ইসলাম কি চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়?

 



 


গত শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী একজন নওমুসলিম নারী ইসলামি চিন্তাবিদ মরিয়ম জামিলা বলেছেন— “আমরা যারা জীবন-বিধান হিসেবে ইসলামকে মেনে চলতে চাই, তাদেরকে এটা মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা এই দ্বীন মেনে চলার কারণে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যায়িত হওয়ায় তাদের ভীত হওয়া উচিৎ নয়। আমাদের অবশ্যই বুঝা উচিৎ যে, তাদের দেওয়া এই আখ্যা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। বরং আমরা ইসলামকে কথিত যৌক্তিক, আধুনিক, বৈজ্ঞানিক, গতিশীল, উদার ও প্রগতিশীল করে কাফিরদেরকে তুষ্ট করার চেষ্টা করাটাই আমাদের জন্য ক্ষতিকর।” ( ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ, মরিয়ম জামিলা : পৃষ্ঠা-১১)।


মুহতারিমা মরিয়ম জামিলার (রহ.) এই কথাটা যে কতোটা যুৎসই এবং বাস্তব-সম্মত, এর প্রমাণ আমরা আমাদের সিউডো ইন্টেলেকচুয়াল মুসলিম ভাইবোনদের জীবনের প্রত্যেকটি পরতে পরতে দেখতে পাই। আমরা দেখতে পাই যে, পাশ্চাত্যের একজন লিবারেল-সেকুলার ব্যক্তি তাঁর আদর্শের ব্যাপারে যতোটা দৃঢ়, একজন বস্তুবাদী তার পিউর বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যতোটা কট্টর, এর ধারে কাছেও আমাদের মধ্যে অবস্থিত কথিত ক্রিটিকাল থিংকিংওয়ালা ইসলামিক স্কলার পদধ্বারীরা বা আমরা মুসলিমরা নেই। বরং আমরা কাফিরদের চোখে ইসলামকে একটু বেশিই পিউর করতে যেয়ে পর্দা, মিউজিক, ফ্রি-মিক্সিং, নারী নেতৃত্ব, বার্থডে সেলিব্রেশন, সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র ও সমকামিতা, ট্রান্সজেন্ডারসহ ইত্যাদির মতো কতো অগণিত বিষয়ে যে ছাড়-বিকৃতি ও আপোষ-মূলক অবস্থান গ্রহণ করেছি— তার কোনো হিসেব নেই।


উদাহরণ স্বরূপ দ্বীনের অন্যতম একটা ফরজ বিধান জিহাদের কথাটাই ধরুন না। আমরা আত্মরক্ষামূলক বয়ান দিয়ে কাফিরদের করুণা পেতে এই বিধানটাকে এতোটাই হালকা করে দিয়েছি, এতোটাই যে, আমরা এখন বয়ান করি, বিবৃতি দিই এই বলে— “ইসলামের সকল জিহাদ ছিলো আত্মরক্ষামূলক।” এমনকী জিহাদ বলতে যে দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্যে দ্বীনের দুশমনদের সাথে যুদ্ধ করা বুঝায়, সেটাও ভুলিয়ে দিচ্ছি জনগণকে এবং নিজেরাও মনে হয় সেটা ভুলে গিয়েছি। তোতাপাখির মতো আমরা একটা শব্দই কেবল আওড়িয়ে যাচ্ছি— সেটা হচ্ছে, ইসলাম শান্তির ধর্ম।


 অথচ ইসলাম তো শুধুই শান্তির ধর্ম না। ইসলাম হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার ধর্ম। এই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়োজনে মানবন্ধন হতে পারে। মিছিল-মিটিং হতে পারে। লেখালেখি হতে পারে। ব্যক্তিগত দাওয়াত হতে পারে। ওয়াজ-মাহফিল হতে পারে। আবার প্রয়োজনে অস্ত্রও হাতে নেওয়া লাগতে পারে। 


যেমন, কোনো গ্রামে ডাকাতের উৎপাত আছে। প্রতিদিন ডাকাত এসে আপনার মালামাল নিয়ে যায়। এখন সে গ্রামের মানুষেরা যদি বলে,  আমরা এই গ্রামের মানুষেরা শান্তি প্রিয়, আমরা যুদ্ধ-হাঙ্গামা বা মারামারি পছন্দ করি না। তাহলে তারা কি কস্মিনকালেও ডাকাতের হাত থেকে মুক্তি পাবে? বরং আপনি যদি শান্তি ফিরিয়ে আনতে চান, তাহলে ডাকাতকে শায়েস্তা করেই শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। আর ডাকাতকে শায়েস্তা কেবল মিষ্টি কথা দিয়েই করা যায় না, অস্ত্রও হাতে নিতে হয়। শক্তি-প্রদর্শন করতে হয়। ডাকাতদলকে আচ্ছামত সায়েস্তা করতে হবে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই। ইসলামের শিক্ষা এটাই, এরকমই।


আসলে ইসলাম এসেছেই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে। সকল বিধানের ওপর এক আল্লাহর বিধানকে বিজয়ী করার জন্যেই দ্বীন-ইসলামের আগমন। শান্তির বিপরীত যে অশান্তি, সে অশান্তিকে দূর করার জন্যেই আপনাকে অস্ত্রও হাতে তুলে নিতে হবে। মাঝেমধ্যে আক্রমনাত্মক জিহাদে যেতে হবে (তবে মাথামোটার মতো যখন তখন মন চাইলো আর অস্ত্র নিয়ে ফেললাম, এমনটা না)। বিষয়টা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রহিমাহুল্লাহ খুবই অল্প কথায় অনেক সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেন:

فَالْعَدُوُّ الصَّائِلُ الَّذِيْ يُفْسِدُ الدِّيْنَ وَالدُّنْيَا لَا شَيْءَ أَوْجَبُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ مِنْ دَفْعِهِ.

ঈমান আনার পর দ্বীন ও দুনিয়া-বিধ্বংসী আগ্রাসী শত্রুর প্রতিরোধের চেয়ে বড়ো কোনো কর্তব্য বা করণীয় নেই।’(আল ফাতাওয়া আল মিসরিয়্যা: ৪/৫০৮)।


ইসলাম ও মুসলমানরা যেন আগ্রাসী শক্তির আগ্রাসনের মুখে না পড়ে, পৃথিবী যেন শান্তির পতাকাতলে, আল্লাহর বিধানের অধীনে চলে, সে কারণেই দেখবেন মুসলিম খলিফার জন্য বছরে দু’একবার কাফিরদের সীমান্তে ফৌজ পাঠিয়ে ইকদামি তথা আক্রমনত্মক জিহাদ ফরজ। অথচ এখন দেখবেন ইসলামি আইন বাস্তবায়ন ও জিহাদের কথা আসলেই আমরা অনেকে আত্মরক্ষামূলক বয়ান তৈরি করে বলি যে, না না ইসলাম কিন্তু চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় না। দ্বীন কাউকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। সাথে মুখস্থ গঁদবাধা একটা আয়াত তো আছেই—  লা ইকরাহা ফিদ-দীন.!


 যাইহোক, আমরা জিহাদের বিষয় সামনে এলেই বলি, ইসলাম চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় না। ইসলাম তরবারির জোরে প্রসার লাভ করেনি (আসলে ইসলাম কেবলই তরবারির জোরে প্রতিষ্ঠা হয়নি, সত্য। তবে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তরবারি দরকার। আল্লাহর রাসূলেরও তা লেগেছে)। অথচ দেখুন আজকের বিশ্বের দিকে, কোন বিষয়টা পশ্চিমাদের নেতৃত্বের নিউ-ওয়াল্ড অর্ডার আমাদের ওপর চাপিয়ে না দিয়েছে? কোন বিষয়টার প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় তরবারি বা বুলেট-বোমার জোর না লেগেছে?


সেকুলারিজম কি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি? সর্বপ্রথম মুসলিমদের ওপর তরবারির জোরে সেকুলারিজম কামাল আতাতুর্ক কি চাপিয়ে দেয়নি? তরবারি ও ক্ষমতার জোরে জোর করে মুসলিম নারীদের হিজাব-নিকাব কেড়ে নেয়নি? রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কি আমাদের ওপর কমিউনিজমকে চাপিয়ে দেয়নি? চীন কি তার মতাদর্শ অন্যের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে না? উইঘুর মুসলিমদের ব্যক্তিগত জীবনটা ঘেটে দেখুন, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের দ্বীন পালন কি তারা কেড়ে নিয়ে তাদের রাষ্ট্রাচার-সমাজাচার-কমিউনিজম মুসলিমদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে না? আমেরিকা কি তার ধর্মহীন গণতন্ত্র মুসলিমদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে না? এই যে LGBTQ, সেটাও কি তারা মানুষের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে না? পাশ্চাত্যে বসবাসরত কোনো আলিম কি এটার বিরুদ্ধে এখন আর ওপেনলি কথা বলতে পারবেন? এটাও তো মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। 


আফগান-ইরাকের ওপর আমেরিকা তার অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে না? আফগান থেকে তালেবানকে সরিয়ে দিতে তরবারি তথা বুলেট-বোমা লেগেছে না পশ্চিমাদের? এখন আবার আফগান থেকে পলায়ন করছে না তালেবানদের তরবারির কাছে নত হয়ে? ফিলিস্তিন কি বর্বর পিচাশ ইয়াহুদিরা তরবারি ছাড়াই দখল করেছে? এখনও তো নিয়মিত ফিলিস্তিনের মাটিকে তরবারির জোরেই গ্রাস করে নিচ্ছে ইয়াহুদিরা। মোটকথা সবকিছুতেই তরবারি লেগেছে। এমনকী তরবারি সবসময়ই লাগবে।


এই যে আমেরিকানদের নেতৃত্বে আজকের বিশ্বব্যবস্থা, এই বিশ্বব্যবস্থার সবকিছুই তো চাপিয়ে দেওয়া। কেবল ইসলামটাই চাপিয়ে দেওয়া না আজকের দুনিয়ায়। অবশ্য পশ্চিমারা তাদের মতবাদ যে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে বা দিয়েছে, এটাকে আমি এক দৃষ্টিতে স্বাভাবিকভাবেই দেখি। কারণ তারা বিজয়ী শক্তি। বিজয়ী শক্তি বলেই তারা তাদের মতাদর্শ পরাজিতদের ওপর চাপিয়ে দেয় ও দেবে, এটিই স্বাভাবিক তাদের জন্যে। যদি এই চাপিয়ে দেওয়ার শক্তি তাদের না থাকতো, তাহলে তো তারা পরাশক্তি থাকতো না, হতেও পারতো না। যেভাবে এক সময় চাপিয়ে দেওয়ার শক্তি থাকার কারণে রাশিয়া পরাশক্তি ছিলো। আজকে রাশিয়া পরাশক্তি না। কারণ তার চাপিয়ে দেওয়ার শক্তি নেই। আবার এদিকে ইসলামি শক্তিগুলোর চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা না থাকার কারণে তারাও পরাজিত। যেদিন তারা চাপিয়ে দেওয়ার মতো সামর্থবান হবেন, সেদিন তারাও বিজয়ী হবেন।


তো এভাবে আমরা চাপিয়ে দেওয়া যায় না বা যাবে না বলে জিহাদের মতো করে পর্দা, পুরুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে হালাল করা বিধান একাধিক বিয়ে বা একাধিক স্ত্রী রাখার জায়েজ বিধান, মুরতাদের শাস্তির বিধান, কাফিরদের অন্তরঙ্গ বন্ধু না বানানোর বিধান, ধর্মহীন গণতন্ত্র, নাস্তিক্যবাদী সমাজতন্ত্র, রাসূল সা.-এর নিষেধকৃত বাদ্যযন্ত্র,  নিজের পায়ে দাঁড় করানোর নামে এবং কথিত উচ্চশিক্ষা অর্জনের নামে নারীদের আল্লাহ প্রদত্ত নির্ধারিত ফিতরাতি দায়িত্ব থেকে টেনে এনে পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেওয়াসহ সকল বিধানকেই কচলিয়ে কচলিয়ে বিকৃতি করে ফেলেছি, এখনো করে যাচ্ছি।


এই যে এগুলো করছি, সেটাও আবার কেউ কেউ করছি কথিত দ্বীনের নামে। দ্বীন বিজয়ের নামে। হাকিকত অন্বেষণের নামে। কিন্তু যারা এগুলো মানতে পারুক বা না পারুক— অন্তত ইসলামের বিশুদ্ধ অবয়ব টিকিয়ে রাখতে চায় জন্য এসব ভুল পন্থার বিপক্ষে বলে, এর বিপক্ষে লেখে, তাদেরকে আমরা উপাধি দিই উগ্রবাদী। চরমপন্থী। একদেশদর্শী।


তাদের নামে আমরা অপবাদ দিই। তাদের বিরুদ্ধে আমরা ঘৃণা ছড়াই। কতো জঘন্য আমরা। কতোটা জঘন্য আমাদের কর্মকাণ্ড। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। আল্লাহুম্মাগফিরলি..



[ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ নামক আমার একটা লেখা থেকে নেওয়া হয়েছে এই অংশটুকু]।



~রেদওয়ান রাওয়াহা

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ