পুরুষ : নারীর প্রতিপক্ষ নয়— রক্ষক
ঢাকায় পাবলিক বাসগুলোর যে ভয়াবহ অবস্থা, পাশাপাশি যে পরিমাণ গরম পড়ে, এতে করে বিগত কয়েক বছর ধরে বাসে চড়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছি। কষ্ট হলেও রিক্সা অথবা মোটরসাইকেলে চড়ি। এতে হাতখরচসহ আনুসাঙ্গিক খরচ মেটাতে পরবর্তীতে মাঝেমধ্যে হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। হলেও আমি সেটাকে আমলে না নিয়েই তা করি।
রিক্সায় চড়ার অনেক সুবিধা আছে। এরমধ্যে একটা হলো রিক্সাওয়ালা মামাদের সাথে গল্প করা যায়। তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কাহিনি শোনা যায়। পরিবেশ ভালো থাকলে প্রকৃতিকেও দারুণভাবে উপভোগ করা যায়। বাসে এটা যায় না। গেলেও রিক্সার মতো না।
গত মাসে একটা প্রোগ্রামে যাত্রাবাড়ি থেকে মিরপুর যাওয়ার জন্য বাসে উঠলাম। বাসের প্রায় সামনের দিকের সিট পেয়ে সেখানেই বসলাম।
আমি মূলত বাসে বসলে জানালার পাশেই বসি। জানালার পাশে বসতে আমার সব সময়ই ভালো লাগে। যদিও জানালার পাশে বসার রিস্ক আছে। রিস্ক বলতে ভালো রকমেরই রিস্ক। তবু্ও বসি। যেখানে রিস্ক বেশি, সেখানে সুবিধাও বেশি। সেদিনও আমি বসছি জানালার পাশে। আমার পাশেই আরেকজন ভাই বসছেন। দেখে মনে হলো আমার চেয়ে তুলনামূলক জুনিয়রই হবেন।
আমি এমনিতেই সুযোগ পেলে মানুষের সাথে গল্পের ঝাপি খুলে বসি। যদি মানুষটিকে মনের মতো মনে হয় বা আলাদা করে ভালো লাগে, তাহলে সেটা আরো বেশিই করি। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হলো না। তার সাথেও অল্পস্বল্প গল্প হলো। ছেলেটাকেও ভালোই মনে হলো।
আমরা কদ্দূর যেতেই বাসে দুজন মেয়ে উঠলো। বয়স বেশি না। তরুণীই। বোরকা-টোরকা না পরলেও শালিন পোশাকই পরছে তারা। বাসে সিট নেই। মহিলাদের জন্য বরাদ্দকৃত সিটগুলোও বুকিং।
সিট না থাকায় দাঁড়িয়ে আছে তারা। মানুষের আসা-যাওয়ার ঠেলাঠেলিতে আমি ছেলে হিসেবেও বিরক্ত ও বিব্রতবোধ করি। সেখানে এমন ভিড়ে দুজন যুবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রটা দেখেই খারাপ লাগছে। পাশের ভাইটিকে বললাম— চলুন, ওদেরকে সিটগুলো দিই। ওরা বসুক। আমরা আপাতত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যাই।
সে আমাকে জবাব দিলো, কেন আপনি দাঁড়িয়ে যাবেন? আমি বললাম আমরা ছেলে। যুবক মানুষ। মোটামুটি কিছু সময় দাঁড়িয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রাখি। ওরা তো মেয়ে। এই পরিবেশে এতক্ষণ এমন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ওদের জন্য শোভনীয় না।
আমার কথার পিঠে সে জবাব দিলো, নারী-পুরুষ ভেদাভেদ করছেন কেন? তারাও মানুষ। আপনিও মানুষ। তাছাড়া তারা তো আর বৃদ্ধা নয় যে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে না। আপনি তাদেরকে সম্মান করে, তাদের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিট দিতে চাচ্ছেন। তারাও কি সুযোগ পেলে আপনাকে মানে ছেলেদেরকে সম্মান প্রদর্শন করে? সেদিন দেখলেন না, কিছু মেয়ে কয়েকজন ছেলেকে ট্রেনে নারীদের ভগীতে ভুলক্রমে উঠে যাওয়ায় কী অপমান করেছে? তাদেরকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নামতে পর্যন্ত দেয়নি!
যেখানে মেয়েরা পুরুষদের সম্মান দিতে পারে না, সেখানে আগ বাড়িয়ে তাদের কাছে এত ভালো সাজার তো কোনো মানেই হয় না। আপনি উঠলে উঠেন। আমি আমার জায়গায়ই বসে যাবো।
তারা যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়। একই কষ্ট আমারও হয়। তারা যেমন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ, আমিও তেমন রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তাছাড়া আজকালকার মেয়েরা তো দাবি করে নারী-পুরুষ সমান। সমান হলে আমি কষ্ট করে তাকে বাড়তি সুবিধা দেব কেন?
আমি প্রথমে ভাবছিলাম সে দুষ্টুমিচ্ছলে এসব বলছে। পরে তার এটিচিউড দেখে নিশ্চিত হলাম যে, আসলে দুষ্টুমি না। সে সিরিয়াসলিই বলেছে ও নিয়েছে বিষয়টা। আমি জানি না, মেয়েগুলো গাড়ির ফ্যা-ফো আওয়াজের মধ্যে কথাগুলো শুনছে কিনা। শুনলে ভেতর ভেতর তাদের প্রতিক্রিয়াও-বা কেমন হতো, তা-ও জানি না।
যাহোক, এরপর তখন আমি তাকে বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলাম না। কেবল বললাম— সব মেয়ে তো সমান না। সমান চিন্তাধারার অধিকারী না। এরা ভালোও হতো পারে। আপনি না উঠলে সরুন, আমি উঠছি।
আমি ওঠার ২০/৩০ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে সেও অনুগত ও বাধ্য ছেলের মতো আমাকে অনুসরণ করে উঠে গেল। তখন একহাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোকে ডেকে এনে বসতে দিলাম। তারা বসেছেও।
এই ঘটনা খুব বেশি দিন আগের না। আবার অনেক পুরনোও না। এক-দেড় মাস আগের হবে। সেদিনের পরে আমার ভেতর নতুন করে একটা বোধের জন্ম হলো। বাংলাদেশসহ বিশ্বে যেভাবে নারীবাদ ছড়িয়েছে, তার বিপরীতে পুরুষবাদও ছড়িয়েছে। নারীর প্রতি জুলুম, অবিচার ও অন্যায় নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু পুরুষের প্রতি অবিচার ও অন্যায় নিয়ে খুব বেশি কথা হয়নি।
যার ফলে সমাজের একটা অংশ এসবের প্রতিক্রিয়ায় পুরুষবাদী হয়ে গেছে। নারীবাদীরা যেভাবে পুরুষকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিয়েছে, ভেতর ভেতর বহু ছেলে বা পুরুষও নিজেকে নারীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবা শুরু করছে। নিজেকে নারীর সমান ও প্রতিপক্ষ হিসেবে নিয়েছে।
অথচ পুরুষ কখনোই নারীর প্রতিযোগী না। প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। পুরুষের প্রধান ভূমিকাই হচ্ছে সে কওয়াম। কর্তৃত্বশীল। (পুরুষ নারীর কর্তা। এ জন্য যে, আল্লাহ তাদের একজনকে অন্য জনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সূরা নিসা:৩৪)।
নারীবাদ যেভাবে প্রচার করছে কামাই থাকলে জামাই লাগে না, তদ্রূপ এই পুরুষবাদীরাও বলা শুরু করেছে আমার কামাই অন্যের জন্য না, কিংবা আমি নারীর জন্য খরচ করবো না, অথবা তাদের জন্য খরচ করতে বাধ্য না।
তারা বলছে নারী পুরুষের মতোই শক্তিশালী। নারী-পুরুষে কোনো পার্থক্য নেই। এর প্রতিক্রিয়ায় এরাও বলা শুরু করছে— পার্থক্যই যেহেতু নেই, তাহলে তোমাকে আমার পক্ষ থেকে যে সিকিউরিটি, যে প্রটেক্টশন, যে এডভান্টেজ দেওয়ার কথা, সেগুলোও আমি আগ বাড়িয়ে দিতে যাবো কেন? দেব না। চাকরির ক্ষেত্রে নারীর জন্য আলাদা কোটা না৷ পরিবহনে আলাদা সিট না। রেস্টুরেন্টে আলাদা জায়গা না।
অথচ দেখুন, নারীবাদের বিরুদ্ধে এমন এপ্রোচ সমগ্র নারীর জন্য গ্রহণ করা কখনোই পুরুষালি বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। ফেসবুকে একটা গ্রুপ আছে। সেখানে আলফা মেইল না কী যেন বানানোর কথা বলা হয় ছেলেদেরকে। সে গ্রুপটিতে প্রায়শই নারীদের প্রতি অবমাননাকর নানাধরনের কমেন্ট আসে। পোস্ট আসে। লেখাজোখা আসে।
অথচ পুরুষ হচ্ছে নারীর রক্ষক। তার কাজ নারীকে প্রটেক্ট করা। নিরাপত্তা দেওয়া। ঘরে-বাইরে অনিরাপদ, ঝুঁকিপূর্ণ, দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে তার শক্তিশালী মাংশল পেশী দ্বারা তাকে আগলে রাখা। তার জন্য নিরাপদ একটা পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। অপরদিকে নারীর কাজ হচ্ছে নিজের সতীত্ব ও পবিত্রতা রক্ষা করে অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে শান্তিময় করে তোলা।
এটা ঠিক, সমাজ-সভ্যতায় ফেমিনিজমের প্রভাবে পুরুষ বিদ্বেষ খুব ভালোই চর্চা হয়। আমাদের নারীরাও তাদের আদি ও আসল ভূমিকা ভুলে গিয়েছে বা ভুলতে বসেছে। পশ্চিমা নষ্ট সভ্যতার ফাঁন্দে পড়ে চিরাচরিত জেন্ডার রোল অস্বীকার করছে বহু সংখ্যক নারী।
কিন্তু তাই বলে কি নারী বিদ্বেষ, নারীকেও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গ্রহণ করা, প্রতিযোগী হিসেবে নেওয়া সঠিক কাজ হবে?
দীন-ধর্ম, পরিবেশ-প্রকৃতি, বায়োলজি ও সাইকোলজি— কোনোদিকেই নারী পুরুষের সমান না। নারী পুরুষের সমতা কখনোই ইনসাফ না। কোনোদিক দিয়েই পুরুষ নারীকে প্রতিযোগী ও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে পারে না।
এটা যে করবে, সে ব্যক্তি নিজেও অজান্তেই আরেকটা ফিতনা— পুরুষবাদের ফাঁদে পা দেবে। যেটা সভ্যতার আরো সর্বনাশ করবে। আরো বেশি করে জেন্ডার স্ট্রেস তৈরি করবে।
পুরুষ নিজের পুরুষালি বৈশিষ্ট্য ভুলে গিয়ে নিজেকে নারীর সমান ভাবলে, মেইল হয়েও নিজেকে ফিমেইলের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা শুরু করলে নারীবাদ কিংবা পুরুষ বিদ্বেষের সমাধান হবে না।
আবার নারী হিসেবে একজন নারী তার নারী-সূলভ বৈশিষ্ট্য ভুলে গিয়ে পুরুষকে প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেমিনিজম বা পুরুষ বিদ্বেষ চর্চা করেও নারীর প্রতি হওয়া অন্যায়ের সমাধান হবে না। অনুসরণ করতে হবে ট্র্যাডিশনাল জেন্ডার রোল। অনুসরণ করতে হবে দীন-ধর্ম, এক স্রষ্টার দেওয়া বিধান। তা না করলে এক সময় শরিফ নিজেকে শরিফা, আবার শরিফা নিজেকে শরিফ দাবি করে বসে থাকবে। এতে পাশ্চাত্যের অসাধু পুজিবাদীদেরই লাভ। সভ্যতার কোনো লাভ নেই। লাভ হলো নারীকে প্রতিযোগী-প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষ না ভেবে পুরুষালি বৈশিষ্ট্য ধারণ করায়।
আর পুরুষালি বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে— পুরুষ নারীর রক্ষাকবচ। নারীকে প্রটেক্টকারী। শুধু নারীরই না। পুরুষ পুরো সভ্যতারই রক্ষাকারী। পুরুষের কাজ হচ্ছে সভ্যতার রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করা। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ-আপদের মোকাবিলা করা। যু দ্ধ-বিগ্রহ, ব্যবসা-বাণিজ্য, নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব পরিচালনা করা। অন্যদিকে নারী মূলত সভ্যতার এইসব সৈনিকদের (মানুষ) তৈরির কারিগর।
ফেমিনিজম মোকাবিলার কথা বলে ছোটো খাটো বিষয় নিয়ে নারীর সঙ্গে ঘ্যানর ঘ্যানর, ফ্যানর ফ্যানর করা একজন আলফা মেইলের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
আসুন ভায়েরা, পুরুষবাদী না হয়ে সত্যিকারেরই পুরুষ হই।
~রেদওয়ান রাওয়াহা
২৬/০৬/২৪
Comments
Post a Comment