সবার কি সরকারের বিরোধিতা করা উচিৎ?
শাইখুল হাদিস আল্লামা মামুনুল হক আজ অবধি জেইলে। আমীর হামজা প্রায় বছর কারাগারে ছিল, তা তো আমাদের জানাই। এভাবে অনেক আলিমই কারাগারে ছিল বা এখনো আছে।
এই মানুষগুলোকে খুব বেশি গুরুত্ব কেউ দেয় না। কারণ এরা হয়তো বড়ো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা না। অথবা কোনো রাজনৈতিক দলের লোক হলেও সেই দলের বড়সড় নেতা না। আবার সেকুলার বুদ্ধিজীবী বা একাডেমিশিয়ানও না।
এই যে এই মানুষগুলো বিপদে পড়ে আছে, কোন কারণে জানেন? তাদের কিছু কার্যক্রম, কথাবার্তা সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েছে। অথচ এই আমীর হামজা কি মন্ত্রী কিংবা এমপি হবার ন্যুনতম সম্ভাবনা আছে? নেই তো। উপজেলা চেয়ারম্যানও হবে না।
তবুও তারা কখনো কখনো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু বলে। আসলে কেউ ভুল করলে তার ভুলের বিরুদ্ধে বলতেই হবে, স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা যেকোনো দলই করি না কেন, আমরা আমাদের দলের ভুল শুনলে বা কেউ আমাদের দলের ভুলের বিরুদ্ধে কিছু বললেই সহ্য করতে পারি না।
আপনি বাংলাদেশের যেকোনো দলের বিরুদ্ধেই কিছু বলে দেখুন না কেন, আপনার ইজ্জত-আভ্রু ধুলোয় ধূসরিত করে দেওয়া হবে।
আপনার সন্তানের বয়সী পোলাপানও আপনাকে তুমুল অপমান অপদস্ত করবে।
ইদানীং কেউ কেউ দাবি করেন শাইখ আহমদুল্লাহ সাহেব কেন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কিছু বলেন না? কেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলেন না? কেন এই সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে মিছিল করেন না? কেন আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য নাম ধরে সমালোচনা করেন না?
অথচ শাইখ আহমদুল্লাহ সাহেব যদি সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলে জেইলে যান, এরা একটা দিনও তাঁর পক্ষে মাঠে নেমে মিছিল-সমাবেশ করবে না। একটা দিনও তাঁর মুক্তির জন্য হরতাল অবরোধ করবে না। যেভাবে করেনি আমীর হামজা গ্রেফতার হবার পরে। যেভাবে করেনি মুফতি কাজী ইবরাহিম গ্রেফতার হবার পরে।
উল্টো আবেগের বশে এসব নিয়ে যদি আহমদুল্লাহ সাহেব তুলকালাম করেন, সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেন, তাহলে তিনি অনেক খেদমত করা থেকে বঞ্চিত হবেন। ইসলামের উপকার হতো, এমন বহু কার্যক্রম পরিচালনা করা থেকে বঞ্চিত হবেন।
একটা বিষয় দেখুন, জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবিরের নেতৃত্ব তৈরির কেন্দ্র— যেখানে নির্বিঘ্নে শিবির তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ-উত্তর-গাজিপুর মহানগর শাখাগুলোর অধিকাংশ নেতৃত্ব তৈরি হয় যে প্রতিষ্ঠান থেকে, সেটা হচ্ছে তামিরুল মিল্লাত মাদরাসা। এই মাদরাসার অধ্যক্ষ, আমাদের সম্মানিত উস্তাদগণ কয়দিন আমাদেরকে নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন?
তামিরুল মিল্লাতের মুহতারাম অধ্যক্ষ শাইখুল হাদিস ড. আবু ইউসুফ উস্তাদ কয়দিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হুংকার দিয়েছেন?
এটা তো গেলো একটা দিক। অপরদিকে আসুন রাজনৈতিক বা পিউর সাংগঠনিক দায়িত্বশীল ও শাখাগুলোর দিকে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির সভাপতি, বুয়েটের শিবিরের সভাপতি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ বা মেডিক্যাল জোনের সভাপতি কয়দিন জালিম হাসিনার বিরুদ্ধে হুংকার দিয়েছেন? কয়দিন প্রকাশ্যে ময়দানে নেমেছেন? কয়দিন এসব ক্যাম্পাসে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিজেদের জনশক্তি নিয়ে রাজপথে নেমেছেন? একদিনও নেমেছেন?
এবার প্রশাসনে যারা জামায়াতে ইসলামীর সাথে যুক্ত, তাদের কথায় আসি। তারা কি হাসিনার বিরুদ্ধে বলে? হুংকার দেয়? নাকি উল্টো হাসিনার আনুগত্য করে। কখনো কখনো সেসব আনুগত্যের জায়গা থেকেই তারা না চাইলেও নিজ সংগঠনের ভাইদের গ্রেফতার করতে হয়। মারতে হয়।
আমার শ্রদ্ধেয় ভাই, বাংলাদেশের ইসলামী সংগীত জগতের কিংবদন্তি মুহতারাম সাইফুল্লাহ মানসুর, উস্তাদ তোফাজ্জল হোসাইন খান, মশিউর রহমান কয়দিন সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে হুংকার দিয়েছেন? কয়দিন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন?
তাদের কি নামা উচিৎ না?এসব করা উচিৎ কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার না? আমি মনে করি নামা উচিৎ না আপাতত। কারণ, সবার কাজ সবটা না। সবাই সবকিছু করবে না।
একেকজন একেকভাবে নিজেদের দলের উপকার করবেন। একেক শাখা সংগঠনকে একেকভাবে সার্ভিস দেবে।
একেক মুসলিম, একেক আলিম একেকভাবে আল্লাহর দীনের খিদমত করবেন।
যারা রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে তথা ইসলামের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কাজ করেন, তারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আন্দোলন করবেন। সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। দরকার হলে গণজাগরণ তৈরি করবেন। জনগণকে উস্কানি দিতে হলে সেটা দেবেন। এবং জামায়াতে ইসলামীতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়, এমন হুজুরও বহু আছেন। তারা নেতৃত্বেও আছেন কেউ কেউ। যেমন অধ্যক্ষ ইজ্জত উল্লাহ, মাওলানা এটিএম মাসুম, মাওলানা আব্দুল হালিম। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, জনগণকে সংগঠিত করা, রাজনৈতিক বয়ান ও কর্মসূচি তৈরি করবেন তারা।
এছাড়াও দলের রুকন আবুল কালাম আজাদ বাশার, ফখরুদ্দিন, মিজানুর রহমান আজহারীসহ অগণিত বক্তা-হুজুর-ওয়াজিন আছেন।
তারা কি সরকারের বিরোধিতা করে? ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কয়দিন তারা জনগণকে সচেতন করে বক্তব্য দিয়েছেন?
এটা কি তাদের ভুল? যদি তাদেরটা ভুল না হয়, তাহলে শাইখ আহমদুল্লাহরটা ভুল হতে যাবে কেন? আমার বক্তব্য পরিস্কার, যারা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত না, তারা তাদের অঙ্গনে থেকেই ইসলামের সেবা করুক। যেমন সরকারের বিরুদ্ধে না বলে কারো কারো উচিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ইসলামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে ভূমিকা রাখা উচিৎ।
এই কাজ করতে গেলে প্রাথমিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা না পেলেও কিন্তু ইসলামের ঘোরতর দুশমনদের দুশমনি চলতেই থাকবে। এক পর্যায়ে অতি-অবশ্যই তাদেরকেও এস্টাবলিশমেন্টের রোষানলে পড়তে হবে।
যেমন শাইখ আহমদুল্লাহ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু না বলার পরেও নিঝুম মজুমদারের মতো ইসলামের টাটকা দুশমনরা ওনার বিরুদ্ধে, ওনার আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্বেষ চর্চা করেন, বিরোধিতা করে।
সুতরাং সবাই একসাথে সরকারের প্রথম কাতারের শত্রু না হয়ে ধীরে ধীরে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করা উচিৎ।
এখন যারা আহমদুল্লাহ সাহেব সরকারের বিরুদ্ধে বলে না কেন; এই প্রশ্ন করে ওনার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ চর্চা করেন, এরা হয় অধিকাংশই বেকুব, নতুবা হিংসুক, অথবা দলান্ধ ও দল পূজারি। শাইখ আহমদুল্লাহসহ এমন যারা আছেন, তাদের উচিৎ না এদের কথায় কান দেওয়া। এদের জন্য আল্লাহর কাছে হেদায়েতের দু'আ করাটাই কাম্য।
তাহলে আমার কথার সামারি হলো— আমি মনে করি সবার সরকারের বিরোধিতা করা বা বিরুদ্ধে বলার দরকার নেই (প্রকাশ্যে ও সক্রিয়ভাবে)। একটা গ্রুপ এমন থাকবে, যারা সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে— কোনোদিকেই অবস্থান গ্রহণ করবে না।
সরকারে যেই আসুক— তারা তার কাছে ইসলামের দিকনির্দেশনা, ইসলামি তাহজিব-তমুদ্দুনের বিষয়গুলো নিয়ে হাজির হবে। চরম ইসলাম বিদ্বেষীদের এজান্ডাগুলো সম্পর্কে হুকুমতকে সংশোধনী দেবে।যেমন এই যে শিক্ষাব্যবস্থার বিকৃতি, ট্রান্সজেন্ডার, মনে মনে নিজেকে নারী বা পুরুষ ভাবা, সমকামিতার মতো জঘন্য কাজকর্ম, পহেলা বৈশাখের নামে মূর্তি ও হুতোম প্যাঁচার পুজো, থার্টি-ফাস্ট-ভ্যালেন্টাইন্স; ইত্যাদির মতো চরম গর্হিত কাজগুলোকে কিন্তু চরম ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠীগুলো সরকারের সাথে সমঝোতা করে, ওপরে ওপরে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেই বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। অথচ এদের অনেকেই ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশের সব ধরনের রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ঘৃণা করে (কেবল কিছু বামপন্থী ও বামপন্থী রাজনৈতিক দল ছাড়া)।
আবার বামদের একটা অংশ দেখুন, তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগকে মাধ্যম বানিয়েছে। অন্যদিকে ফরহাদ মাজহার ও ফরহাদ মাজহারদের মুরিদানসহ এই টাইপের একটা গ্রুপের দিকে তাকান, তারা আবার কথিত উদারতাকে মাধ্যম বানিয়েছে এবং বিএনপির ঘাড়ের ওপর সওয়ার হয়েছে। এরা আবার জামায়াতের কিছু লোকজনকেও নিজেদের আশেকান বানাতে পেরেছে।
এবার ওই যে নিজেকে মনে মনে মেয়ে ভাবা হুচিমিন ইসলাম, তার দিকে তাকান। সে লো-কোয়ালিটির বামপন্থী একটা ছেলে। এক সময় আওয়ামী লীগ আর হাসিনাকে ধুয়ে দিত নিয়মিত, কিন্তু এখন সে তার চরম ঘৃণিত ও গর্হিত কাজগুলোকে সহজে বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগ ও হাসিনার আনুকূল্য পাবার চেষ্টা করেছে। হাসিনার প্রশংসায় ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে।
তার মানে দেখুন, সে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য একটা অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রকাশ্যে তার পূর্বেকার লীগ ব্যাশিং ছেড়েছে। শুধু ছাড়েইনি, এখন হাসিনার চাটুকারিতাও করে যাচ্ছে।
কিন্তু ৮০/৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশের আলিমদের একটা অংশেরও উচিৎ প্রকাশ্যে কোনো সরকার ও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কোমরবাঁধা অবস্থান না নিয়ে ইসলামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও মুসলিম উম্মাহর ঐতিহ্যগুলো নিয়ে কাজ করে যাওয়া। কোনো সরকারকে সরাসরি নিজেদের দুশমন না বানানো।
এর মানে এই না যে আমি ক্ষমতাসীনদের চাটুকারিতা করার কথা বলছি, অথবা ইসলামপন্থীদেরকে কথিত উদারতার ভেক ধরতে বলছি, আদর্শের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করতে বলেছি বা অন্য কারো ঘাড়ে সওয়ার হবার কথা বলছি। না, এমন কিছুই না। তারা তাদের অবস্থান থেকে কাজ করে যাবে। (যদিও এই কাজের জন্যও হুট করেই ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠীগুলো একটা সময় তাদেরকে সরকার ও রাষ্ট্রের দুশমন বানিয়ে দেবে)।
বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো সেকুলার দলগুলোর সাথে ইসলামী দল ও আলিমদের একটা অংশের সম্পর্ক বজায় রাখা বা কাজ করার কথা যদি বলি, তাহলে দেখা যাচ্ছে এতে খুব বেশি উপকার পাওয়া না গেলেও কিছুটা হলেও তাদেরকে ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত করার পথ খোলা থাকে। যেমন জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিশ, ইসলামী ঐক্যজোটসহ কিছু ইসলামিক সংগঠন বিএনপির সাথে যে জোট করেছে; এতে সুফল খুব বেশি না হলেও বিএনপির অনেক নেতাকর্মীদের মন-মননে ইসলাম এবং ইসলামী মূল্যবোধের দিকে কিছুটা হলেও অনুরক্ত করতে পেরেছে বৈকি।
এখন তাদের সম্পর্কের দুর্বলতার সুযোগে বামদের প্রেতাত্মা তাদের ওপর ভর করার সুযোগ পেয়েছে। কিংবা বলা যায় বামদের এটা সহ্য হয়নি বিধায় তাদের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির কাজ করেছে, করে যাচ্ছে। আর এই ভাঙ্গনের পথ ধরে তারা বিএনপিকেও জয় বাংলা করে দেওয়ার পথে হাঁটছে।
~রেদওয়ান রাওয়াহা
t.me/RedwanRawaha
Comments
Post a Comment