নারী ও নেতা : সহমত ভাই-সহমত আপুর সয়লাব যেখানে




মেয়ে হওয়ার এই এক দারুণ সুবিধা যে, আপনি যা বলবেন, যা করবেন, যা লিখবেন, সবকিছুতেই বড়ো একটা অংশকে পাবেন—যারা শুধু আপনি মেয়ে বলেই জি আপু। সহমত আপু। দারুণ বলেছেন আপু। আপু, এত্তো সুন্দর কীভাবে যে বলেন আপনি! কীভাবে বলে ফেললেন এই কথাগুলো আপু, একেবারেই মিলে গেল যে আমার সাথে!


এমনকি এমনও হবে যে, আপুর কাছে প্রিয় হতে আপুর উক্তি নিয়ে, আপুর বক্তৃতা বা লেখনির চুম্বকাংশ নিয়ে টাইপোগ্রাফি করে ফেলে ইনবক্সে নক দিয়ে সম্মানিতা আপুকে দিয়ে বলা হবে এই নিন আপু! আপনার পছন্দ হয়েছে তো! আপনি খুব দারুণ লিখেন। আপনি খুব দারুণ বলেন। নিয়মিত আপনার ভিডিও চাই / নিয়মিত আপনার লেখা চাই।

এরকম আরো নানানভাবে আপুকে তুষ্ট করার এক প্রচুর প্রচেষ্টা ও প্রতিযোগিতা হয়। বিশেষত ফেসবুক-ইউটিব বা সোশ্যাল মিডিয়াতে এই ধরনের কাজগুলো একটু বেশিই দৃশ্যমান। কিন্তু হুবহু ওই উক্ত ব্যক্তিদের ফ্রেন্ড-লিস্টে যে আপুদের সহমত আপু বলে তুষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তারচেয়েও বেশি ভালো বলে, ভালো লিখে এরকম অনেক ব্যক্তি আছে, যারা হয়তো ছেলে হবার কারণে তার নজরে পড়ে না। কিংবা পড়লে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার তাগাদাও সে অনুভব করে না। আসলে এটাই বাস্তব। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি এই আকর্ষণটাই ন্যাচারাল। কিন্তু তারা যখন এটাকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, বিপত্তি সৃষ্টি হয় তখনই....

যাই হোক, বলছিলাম আপুদের তুষ্ট করার চেষ্টা নিয়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আপুকে তুষ্ট করার এই যে চেষ্টাটুকুন, এইটুকুন কেবল ফেসবুকিস্তানেই সীমাবদ্ধ থাকে। অথবা অফিসের কলিগ ও নন-মাহরাম অন্যান্য আপুদের সঙ্গেই বেশি হয়ে থাকে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ওই সমস্ত অধিকাংশ "সহমত আপু" ভাইয়াদের নিজ বোনের কোনো খবর নেই। ফেসবুকে বা কলেজ-ইউনিভার্সিটি কিংবা অফিসের কলিগ আপুদের যে পরিমাণ দৃষ্টি-আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়, যেভাবে তুষ্ট করার তদবির করা হয়— নিজের বউকে তুষ্ট করার এর আংশিক চেষ্টাটাও করা হয় না। বোনের বিষয়টা তো অনেক দূরের ব্যাপার, কারণ এই সমস্ত "সহমত আপু" ভাইয়ারা নিজ বোনের পিতৃ-সম্পদের অধিকারটুকুন পর্যন্তও দেয় না।

দিনে বা সপ্তাহে কিংবা মাসে, কখনো কখনো তো বছরেও একদিন নিজের বোনের সাথে কথা বলার ফুরসত মেলে না। খোঁজ নেওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয় না। করা হয় না বোনের কোনো কাজের প্রশংসাও। এরকম বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনাসহ স্বীকৃতি দেওয়া হয় না নিজ বোনের কোনো সু-কীর্তির। বা এভাবেও বলা যায় যে, নিজের বোনের কোনো কাজে এভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রণোদনাটা দেওয়া হয় না। বোন বা মায়ের সমগোত্রীয় খালা-ফুফু বা চাচি-মামিরা তো সবদিকেই থাকে গণনার বাইরে....

এটা তো গেল আপুদের বিষয়। সবচেয়ে বেশি জি 'হুজুর'। সহমত ভাই। দারুণ। সুন্দর। উত্তম। মনোমুগ্ধকর। ইত্যাদি বলে তেলে ভেজে তৈলাক্ত করা হয় নেতাদেরকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানদেরকে। যে কথা বলার জন্য উক্ত "সহমত ভাই" ব্যক্তিটি অন্যদের গায়ের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানিয়ে হলি নাচে মেতে উঠতো, নিষ্ঠুর সমালোচনায় মেতে থাকতো; সে একই কথা বা সমচিন্তা কোনো নেতা প্রকাশ করার পর নেতা হয়ে যান প্র‍্যাগমেটিক। বিচক্ষণ। বুদ্ধিমান। ক্যারিশমাটিক। অন্যরা যা বললে বা করলে যেত পাগল, উন্মাদ, অসহিষ্ণু, ভারসাম্যহীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন; নেতা বা বস সেটা করার পর হয়ে যান দুরন্ত। সাহসী। আপোষহীন। দুরদর্শীসহ আরো কত কী......

উঁহু, এটুকু পড়ে এই পাঠ নেওয়ার প্রয়োজন নেই যে—ফেসবুকে কোনো বোনের ভালো কাজের প্রশংসা করা যাবে না। বা সহমত আপু বলা যাবে না। কিংবা আপনার কোনো মহিলা কলিগ থাকলে তার কীর্তির স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না।

আবার অন্যদিকে এটাও বলিনি যে, নেতাদের আনুগত্য করা যাবে না। কিংবা তাদেরকে সমর্থন করা যাবে না। বস বা নেতার ভালো কাজগুলোর প্রসংশা করা যাবে না। কারণ, নেতার আনুগত্য না করলে, তার কমান্ড না মানলে, কিংবা কথা না শুনলে তো কোনো কাজই সমাধা হবে না। কোনো দেশ, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানই সুষ্ঠুভাবে চলবে না।

আমি যা বলছিলাম—সেটা হচ্ছে অধিকাংশ না হলেও পুরুষদের মধ্যে বড়ো একটা অংশ কোনো একটা কথা ফেসবুকে কোনো মেয়ে বলেছে বলেই দারুণ আপু, সুন্দর আপু, সহমত আপু ইত্যাদি বলা শুরু করেন। কেউ কেউ তো আছেন একেবারে মাত্রাতিরিক্ত সরেস! তারা তো অত্যধিক আবেগী হয়ে কাউকে কাউকে যুগের খাদিজা, রাবেয়া বসরীও বানিয়ে দেয়। যদিও সে বোন আদৌ আম্মা খাদিজা বা তাপস্বী রাবেয়া বসরীর মতো পরিপূর্ণ দীন-শরীয়ত বুঝেন কিনা, কিংবা পালন করেন কি-না সেটা দেখা বা বিবেচনার গরজও বোধ করেন না!

আবার নেতাদেরও সবকিছুকেই চোখবুঁজে সমর্থন করে চাটুকারিতা করার এক নিকৃষ্ট বদ অভ্যাস তো এ সমাজেই আছে। আপনি আমাদের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশে ঘুরে— এমন ব্যক্তিদের তেল চিটচিটে কথাবার্তার সয়লাব দেখতে পাবেন।

আসলে নেতৃত্বের মধ্যে, তার কাজকর্মের মধ্যে দুর্বলতা থাকবেই। ভুল ডিসিশন বা ভুল পদক্ষেপ বস বা নেতারাই নেবেনই। যেহেতু তারা মানুষ। কিন্তু ভুলটা সুন্দর করে নেতৃত্বের কল্যাণের স্বার্থেই ধরিয়ে দেওয়া উচিৎ। কিন্তু সেটা না করে যে কেবল চাটুকারিতাই করা হয়, সব সময় সহমত ভাই হয়ে যে নেতৃত্বের ক্ষতিই করা হয়, আমি সেটার কথায়ই বললাম।

ওহ, আচ্ছা, ফেসবুকে আবার সহমত ভাই 2.0 এবং সহমত আপু আপু নামে দুইটা পেইজও আছে কিন্তু....

~রেদওয়ান রাওয়াহা
১৭.০৫.২৩

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ