মার্গারেট মারকিউস থেকে মরিয়ম জামিলা : সত্যসন্ধানী এক মহীয়সী নারীর গল্প

 


পৃথিবীর সবচেয়ে ধনাঢ্য দেশ আমেরিকার নিউ ইয়র্কের এক ইহুদি পরিবারে তাঁর জন্ম। বস্তুবাদী সভ্যতার সবকিছুই তাঁর সামনে থরে থরে সাজানো। দুনিয়াকে কানায় কানায় ভোগ করার মতো আপাদমস্তক সব কিছুই তাঁর হাতের মুঠোয়। তবুও অন্যান্য আরো আট-দশজন সাদা চামড়ার মার্কিন নাগরিকের মতো তাঁর জীবনপদ্ধতি ছিল না। তিনি তাদের মাঝে জীবনের মহৎ কোনো উদ্দেশ্য দেখতে পেতেন না। বরং তিনি লক্ষ্য করলেন যে, তাদের জীবনে ভোগবাদিতাই যেন সব। নৈতিকতা তাদের কাছে মূল্যহীন, যেন তা অপাঙক্তেয় ও অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয়।

তিনি ভোগবাদী সভ্যতার উপায়-উপাদানগুলো থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। তরুণী থাকাবস্থাতেই তিনি ছেলে ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দেওয়া, মদ্যপানের মজমায় মজে থাকা, মিউজিকের আসরে ডুবে থাকা, বাহারি রকমের সাজ-সজ্জায় নিজেকে প্রদর্শন করে বেড়ানো— এসবের কিছুতেই জড়াতেন না। 

তিনি জীবনের আসল মানে ও সত্যিকার অর্থ খুঁজে পাওয়ার আকুল আকাঙ্ক্ষা থেকে নেমে গেলেন এক নিরন্তর অভিযাত্রায়। অবলম্বন করলেন এক গভীর অনুসন্ধানী পথ। জন্মসূত্রে ইহুদি হওয়ায় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু পরিপূর্ণভাবেই নিবদ্ধ করলেন ইহুদি ধর্মের প্রতি। সে কারণেই প্রতি সপ্তাহে যেতেন ইহুদি-উপাসনালয়ে। ইহুদি রাবাইদের নাসিহাগুলো শুনতেন মনোযোগ দিয়ে। কিন্তু সেখানে ঐশী আলোর আভা দেখতে পেতেন না। মাজলুম ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাঁর স্বধর্মের ইহুদিবাদীদের জুলুমে তিনি ভারাক্রান্ত ও বেদনার্ত হতেন। অথচ তিনি জুলুমকে ঘৃণা করেন। জালিম ও জুলুমবাজদের উৎখাত চান। ভিড়তে চান ঐশী আলোর আঙিনায়। খুঁজে পেতে চান জীবনের মানে।

তবে এখানেও তিনি হতাশ হলেন। তাই তো ইহুদি ধর্মের প্রতি আস্থা হারিয়ে ঝুঁকে পড়েন তিনি নাস্তিক্যবাদের দিকে। কিন্তু কথিত মানবতাবাদী ও উদারতাবাদী নাস্তিক্যবাদের ওপরও তাঁর বিশ্বাস টিকে থাকলো না। 

মহা সত্যের রাজ তোরণের অনুসন্ধানে তাঁর অবিশ্রান্ত পথচলা চলছে তো চলছেই। সেই নিরন্তর যাত্রার কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁর সামনে উদ্ভাসিত হলো ইসলামের অনির্বাণ আলো।

 যুক্তি, বুদ্ধি, বোধ, আর প্রজ্ঞার প্রয়োগে তিনি অবশেষে খুঁজে পেলেন সেই মহাসত্য— দ্বীনে মুবিন আল-ইসলামকে, যা তাঁর আত্মাকে তৃপ্তি দিল। দূর করলো একে একে সকল অজ্ঞতা, সংশয়ের সকল কালো ধোঁয়া। তাঁর অন্তরের প্রতিটি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে দিল সত্যের শাশ্বত আলো, এনে দিল তাঁর শূন্য হিয়ায় এক পরম পূর্ণতা।

তবে তাঁর এই জার্নিটাও খুব বেশি কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ইসলামের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা ও ইসলাম গ্রহণ করার আগ্রহের কথা জানতে পেরে তাঁর পরিবার শুরুর দিকে খুব বেশি মানসিক চাপ প্রদান করে তাঁকে। তাঁকে বলা হয়— ইসলাম তার জীবনে জটিলতা সৃষ্টি করবে। আরো বলা হলো— এই ধর্ম ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মের মতো উদার নয়। অথচ তিনি তো কথিত এমন উদারতার সমর্থক নন। উদারতার খোঁজে ব্যতিব্যস্তও নন। তিনি তো হতে চান সত্যিকারের স্রষ্টার একনিষ্ঠ আনুগত্যশীলা। মহান রব ও তাঁর সত্য দ্বীনের দাসত্বের শৃঙ্খলে নিজেকে সঁপে দিতে চান একনিষ্ঠভাবে।

যা হোক, এভাবে নানাবিধ কথাবার্তা বলে তাঁর ওপর বড়সড় একটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। তিনি সেই মানসিক চাপে এতটাই পিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁর দ্বারা ইউনিভার্সিটির পাঠ চুকানো আর সম্ভব হলো না। ইউনিভার্সিটি থেকে তাঁকে তখনই বিদায় হতে হলো।

এরপর জীবন ও জগৎকে সত্যিকারভাবে জানতে ও বুঝতে তিনি শুরু করলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো ও অর্থবহ এক জার্নি। এই জার্নিতে তিনি খুঁজতে লাগলেন সত্যকে। অনুসন্ধান করতে লাগলেন রব কর্তৃক প্রেরিত আসল ও সত্যিকারের দ্বীনকে। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি বইয়ের পর বই পড়ে যেতে লাগলেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনও নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করতে লাগলেন। চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে লাগলেন তাঁর পরিচিত মুসলিম তরুণদের সাথে। কিন্তু ইসলামের যে সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইসলামের যে জীবনাচরণ, তারা সেই সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ অনুসরণের বদলে পশ্চিমা জীবনপদ্ধতিতেই মোহাবিষ্ট হয়ে থাকতো। যার ফলে তিনি তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। কারণ, তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে, এই লোকগুলো থেকে সত্য আর শুদ্ধতার সম্পূর্ণ বার্তা পাওয়া যাবে না। এরা ঐশী আলোর আঙিনা থেকে ছিটকে পড়েছে বহু ক্রোশ দূরে!

এবার তিনি ড. ফাদিল জামালি, শাইখ মুহাম্মদ বশির ইবরাহিম, মারুফ দেওয়ালিবি, ইমাম হাসান আল বান্না রাহিমাহুল্লাহর জামাতা ড. সাঈদ রামাদানসহ মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুফাক্কিরে ইসলাম উলামায়ে কেরামদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। তিনি সাইয়েদ কুতুব রাহিমাহুল্লাহর সাথেও পত্রালাপের চেষ্টা করেন। এরই প্রেক্ষিতে একটি চিঠি পাঠান তিনি সাইয়েদকে। কিন্তু সাইয়েদ কুতুব শহীদ ছিলেন তখন কারাগারে। কারাগারে থাকার কারণে খুব বেশি যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। সাইয়েদের পক্ষে তখন তাঁকে চিঠি লেখে পাঠান সাইয়েদ কুতুবের বোন আমিনা কুতুব। সাইয়েদ কুতুব রহ. তাঁকে সাইয়েদ মওদূদী রাহিমাহুল্লাহর বইপত্র পড়ার পরামর্শ প্রদান করেন। সাইয়েদ কুতুব শহীদ নিজেও ছিলেন সাইয়েদ মওদূদীর একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত।

কেটে গেলো অনেকগুলো দিন। অবশ্য তখনো তিনি মাওলানা মওদূদী রাহিমাহুল্লাহর ব্যক্তিত্ব ও লেখার সন্ধান পাননি। কয়েক বছর পর ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘দ্য মুসলিম ডাইজেস্ট’ নামক একটা পত্রিকায় উস্তাজ মওদূদী রাহিমাহুল্লাহর একটা প্রবন্ধ ছাপানো হয়। তিনি সেটা পড়েন। প্রবন্ধটি পড়ে তিনি ভীষণ মুগ্ধ হন। আর তখনই তিনি সাইয়েদ মওদূদীর সাথে যোগাযোগ করতে উদ্যোগী হন। পত্রিকার অফিসে গিয়ে মাওলানার ঠিকানা সংগ্রহ করে একটা চিঠি লেখেন। এরপর থেকে তিনি মাওলানার সাথে চিঠির মাধ্যমে নানাবিধ বিষয় জানার জন্য প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন। করে যেতে লাগলেন মতবিনিময়। 

এর মধ্যে ১৯৬১ সালে নিউ ইয়র্কের একটি মসজিদে গিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন, এবং সত্য দ্বীন আল-ইসলামের একজন নিশানা বরদার হয়ে ওঠেন। যেদিন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, সেদিন ছিলো ঈদুল আজহার দিন। খুশি আর আনন্দের দিন। উৎসব আর আমেজের দিন। তিনি সেই উৎসর্গের উৎসবেই নিজেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসর্গ করেন রাব্বুল আলামিন ও তাঁর প্রদত্ত বিধানের প্রতি। যেই উৎসর্গের জন্যই তিনি দীর্ঘদিন ধরে তৃষ্ণার্ত ছাতকের মতো অপেক্ষা করে গিয়েছিলেন।

 তো সেদিন আল্লাহর দ্বীনকে আপন করে নেওয়ার পর তিনি মার্গারেট মারকিউস থেকে হয়ে যান মরিয়ম জামিলা।

আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে মওদূদী রাহিমাহুল্লাহকে পত্রের মারেফতে জানান তিনি। মাওলানা মওদূদী তাঁর শক্তিশালী চিন্তা, তীক্ষ্ণ মেধা, গভীর প্রজ্ঞা, সূক্ষ্ম সৃজনশীলতা ও অসীম সাহসিকতা উপলব্ধি করতে পারেন। তাই তিনি তাঁর এসব দুর্দান্ত গুণাবলিকে সুচারুভাবে বিকশিত করার জন্য পাকিস্তানে হিজরত করার প্রস্তাব করেন। একপর্যায়ে তিনি এবং তাঁর পরিবারের কাছেও সেই প্রস্তাব পেশ করে চিঠি লেখেন। তাঁরা তাঁর সেই প্রস্তাবে সাড়া প্রদান করেন। এরপর তিনি তথা মরিয়ম জামিলা চলে আসেন পাকিস্তানের জমিনে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই থাকেন তিনি।

 মরিয়ম জামিলা পাকিস্তানে হিজরত করে বছর দুয়েক পরিপূর্ণভাবে উস্তাজ মওদূদী রাহিমাহুল্লাহর পারিবারিক মেহমান হিসেবে জীবন যাপন করেন। অতঃপর ১৯৬৩ সালে ইমাম মওদূদী রাহিমাহুল্লাহর অভিভাবকত্বে মুহাম্মাদ ইউসুফ নামক পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর একজন দায়িত্বশীলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

একটা চমৎকার বিষয় হচ্ছে তিনি যে মানুষটিকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেছেন, সেই মানুষটি ইতঃপূর্বেও বিবাহ করেছেন। তা জেনেও কোনো ধরনের হীনম্মন্যতার শিকার না হয়ে উক্ত ব্যক্তিকে বরণ করে নিলেন নিজ জীবনে। আমৃত্যু স্বামী-সতীনের সাথে সুন্দর সম্পর্কও বজায় রেখে সংসারও করে গিয়েছেন।

এই যে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন, এই ইসলামে তিনি দাখিল হয়েছেন পরিপূর্ণভাবে, বুঝে-শুনে। যে দ্বীনকে তিনি গ্রহণ করেছেন, মনেপ্রাণে সেই দ্বীনের সকল বিধিমালা অনুসরণ করে গিয়েছেন নিষ্ঠার সাথে। আর এই দ্বীনের শ্রেষ্ঠত্ব ফুটিয়ে তোলার কাজ আঞ্জাম দিয়ে গিয়েছেন আমৃত্যু।

যে পাশ্চাত্যের মোহে আজ আমরা মোহাবিষ্ট, তিনি সেই মোহকে দু’পায়ে দলিতমথিত করে তাদের কদর্যস্বরূপ উন্মোচন করেছেন বিশ্ববাসীর সামনে। তাঁর ক্ষুরধার যুক্তিপূর্ণ লেখনীর মাধ্যমে তিনি তাদের নগ্নরূপ-আসল স্বরূপ উদঘাটন করেছেন। 

যে ইসলামকে আজ আমরা সামনে পেয়ে অবজ্ঞা আর অবহেলার সাগরে নিক্ষেপ করছি— তিনি সেই ইসলামকে জানার জন্য, বোঝার জন্য কী অপরিসীম সাধনা করেছেন, কী অসাধারণ ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছেন, কী পরিমাণ শ্রম ও সময় ব্যয় করেছেন; তা তাঁর জন্মভূমি আমেরিকা থেকে পিতা-মাতা ও স্বজনদের ছেড়ে অজানা-অচেনা একটা দেশে হিজরতের বিষয়টির দিকে তাকালেই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

আজ আমরা পশ্চিমাদের কাছে বা ইউরোপ-আমেরিকার কাছে একটুখানি গ্রহণযোগ্যতা পেতে, তাদের চোখে একটুখানি ভালো হতে, তাদের কথিত প্রগতিকে, কথিত সভ্যতাকে প্রশ্ন না করে, দ্বীনকে অস্বাভাবিকভাবে বিকৃত করছি এবং করে যাচ্ছিও নিত্যদিন। মুখ বুজে তাদের সবকিছুকেই গ্রহণ ও বরণ করে নিচ্ছি নিজেদের জীবনে।

 কেউ কেউ আবার তাদের (পাশ্চাত্যের) বিভিন্ন বিষয় আশয়কে ইসলামাইজেশন করার কাজে ব্যতিব্যস্ত। তাদের বিভিন্ন বিষয় আমদানি করে যাচ্ছি নিজেদের রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে। অথচ মরিয়ম জামিলা রহ. তাদের পরিবেশে, তাদের সমাজ-সভ্যতায়, তাদের রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করার পরও ইসলামকে তাদের চোখে বা তাদের চশমায় দেখেননি। দেখেছেন ঐশী আলোর ফ্রেমে। দেখেছেন আসমানের আয়নায়। দেখেছেন কুরআন ও হাদিসের ফ্রেমে। তাই তো তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার অসামঞ্জস্যতা ও অসারতা, তাদের নানাবিধ গালভরা বুলির ভেল্কিবাজিগুলো নিজের শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন দুনিয়ার মানুষদের সামনে।

আমরা নিজেদের মুসলিমও দাবি করি, আবার পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ও স্বার্থপূজারি সভ্যতার বন্দনাও করি। দুনিয়াবি স্বার্থ আর বস্তুবাদের পেছনে পঙ্গপালের মতো হন্যে হয়ে ছুটছি তো ছুটছিই...! আমাদের কাছেও যেন বিষয়টি মনে হয় এমনই হয়ে গেছে—  ভোগবাদিতাই সব, নৈতিকতা মূল্যহীন!

 অথচ ইসলামকে ধারণ করা ব্যক্তিদের তো প্রাধান্য দেওয়ার কথা আল্লাহকে। তাঁর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। পরকালকে। নীতি-নৈতিকতা ও দ্বীনি মূল্যবোধকে। যেমনটি মরিয়ম জামিলা (রহ.) বলেছেন। তিনি বলেছেন— “কোনো ব্যক্তি যখনই পরকালে বিশ্বাস করেন, তখন দুনিয়ার অত্যধিক মূল্যবান জিনিসও তার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। পরকালে বিশ্বাস ঈমানদারকে জীবনের প্রকৃত প্রেক্ষিতের সন্ধান দেয়।”

এই যে ওপরের কথাটি, তিনি এসব কেবল বলাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বরং ছিলেন তাঁর কথারই বাস্তব প্রতিচ্ছবি। তাই তো উপরিউক্ত কথাটিরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি ছিলেন মরিয়ম জামিলা রহ.।

 আমরা বা আমাদের মতো অগণিত মানুষের স্বপ্ন যেখানে বস্তুগত উন্নতির চূড়ায় অবস্থান করা আমেরিকা-ইউরোপের বাসিন্দা হওয়া, জীবনের ঝুঁকি নিয়েও আমরা যেসব দেশে সেটেল্ড হতে পাড়ি জমাই; সেখানে তিনি জন্মসূত্রে আমেরিকান নাগরিক হবার পরও, ভোগবাদী জীবনের সবটুকুন নিজের হাতের মুঠোয় পেয়েও ঈমানের ওপর অবিচল থাকতে, দ্বীন নিয়ে দ্বিধাহীনভাবে কাজ করতে হিজরত করলেন বা পাড়ি জমালেন প্রাচ্যের জরাজীর্ণ এক মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ডে। আমৃত্যু আর কখনো পশ্চিমে ফিরে যাবার চিন্তাও করেননি। এটাই হলো প্রকৃত জীবনের সন্ধান। এটাই হলো পরকালের বিশ্বাস। এটাই তো তাঁর সেই কথার— “কোনো ব্যক্তি যখনই পরকালে বিশ্বাস করেন, তখন দুনিয়ার অত্যধিক মূল্যবান জিনিসও তার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ে”— বাস্তব সাক্ষ্য ও উত্তম নমুনা।

আমরা হতাশার হিমালয় ঝাড়তে ইসলামের সীমা-পরিসীমা অতিক্রম করে ফেলি। দ্বীনের দেওয়ালটা ভেঙে চুরচুর করে ফেলি। মানসিক প্রশান্তি পেতে কী-বা না করি আমরা? অথচ তিনি তাঁর মানসিক প্রশান্তি ইসলামে এসে খুঁজে পেয়েছেন। তাই তো তিনি বলেছেন—“মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ইসলাম খুবই কার্যকরী ওষুধ।” 

তিনি বা তাঁর মতো অগণিত মানুষ অন্তরের প্রশান্তি বা কলবের সুকুন পেতে দ্বীন-ইসলামের দালানে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, এবং এখনো করে যাচ্ছেন বহু বনি আদম। আর আমরা ডিপ্রেশন তাড়াতে মিউজিকের মজমায় মজে থাকি। নাটক-সিনেমায় বিভোর হয়ে থাকি। মদের নেশায় মাতাল হয়ে ডুবে থাকি!

জন্মগত মুসলিমদের তুলনায় তাঁর বিশ্বাসের ভিত কতোটা মজবুত আর বিশুদ্ধ ছিল, তা মাওলানা মওদূদীকে লেখা তাঁর একটি পত্রাংশ থেকেই বুঝা যায়। যেখানে তিনি বলেছেন— “অনেক সময় বাহ্যিক দৃষ্টিতে যা খুবই খারাপ মনে হয়, তাও বান্দার জন্য আল্লাহর রহমতে ভালোয় পরিণত হতে পারে।” 

এই কথাগুলো তিনি তখন বলেছেন, যখন তিনি সবেমাত্র নতুন মুসলিমাহ হয়েছেন। অথচ আমরা বা আমাদের মতো অগণিত জন্মগত মুসলিমরাও এই বিষয়টার ওপর বিশ্বাস ধরে রাখতে পারি না। অবশ্য হিসেবের খাতা ধরে টান দিলে আমরা নিজেদেরকে মুসলিমের তালিকায় দেখতে পাবো কি-না, তা নিয়ে অবশ্য যথেষ্ট সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। কারণ, আমরা তো প্রতিটি পদে পদে আল্লাহর বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করি। 

সমাজ ও সমাজের মানুষদের তুষ্ট করতে খোদার শরিয়তের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করি, অথবা খোদার দ্বীনের অপব্যাখ্যা করি। আল্লাহ যেভাবে চলার হুকুম করেছেন, সেভাবে না চলে চলি পরিবেশের হুকুমে। সমাজ ও সমাজের মানুষের হুকুমে। এভাবে যে হররোজ আল্লাহর অগণিত বিধানের লঙ্ঘন করে যাই, এর জন্য আমাদের মধ্যে আবার কোনো ধরনের দুঃখবোধও নেই। এই যে বিষয়টা, এটা নিয়েও মরিয়ম জামিলা কলম ধরেছেন। একজন সত্যিকারের মুসলিম হিসেবে আমাদের কাজ কী, তিনি তাঁর সেই উপলব্ধিটাও তুলে ধরেছেন। শুনুন তাঁরই কলম থেকে। তিনি বলে— “সত্যিকারের মুসলিম বর্তমান জীবনের সঙ্গে সঙ্গত না হলেও আল্লাহর শরিয়তের কোনো আদেশ অমান্য করবে না। তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ যেভাবে চলতে বলেছেন, সেভাবে চলা। আল্লাহর আইনকে সে বোঝা মনে করবে না; বরং আনন্দের সাথে তা মেনে চলবে। আল্লাহর অবাধ্যতায় সে যে পরিমাণ দুঃখ পাবে, অন্য কিছুতে সে এতো অধিক দুঃখ পাবে না।”

এই মহীয়সী মুহসিনা নারী দ্বীনের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার পরে নিজের মধ্যে পশ্চিমা জীবনের বিন্দুমাত্র চাপও রাখেননি। একেবারেই ইসলামী রীতিনীতি মোতাবেক জীবন যাপন করেন শেষ দিন অবধি। তিনি কখনো পাবলিক প্লেসে এসে অযথা কোনো কারণে নিজেকে প্রদর্শন তো করেনইনি এবং কথিত দ্বীন প্রচারের জন্যও করেননি। হিজাব-নিকাব-জিলবাব বা বোরকায় আপাদমস্তক নিজেকে আবৃত করে রাখেন তিনি। আজকে অনেক সো-কল্ড পর্দানশিন ইসলামী মহিলা যেভাবে মাথায় স্রেফ একটা তেনা পেঁচিয়ে পর্দার নামে তামাশা করেন, তিনি সেটা কখনোই করেননি।

প্রগতিবাদী কথিত আধুনিক মুসলিমগণ যেভাবে টেনে হিঁচড়ে নারীকে ঘর থেকে অপ্রয়োজনে বের করে এনে পুরুষের কাজে ও কাতারে নামাতে চায়, তিনি সেটা কখনোই চাননি। একজন মুসলিম নারীর কাজ এবং নারী-পুরুষ সম্পর্কের ব্যাপারে উস্তাজা মরিয়ম জামিলা রহ. বলেন :

১. একজন অশিক্ষিত ও উদাসীন মুসলিম নারী কিছুতেই অনৈসলামিক প্রভাব যা দিবারাত্রি তার সন্তানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তা প্রতিহত করতে পারেন না। শুধুমাত্র একজন শিক্ষিত, চতুর ও অত্যন্ত আগ্রহশীল মুসলিম নারীই পারেন বর্তমান প্রতিকূল পরিবেশের সামনে সাহসের সাথে মুখোমুখি হতে। 

২. ইসলাম নারীকে পুরুষের অঙ্গনে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়নি। তার দায়িত্ব নির্ধারিত হয়েছে; তার ঘরে, তার স্বামীর সংসারে। তার সার্থকতা ও সফলতা নির্ধারিত হয়েছে স্বামীর প্রতি তার আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা এবং মানিক-রতন সন্তানদের লালন-পালনের মধ্যে। সকল মুসলিম নারীরই পছন্দের বিষয় হলো গোপনীয়তা, আর এ জন্য পর্দাই হচ্ছে অপরিহার্য মাধ্যম।

৩. জীবন নাট্যের যে দৃশ্যের পুরুষ হবেন ইতিহাসের নায়ক, সে পটভূমিকায় পর্দার অন্তরালে নারী হবেন তার সকল কর্মকাণ্ডের সহায়ক। (ইসলাম ও আধুনিক মুসলিম নারী, পৃষ্ঠা: ১৩-১৬)।

১৯৩৪ সালের ২৩ মে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে জন্মগ্রহণ করা এই মহীয়সী মুহসিনা নারীর উল্লেখযোগ্য কিছু বই হলো:

• ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ

• ইসলাম ও আধুনিক মুসলিম নারী

• ইসলামী আন্দোলনের মেনিফেস্টো

• ইসলাম ও আধুনিকতা

• আধুনিক প্রযুক্তি এবং মানুষের অমানবিকরণ

• শায়খ হাসান আল বান্না ও আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন

• পাশ্চাত্য সভ্যতা কি সর্বজনীন?

• বর্তমান সঙ্কট মোকাবিলায় ইসলাম

আমাদের অঙ্গনে অনেক বোনেরাই নাকি নারী জাগরণ চান। বেশ ভালো কথা! এটা আমরাও চাই। তবে আমাদের নারীদেরকে জাগতে হলে এই মহীয়সী মানবীর মতো পরিপূর্ণভাবে ইসলামকে ধারণ করেই জাগা উচিত! অন্য কারো কিছু ভুংভাং কথা শুনে বা লেখা পড়ে কিছুটা ইসলাম কিছুটা ফেমিনিজম নিয়ে জাগা উচিত না। 

উস্তাজা মানতে হলে বা আদর্শ হিসেবে কাউকে সামনে রাখতে হলে এই ধরনের মানবীদেরকেই সামনে রাখা উচিত। আদর্শ হিসেবে এঁদেরকেই মানা উচিত। জিন্স পরিহিতা মাথায় এক একটুরো পট্টি পেঁচানো কোনো ব্যক্তিকে নয়। এমন কথিত কোনো প্রগতিবাদী ইসলামের ভেকধারী কাউকে মানবেন তো বিভ্রান্ত হবেন। অবশ্য তিনি এসব কথিত আধুনিক-প্রগতিবাদী বা মডারেটরদেরও কঠিন সমালোচক ছিলেন। তিনি তাদের সমালোচনায় একটা অকাট্য ও স্পষ্ট সত্য কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন— “আধুনিকতাবাদীরা আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ না করে; বরং তারা চায় আল্লাহ তাদের কাছে নত হোক।” (নাউজুবিল্লাহ)।

বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর এই মহীয়সী মুজাহিদা পৃথিবী থেকে বিদায় নেন ২০১২ সালের ৩১-শে অক্টোবর। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া-ইন্না ইলাইহি রাজিউন!

আল্লাহ এই মহীয়সী নারী এবং তাঁর সকল সৃষ্টিকর্ম, তাঁর করা সব কর্মতৎপরতাকে কবুল করুন। আমাদের সকল পরিবারগুলোকে দ্বীনের মারকাজ হিসেবে কবুল করুন। মহান পরোয়ারদিগার রাব্বুল আলামিন আমাদের পরিবারগুলোলোতে তাঁর মতো অগণিত মরিয়ম জামিলা পয়দা করে দিন।

 আমাদেরকেও তাঁর মতো সত্যের একনিষ্ঠ সাধক এবং অনুসারী হিসেবে কবুল করুন। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদের জীবনের যাবতীয় ভুলগুলো ক্ষমা করে দিন, এবং মুহতারিমা উস্তাজা মরিয়ম জামিলা রাহিমাহাল্লাহর জীবন ও কর্মের বদৌলতে তাঁকে ফিরদাউসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন!


~রেদওয়ান রাওয়াহা

[লেখাটি ছাত্র সংবাদ, জানুয়ারি-২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত ]

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ