||সুরের তরঙ্গ||




গানের প্রতি, মিউজিকের প্রতি আসক্তি কখনোই ছিলো না। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মনে হতো বাদ্যযন্ত্রের উন্মাদনা। অনেক পাপের ভিড়েও আল্লাহর কোনো এক বিশেষ অনুগ্রহে এই পাপ থেকে নিজেকে রেখেছি বিমুক্ত। তবে পাপ হিশেবে জানার আগ থেকেই, মানে পিচ্চিকাল থেকেই সেই আসক্তি হতে, বাদ্যযন্ত্র বাজানো গানের ওপর রাজ্যের অনীহা জমে আছে ! জীবনে আগত যৌবনের উত্তাল তরঙ্গের বড্ড একটা সময়জুড়ে মালাইকা কিসিমে’র জীবন পার করেছি।


ইবলিস থাকে মানুষের শিরায় শিরায়। রক্ত কণিকায়। প্রতিটা ধমনীতে চলে তার ওয়াসওয়াসা! তাই হঠাৎ নেক সুরাতে শাইত্বনের ধোঁকায় নিপতিত হয়ে জীবনের পবিত্র প্রাণবন্ততা যেনো খুইয়ে ফেলছি। উন্মাতাল আনন্দের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে বেড়াই। সাময়িক সে-ই আনন্দে নিবিড়ভাবে নিবিষ্ট হয়ে পড়ি। পরক্ষণেই আতঙ্কে দিগ্বিদিক ছুটে চলে বিবেক, আঘাত হানে আমাকে বিবেকের বেয়নেট!

আমি আমার পূর্ব জীবনের পবিত্রতার আবরণ পেতে উদগ্রীব হয়ে পড়ি! তবে হেরে যাই। এভাবে বারবার নাফসের দাসত্বের বেড়ি পরে সে-ই নাফসের উন্মাদনায় হারিয়ে ফেলি নিজেকে। বারবার নিজের ঈমানী ইমারাতে ভয়াল ধ্বস নামে। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে আসে। নিজেকে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। হতাশা যেনো আষ্টেপৃষ্টে ধরে। হতাশা বিদূরিত করতে চাই। নিজেকে নিজে এভাবে ধীরেধীরে বিনাশের জন্য মন কাঁদে। প্রাণ কাঁদে। আঁখি কাঁদে....

কান্নার জল মুছতে চাই। হতাশায় হানতে চাই ভয়াল আঘাত! সেই জন্য, মিউজিকের জলে ডুব দিতে সুপ্ত একটা ইচ্ছে কাজ করে। আমি নেট ব্রাউজ করতে চাই গান শোনার তরে, পরক্ষণেই আতঙ্কে আঁতকে ওঠে মন-মনন। আমি করছিটা কী! তা হলে এ-ও আমি করবো! এ-জগতেও আমি কদম চালিত করবো? পূণরায় বিবেকের দংশনে আমি কুপোকাত হয়ে পড়ি। পিনপতন নীরবতা চারিধারে। কিন্তু মগজের ভাঁজে ভাঁজে কালবোশেখি ঝড় চলে....

আজ-ও তেমনটা-ই হলো, মানে মিউজিক শুনতে মগজের আহ্বান! মিউজিক শুনতে চেয়েও কেনো যেনো কুরআনের সুরের কলতানে হারিয়ে গেলাম।

একটা তিলাওয়াত পেয়ে যাই চোখের সামনে। চালু করে দিলাম তা। এখন আমি কুরআন শুনছি। তিলাওয়াতে কুরআন। সব বন্ধ করে। রুম বন্ধ। দরোজা বন্ধ। বাতি বন্ধ। দুয়েকটা জানালা খোলা। মৃদু আলো...! আমি আর আমার প্রভুর স্মরণ সেখানে। সুরের তরঙ্গে ভাসছি আমি। কুরআনের সুরের যে তরঙ্গ, সে তরঙ্গে। কুরআনের সুরের সে-ই যে একটা মোহনীয় তরঙ্গ, সেই তরঙ্গের ত্রাস আমাকে গ্রাস করে ফেলছে। আজ আর কোনো সুরের ঝংকার আমার হৃদয়-মিনারকে আন্দোলিত করে না। আমার শ্রান্ত মনকে শান্ত করে না। আমাকে আলোড়িত করে না। আমি কুরআনি সুরের সুধা পান করি, তাই ভিন্ন কোনো সুর আমাকে পরিতৃপ্ত করে না। আমি ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে মিউজিকের মাদকতায় কখনো ডুব দেই নি, দিও না। তবে দেয়ার এক সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ হয়েছে বারেবার....

আমার প্রাণ উচ্ছলতায় পূর্ণ হয় কুরআনি সুরের সুধায়। যে সুরের প্রেমে আমি বিলিন হয়েছি, সে সুরের ফল্গুধারা আমাকে সজাগ করে, আমার ঈমানের তেজকে তীক্ষ্ণতায় পূর্ণ করে। নিফাকি বিদূরিত করতে মনে সৃষ্টি করে তুমুল-তুখোড় আলোড়ন.....

আমার মনে ভেসে ওঠে প্রশান্তির আবেশ। বয়ে চলে পবিত্রতার আমেজ। কারণ, কুরআনের সুর-ছন্দের লহরীতে মাতোয়ারা হয়ে আছি আমি। মাতোয়ারা হয়ে থাকে আমার মন-মনন!

গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে এক চিলতে বাতাসের আদর পেলে যেভাবে শরীরে যেভাবে বয়ে চলে প্রশান্তির হিন্দোল, তেমনিভাবেই কুরআনের সুর আমার পাপের দাগে দগ্ধ হৃদয়কে, অন্যায়ের অনলে পুড়ে পুড়ে ছাঁই হওয়া হৃদয়ে বইয়ে দেয় শুদ্ধতার ফল্গুধারা। সেই শুদ্ধতায় ঋদ্ধ হয় মন।


আহা! এ সুর যেনো হাজারো অন্ধকার অমানিশায় আমার জন্য ফুটে ওঠা আলোর ফোয়ারা। প্রশান্তির হিমেল হাওয়া.....


কুরআনের সুরের তরঙ্গে একবার যে ভিড়ছে সে যতো বড়ো কাষ্ঠকঠিন হৃদয়ের অধিকারী-ই হোক না কেনো --তার হৃদয়টা নরম হয়ে যায়। কোমল হয়ে যায়। কুরআনের সুমধুর সুমিষ্ট সুরের ছন্দে তার হৃদয়ে নেমে আসে প্রশান্তির বৃষ্টি। যে বৃষ্টি হৃদয়কে ভিজিয়ে দেয়। পাপ-পঙ্কিলতার গ্লানিবোধটুকুকে শোধন করে নেয়।


আমার সামনে ভেসে ওঠে সহীহ্ বুখারীর ৪৭৩৯ নাম্বার হাদিসখানা, বুজতে পারি সে হাদিসের মর্মবাণী --যেখানে তিনি কুরআনের শিক্ষক-প্রশিক্ষক উভয়কেই সর্বোত্তম বলেছেন।


সহীহ্ বুখারীর আরেকটা হাদিস আমার কাছে কেমন যেনো লেগেছে, কিন্তু আজকে আলকুরআনের সুরের সুধায় আমি যখন ডুব দিয়ে প্রাণের মাঝে প্রশান্তির শীতলতা অনুভব করেছিলাম, তখনই আমি তার পরিপূর্ণ মর্মোদ্ধার করতে হয়তো সমর্থ না হলেও অনেকটা বুঝতে পেরেছি যে --কেনো আল্লাহর রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, " যে ব্যক্তি সুন্দর স্বরে সুললিত কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করবে না সে আমার দলভুক্ত নয়।"


আজকে তাই আমি দৃপ্ত সুদৃঢ় পণ করেছি যে আমিও সুমধুর স্বরে কুরআনের তিলাওয়াত করবো। সে-ই স্বরে মজে আমি ভুলে যাবো সকল ক্লান্তির সকল আবেশ। আনবো প্রাণে প্রশান্তির সুনিবিড় শীতলতা।


কারণ, আমার নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তোমরা কুরআনকে তোমাদের সুর দিয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত করো। (ইবনে মাজাহ: ১৩৪২)


||সুরের তরঙ্গ||
-রেদওয়ান রাওয়াহা

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ