঠুরতম আচরণে তিনি নিজের প্রিয় জন্মভূমিটাও ছেড়ে চলে গিয়েছেন। জন্মভূমি ছেড়ে ইয়াসরিবে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।

 

আমাদের সমাজে হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলে দেওয়া নামে একটা কথার প্রচলন আছে! মক্কার বেঈমান আর নৃশংস বর্বর কুরাইশরা ঠিক এই কাজটিই করেছে। তাদের নিজ দেশের-নিজেদের সামনে, নিজেদের হাতের ওপর বেড়ে উঠা পৃথিবীর আদি থেকে অনন্তকালের সবচেয়ে সেরা যে মানুষটিসে মানুষটিকে, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সেই সম্পদটিকে নিজেদের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিলো তাঁরা। অপরদিকে তাদের দূরে ঠেলে দেওয়া সেই মহামূল্যবান জহরতটিকে ইয়াসরিবের লোকেরা নিজেদের আন্তরিকতার সবটুকুন ঢেলে দিয়ে গ্রহণ করে নিলো। তারা তাঁকে নিজেদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের এক অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বরণ করে নিলো। তাঁর সব আদেশকে শিরোধার্য করে নিলো। নিজেদের জন্য একমাত্র ফায়সালাকারী হিসেবে কবুল করে নিলো।

 

এভাবে যখন ইয়াসরিব-বাসী তাঁকে নিজেদের নেতা হিসেবে বরণ করলো, তখন তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে ইয়াসরিবের মানুষেরা তাদের সেই সুদীর্ঘকালের বিদ্বেষ-ভেদাভেদ আর রেষারেষি ভুলে, তাদের ওপর জেঁকে বসা ঘোর অমানিশা বিদূরিত করে এক সুখী-সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয়কে সমুন্নত করলেন বিশ্বের জমিনে। কুরাইশরা যে মহান মানুষটিকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন, সেই মানুষটিই রাতারাতি হয়ে গেলেন ইয়াসরিবের চেইঞ্জ মেকার।

 

কথায় আছে, সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। হ্যাঁ, মক্কার বর্বর কুরাইশদের ঠিক এই দশাটাই হলো। মানে ভূতে কিলানোর মতো অবস্থা হয়ে গেলো। তারা অন্যের সুখ দেখে সহ্য করতে পারলো না। যেই ইয়াতিম যুবকটিকে তারা পৃথিবীর আলো-বাতাসের বুক থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলো, সেই মানুষটিই কিনা আজকে তাদের পাশের শহরেই একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুললো!

 

হিংসে তাদেরকে হায়েনার মতো উন্মাদ করে তুললো। তাদের কলিজা থেকে হিংসের পোড়া পোড়া কয়লাগুলো বের হতে লাগলো। কোনোভাবেই তারা তাঁর অগ্রযাত্রা, তাঁর সাফল্যের সোনালি তোরণের দিকে অবিরত ছুটে চলাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছিলো না। তাই তাঁরা এখানেও হামলা করে তাঁকে চিরতরে পৃথিবীর জমিন থেকে বিদেয় করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে! যখনই তাঁরা ইয়াসরিব-বাসীর ওপর হিংস্র হামলা চালানোর জঘন্য পরিকল্পনা করে সহস্র সন্ত্রাসীকে সাথে নিয়ে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ অবতীর্ণ হলো, তখন ঠিকই তারা জনমের তরে একটি শিক্ষা পেলো। সেই যুদ্ধে কুরাইশ পৌত্তলিকরা হারালো তাদের সবচেয়ে জাঁদরেল কয়েকজন নেতাকেও।

 

হ্যাঁ, বলছিলাম সারা বিশ্বের বিস্ময়, তাবৎ দুনিয়ার আগত-অনাগত সকল  মানুষের একমাত্র অনুসরণীয় আদর্শ মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মক্কার পিচাশ তৎকালীন  কুরাইশ নেতৃবৃন্দের কথা!

 

এই যে একটা মানুষকে সহ্য করতে না পারা, একটা মানুষের অগ্রযাত্রা আর সফলতায় মনোক্ষুণ্ণ হওয়া, একটা মানুষকে থামিয়ে দেওয়ার নিকৃষ্ট আর নীচুতম কাজগুলো করা, একটা মানুষের ভালো আর মর্যদাপূর্ণ অবস্থানকে মেনে নিতে না পারা; এসব চিত্র কিন্তু আজো আমাদের সমাজ-সভ্যতার পরতে পরতে ফুটে আছে। কখনো কখনো এমন অনেক মানুষও আপনি আপনার আশেপাশে দেখতে পাবেন যে যারা আপনার পরাজয়, আপনার ব্যর্থতা, আপনার হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস দেখার জন্য অধীর আগ্রহে মুখিয়ে আছে। এরা জমিনে আপনার সম্মানজনক একটা অবস্থান তৈরি হোক তা চায় না, কিংবা আপনার একটা সম্মানজনক অবস্থা আছে, তারা সেটা নষ্ট করার জন্য কাঙ্গালের মতো মুখিয়ে থাকে।

 

কেউ কেউ তো এমনও আছে যারা আপনার অগ্রযাত্রাকে রুখে দেওয়ার হীনচক্রান্ত থেকে আপনাকে, আপনার নানানবিধ কাজকে, নানারকম উদ্যোগকে ভীষণভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মাধ্যমে আপনার আত্মবিশ্বাসকে, আপনার হিমালয়সম মনোবলকে ভেঙে দিতে যারপরনাই চেষ্টা আর সাধনা করে যায়। পৃথিবীর সকল কাজকারবারে এই সকল মানুষের চেষ্টা-প্রচেষ্টার ঘাটতি থাকলেও আপনার বিরুদ্ধে করা হীন কাজগুলোতে তাদের সেই চেষ্টা আর সাধনায় সাধারণত কোনো ঘাটতিই লক্ষ্য করা যায় না। তাদের এমন নির্লজ্জ আর নিকৃষ্ট কার্যক্রমে আপনি যদি দমে যান, তাহলেই তারা সফল। তারা যেটা চেয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করতে পেরে তারা হয় আনন্দিত। খুশি। উৎফুল্ল। কিন্তু তাদের এহেন দুরভিসন্ধিমূলক কার্যক্রমকে একপাশে ঠেলে দিয়ে যদি আপনি দোর্দণ্ডপ্রতাপে আপনার লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারেন, তবে আপনি যেভাবে সফলতার সোনালি তোরণের সাক্ষাৎ পাবেন, ঠিক অন্যপাশে আপনার সফলতা দেখে তাদেরও মনের জ্বালা-যাতনা দ্বিগুণ-তিগুণ বেগে বৃদ্ধি পাবে। তারা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে মারবে।

 

এখন সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণই আপনারআপনার আশেপাশের এমন নালায়েকদের ষড়যন্ত্রে ও কটুকথায় আপনি কি থেমে যাবেন, নাকি বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত হিসেবে তাঁরই আদর্শ ধারণ করে অপারেজয় মানসিকতা নিয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপে আপনার লক্ষ্যপাণে একজন লড়াকু সৈনিকের মতো করে বিজয়ের  ফুল ফোটাবার জন্যে এগিয়ে যাবেন ! যদি এগিয়ে যান, তাহলে চূড়ান্তভাবে তারা হতাশ হবে। হবে পরাজিত হবে। তাদের মনটা দুঃখ-জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে অঙ্গার হয়ে যাবে। আর যদি সাময়িক কটুকথায় কিংবা ষড়যন্ত্রে থেমে যান, তাহলে তারাই সফল হবে। হাসবে বিজয়ের হাসি; যেমনটি তারা চেয়েছিলো। তবে এতোটুকুন মনে রাখবেন মুহাম্মাদের () উম্মতেরা কখনো দমে যায় না। কারো কটুকথায়, কারো ষড়যন্ত্রে নিজ-লক্ষ্য থেকে দৃষ্টি সরায় না। দমে যাওয়া, চুপসে যাওয়া, হারার আগেই হেরে যাওয়া এই উম্মতের সাথে বড্ড বেমানান !

 

এক্ষেত্রে সাঈয়েদ আবুল আলা মওদূদীর একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেছেনদুনিয়ায় মুসলিম কখনো অপমানিত, পরাজিত ও অপরের হুকুমের তাবেদার হয়ে থাকতে পারে না। সবসময়েই সে থাকবে বিজয়ী ও নেতা হয়ে, কারণ ইসলাম তার ভেতর যে গুণের জন্ম দিয়েছে তার ওপর অন্য কোনো শক্তিই বিজয়ী হতে পারে না। ( বই : ইসলাম পরিচিতি)

 



~রেদওয়ান রাওয়াহা
১৭.০২.২৩ ইং

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ