|| স্বপ্ন-সাহসের কবি মতিউর রহমান মল্লিক রহিমাহুল্লাহ ||

 






বিশ্বাসের বাতাসে স্নিগ্ধ কবি মতিউর রহমান মল্লিক তাঁর গান কবিতা মানেই হিমশীতল ঈমানটা উষ্ণ হয়ে উঠবে। উঠতে বাধ্য ! আবার প্রেম-প্রকৃতির নিটোল সৌন্দর্যের বর্ণনাও রয়েছে তাঁর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে! এই দুনিয়ার রঙ-রূপ দেখে তিনি হয়ে যাননি প্রকৃতি পূজারি। যাননি মহান রব্বকেও ভুলে। তিনি স্রষ্টার অপার বিস্ময়পূর্ণ পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখে সেই অসীমের চরণেই লুটিয়ে দিয়েছেন প্রশংসার ছন্দমালাকে। যেমন কবি বলেছেন-

তোমার সৃষ্টি যদি হয় এতো সুন্দর ,

না জানি তা হলে তুমি, কতো সুন্দর ..

আবার ঈমানের আলোয় উজ্জীবিত হয়ে ধরাকে কুরআনের আলোয় অবগাহনের আহবান জানিয়ে তিনি লিখেছেন

হেজাজের ঝড়ে জনপদে আন বন্যা,

কুরআনের সুধা পিয়ে হোক ধরা ধন্যা...

নয়া খেলাফত রাশেদার দ্বীন

ঘুচাক জাহিলি প্রলাপ ছল...

সমাজকে কুরআনের রঙে রাঙানোর শপথ করে অগ্রসর হওয়া সহজ কাজ নয়। সে জন্য চাই বিপুল পরিমাণ হিম্মত আর অনড় মনোবলের। কবির গান-কবিতায় যেন সেই সাহসের স্ফুরণ- ফুটে ওঠে। তাই তো তিনি লিখেছেন-

আমাকে যখন কেউ প্রশ্ন করে,

কেনো বেছে নিলে এই পথ,

কেনো ডেকে নিলে বিপদ

জবাবে তখন বলি,

মৃদু হেসে যাই চলি

বুকে মোর আছে হিম্মত ...

রোজই আমাদের কোনো না আশা ভাঙে। স্বপ্ন ভাঙে। আমরা তখন ভেঙে পড়ি। কিন্তু কবির কিছু কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের সেই হতাশার দেয়ালকে ভেঙে চুরচুর করে দিতে বিপুল পরিমাণ উৎসাহ-উদ্দীপনা দেয়। যেমন তিনি বলেন-

তুমি কি এখন স্বপ্ন ভঙ্গ কেউ

আশাহত কোনো লোক?

... তুমি কি ভেবেছো সূর্যটা ডুবে গেছে?

তুমি কি ভেবছো নেই আর কোনো আলো?

এইরকম সুন্দর আরো একটা চমৎকার গানে তিনি বলেন-

আকাশ মেঘে ডাকা রবে না

আলোয় আলোয় হেসে উঠবে

নদী গতিহীন রবে না

সাগরের পানে শুধু ছুটবে...

আমরা আমাদের জীবন নিয়ে উদাসীন। গড়ির কাটার মতো জীবনের কাটাও একদিন থেমে যাবে। তবুও পরকালের উপযোগী করে নিজেকে তৈরি করছি না। কবি তাঁর গান-কবিতার মাধ্যমে আমাদের সেই উদাসীনতার দেয়ালকে ভেঙে দিতে লিখেছেন-

টিক টিক যে ঘড়িটা বাজে টিক টিক বাজে

কেউ কি জানে সেই ঘড়িটা লাগবে কয়দিন কাজে

......যায় যায় দিন চলে যায় কুরআন পড়লাম না

কতো নভেল-নাটক পড়লাম হাদিস ধরলাম না।

সত্যিকারের খাঁটি মুমিন মুসলিম হলাম না যে...

পৃথিবীতে আমরা যে থাকতে আসিনি। এটা যে একটা মরিচীকা, এটা যে মোহ; তা তিনি গানের কথায় ফুটিয়ে তুলে বলেন -

পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়,

মরণ একদিন মুছে দেবে সকল রঙ্গিন পরিচয়।

মিছে এই মানুষের বন্ধন,

মিছে মায়া স্নেহ-প্রীতি ক্রন্দন।

মিছে এই জীবনের রংধনু সাতরঙ্গ,

মিছে এই দুদিনের অভিনয়।

আমরা ছোটোখাটো মতপার্থক্যের কারণে একজন অন্যজনকে সরিয়ে দিই হৃদয় থেকে। মন থেকে। করে ফেলি পর। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনটা ছিন্ন করে ফেলি নিমিষেই। তা যেন না করি, সে বিষয়ের অনুরোধে তিনি লিখেন-

যা কিছু করতে চাও করতে পারো,

অনুরোধ শুধু ওগো পর হয়ো না..

কখনো বেদনায় যাতনায় বিদীর্ণ হয়ে যায় আমাদের হৃদয়-মন, বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়। ধৈর্য ধারণ করা হয়ে পড়ে ভীষণ কষ্টের! তখন সেই কষ্টের মুহূর্তে, ক্ষত হৃদয়ের আর্তনাদ নিবারণের জন্য প্রভুর কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে তিনি লিখেন -

ধৈর্য ধারণ করার শক্তি দাওগো মেহেরবান..

বুকের ভেতর ব্যথার নদী বইছে অবিরাম..

হৃদয়ে বয়ে চলা যাতনা বিদূরিত করতে তিনি রব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করে গেয়েছেন -

হে খোদা মোর হৃদয় হতে

দূর করে দাও সকল বেদনা

সকল ভাবনা

দূর করে দাও সব যন্ত্রনা

সকল যাতনা......

ঈমানের চূড়ান্ত দাবি সম্পর্কেও তিনি ছিলেন সদা সচেতন একজন মানুষ। তাই তো কবি লিখেছেন-

ঈমানের দাবি যদি কুরবানি হয়

সে দাবি পূরণে আমি,

তৈরি থাকি যেনো, ওগো দয়াময়...

আমরা খুব আবেগ প্রবণ। হুট করেই একটা সীদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি জীবনে। কখনো আবেগ উথলে উঠলে মনে হয় আজই পৃথিবীটা পরিবর্তন করে ফেলি। প্রয়োজনে বাতিলের বুলেটের আঘাতে কলিজাটা জখম করে শহিদ হয়ে যাই। কিন্তু আবেগ শেষ। আমার দ্বীন প্রতিষ্ঠার জজবাও শেষ। কিন্তু সারাজীবন দ্বীনের জন্য আমরণ সংগ্রাম সাধনা করে করে লড়াই চালিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে পারি না। সে জন্য তিনি লিখেছেন-

হঠাৎ করে জীবন দেয়া

খুবই সহজ তুমি জান কি?

কিন্তু তিলে তিলে

অসহ জ্বালা সয়ে

খোদার পথে জীবন দেয়া

নয়তো সহজ তুমি মানো কি?

এভাবে আপনি যদি জীবনের মানে খুঁজতে যান বা জীবন-দর্শন অন্বেষণ করতে যান; তবে মল্লিকের গান-কবিতাতেই আপনি এসবের সুন্দর উত্তর এবং সমাধান পাবেন। জীবনের মানে নিয়ে তিনি বলেন-

জীবনের মানে হলো তারকাটার বেড়া ভেঙ্গে ফেলা

জীবনের মানে হলো প্রতিটি ফারাক্কা প্রচ- ধাক্কায়

শত্রুর বুকে কড়া বুমেরাং।

অন্য একটি গানে তিনি তাঁর জীবন-উদ্দেশ্য আরো সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করেন। আরো দারুণ করে তাঁর লক্ষ্য বলেন। সেটা হচ্ছে-

আম্মা বলেন ঘর ছেড়ে তুই যাসনি ছেড়ে আর

আমি বলি খোদার পথে হোক -জীবন পার......

আল্লাহর পথে জান-প্রাণ সঁপে দেওয়াটাই তাঁর জীবন-উদ্দেশ্য ছিলো। ক্ষেত্রে তিনি পরম মমমতাময়ী মায়ের স্নেহকেও উপেখ্যা করতে পারতেন।

তিনি হতাশার দোলাচলে দুলতে পছন্দ করতেন না। তিনি ছিলেন একজন স্বাপ্নিক কবি। তিনি আশাহীন মনে আশার ফোয়ারা ফুটিয়ে তুলতে বলেন-

না হয় হলো মন, শুকনো কোনো মরুভূমি

আশাহত হয়ো না কো তুমি......

এভাবে তিনি লিখেন-

কী হবে হতাশ হয়ে হারিয়ে গিয়ে?

কী হবে জীবন থেকে চুপিসারে পালিয়ে গিয়ে?

অন্য একটি গানে তিনি লিখেন-

যদি মন স্বপ্ন দেখা ভুলে যেতো

যদি বেদনার মাঝে সুখ মুখ লুকাতো

কিছু হতো না তবে কিছু হতো না

জীবনের সন্ধান কেউ পেতো না

এই রকম দুর্দান্ত সব কালজয়ী গানের রচয়িতা তিনিই। এসব রচনা করে তিনি আমাদের দেখিয়েছেন আশা। যুগিয়েছেন প্রেরণা। এভাবেই তিনি গানে গানে জীবন-দর্শন এবং জীবনের মানে উপলব্ধি করাতেন।

আশাহীন দুর্বিষহ মনটাকে তিনি আশার ভেলায় ভাসিয়ে দিতে চাইতেন। সাহসের সুখ নীলিমায় তিনি তরুণ মনকে সজীব-সতেজ করতে চাইতেন। তাই তো তাঁর সাহিত্য, দর্শন চর্চা করে একজন যুবক জীবন-যুদ্ধে এক অমিততেজা হিম্মত আর সাহসী উপেখ্যান তৈরি করতে পারতেন।

এই সাংস্কৃতিক মুজাহিদ ১৯৫০ সালের ০১- মার্চে জন্মগ্রহণ করেন বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামে। আর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে ইন্তিকাল করেন ২০১০ সালের ১২ আগষ্ট।

উল্লেখ্য, কবির বাবা মুন্সি কায়েম উদ্দিন মল্লিকও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি স্থানীয় জারিগানের দলের জন্য গান লিখতেন। কবির মায়ের নাম আয়েশা বেগম

কবি মতিউর রহমান মল্লিকের মধ্যে সাংগঠনিক গুণাবলিরও বিপুল সমাহার ছিলো। ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। তিনি বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।

জাতীয় কবি নজরুলের পরে মল্লিকই সবচেয়ে বেশি ইসলামি ধারায় অসংখ্য গান কবিতা রচনা করেন। আর একারণেই অনেকে তাঁকে অনেকেই সবুজ জমিনের কবি মানবতার কবি বলে থাকেন।

মল্লিক ইসলামি ধারায় কবিতা-গান রচনায় জীবনের সূর্য অতিক্রম করলেও কিন্তু তিনি তাঁর জীবন-প্রভাতে ইসলামি গান-কবিতা দিয়ে তা শুরু করেননি। শুরুর সময়ে তার লেখা প্রায় সব সৃষ্টিকর্মই ছিলো ইসলামি মূল্যবোধের বিপরীত যে প্রেম ভালোবাসা আছে, সেই প্রেম নির্ভর।

এই মানুষটিই পরে ইসলামি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মহীরুহে পরিণত হন। এবং তার হাত ধরেই ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী মতো কালজয়ী একটি সাংস্কৃতিক কাফেলা।

মল্লিকের পড়াশোনা হাতেখড়ি নিজ পরিবারে এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন বারুইপাড়া সিদ্দীকিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে। এরপর বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং আজকের জগ্ননাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (ততকালীন জগন্নাথ কলেজ) বাংলা ভাষা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

কর্মজীবনে কবি মতিউর রহমান মল্লিক সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন মাসিক কলম পত্রিকার সম্পাদক এবং মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন।

ক্ষণজন্মা এই মহান মনীষী বিশ্বাসীদের কবি মল্লিক রহিমাহুল্লাহর সকল কাজগুলো কবুল করুন মহান রব্বুল আলামীন। সাথে সাথে তার ত্রুটিগুলোও মার্জনা করুন। ফিরদৌসের শীতল আঙিনায় চালচলনের সুযোগ দান করুন। -মী-!!



~রেদওয়ান রাওয়াহা

 

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ