গণতন্ত্র : কিছু কথা কিছু প্রশ্ন
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ইসলাম-সম্মত না, এর মাধ্যমে দ্বীন বিজয় হবে না। ইসলামের সাথে বর্তমান লিবারেল ডেমোক্রেসির আসমান-জমিন পার্থক্য আছে। গণতন্ত্রের ধোঁয়া তুলেই তো উসমানি খিলাফাহ ধ্বংস করা হয়েছে। গণতন্ত্র দিয়ে শরীয়াহ কায়েম হয়েছে—পৃথিবীতে এমন নজির কেউ স্থাপন করতে পারেনি।
এই যে কথাগুলো, এগুলো আমরা হরহামেশাই শুনতে পাই। এবং এ কথাগুলোর সবটাই প্রত্যাখ্যান করার মতো না, অসত্য না, অসমর্থন করার মতোও না।
কিন্তু এখন এসব কথাবার্তার পরেও কিছু কথা থাকে। কিছু আলোচনা বাকী থাকে। কিছু কর্মসূচির প্রয়োজন থাকে।
সেটা হচ্ছে, এখন তাহলে বাংলাদেশের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী— আলিম-ওলামা এবং ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয় কী?
গণতন্ত্র ইসলামী পদ্ধতি না, এটাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মেনে নিলেও এখন আমাদের করণীয় কী? জিহাদ?
যারা এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার, তারাও বলেন— এখন জিহাদের সময় না, দাওয়াতের সময়। বা এভাবেও বলেন— এটা জিহাদের ভূমি না, দাওয়াতের ভূমি।
তাহলে ওনাদের বক্তব্যের আলোকেই বোঝা গেলো যে, ওনারা জিহাদকে আপাতত প্রধান অবলম্বন করতে চাচ্ছেন না। তাহলে চাচ্ছেন কী? উত্তরে আসে—দাওয়াত।
ঠিক আছে, আমরা দাওয়াতী কাজ করে যাবো। মুসলমানদের ঈমান-আখলাক, আমল-আকিদা, ইলম ও আচরণ ঠিক করার পেছনে শ্রম ও সময় দেব। কিন্তু আমাদের বর্জন, নিষ্ক্রিয়তা কিংবা দাওয়াতি মেহনতের দিকে চেয়ে কি নির্বাচন বন্ধ হবে? রাষ্ট্র কি থেমে থাকবে?। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে (যেভাবে আর যেরকমই হোক) ক্ষমতার প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে যাবে?
না, সবই হবে। রাষ্ট্র-নির্বাচন ও ক্ষমতার লড়াই— সবকিছুই চলবে। সে প্রতিযোগিতায় কেউ না কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করবেন। ক্ষমতার লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ করে পার্লামেন্টে গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার অংশও হবেন কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখবেন।
তো এই যে ক্ষমতার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা, এই যে পার্লামেন্টে গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখা— সেখানে তাহলে মুসলমানদের ভূমিকা কী হবে? ইসলামের পক্ষের শক্তিগুলো কী করবে? তারা নিজেদেরকে সে লড়াই থেকে দূরে সরিয়ে রেখে রাষ্ট্র-ক্ষমতাকে কি সম্পূর্ণভাবে সেকুলার-লিবারেলদের হাতে অর্পণ করে বসে থাকবে?
ইসলামের পক্ষের শক্তিগুলো যদি নিজেদেরকে সে লড়াই থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, তবে কি সেকুলার-লিবারেলদের একচেটিয়া শাসন ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য মঙ্গলজনক হবে?
নাকি মুসলমানদের উচিৎ হবে, অধিকতর ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠীগুলোকে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করার জন্যই নিজেদের জায়গা থেকে জিহাদের উপযুক্ত সময়-পরিবেশ বা শক্তি অর্জনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার অধীনে সেক্যুলারদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের ইসলামী মূল্যবোধগুলোর হেফাজত এবং ইসলামের প্রাথমিক অধিকারগুলো আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা? দেশ পরিচালনায় বা বিভিন্ন সেক্টরের নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণ করা— যাতে ইসলামী মূল্যবোধ-বিরোধী বিষয়গুলো কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা যায়?
কোনটা বেশি কল্যাণকর? কেবলই দাওয়াতি মেহনতে সময় দিয়ে নির্বাচন, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে বাম এবং এক্সট্রিম লিবারেল-সেকুলারদেরকে নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করতে দিয়ে তাদের দ্বারা রাষ্ট্র ও সমাজের ডি-ইসলামাইজেশনকে মুখ বুজে মেনে নেওয়া?
আমাদের কিছু কিছু দ্বীনি ভাইয়েরা কি ব্যাপারগুলো নিয়ে চিন্তা করেন না?
আপনারাই যেহেতু বলেন— এখন খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। শরীয়াহ কায়েম এই মুহূর্তে অসম্ভব। জিহাদও যেহেতু সম্ভব নয়, তাহলে আপনাদের মূলত চাওয়া ও করণীয়টা কী?
আমার কথা হলো, কেউ যদি কেবলই তাদের দাওয়াতি সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে চায়, রাখুক। কিন্তু অন্যান্য ইসলামের পক্ষের শক্তিগুলো যদি সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলামকে শক্তিশালী করতে নিজেদের ক্ষুদ্র সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা প্রয়োগ করতে আগ্রহী হয় এবং চেষ্টা করে, তবে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা কিংবা অনভিপ্রেত সমালোচনা করে দমিয়ে দেওয়ার চিন্তা করা উচিৎ না। এটি কল্যাণকরও নয়।
পাশাপাশি প্রচলিত গণতান্ত্রিক কাঠামোকে মেনে নিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারে ভূমিকা পালন করতে চাওয়া লোকদেরও উচিৎ না স্রেফ দাওয়াতি কাজ অব্যাহত রাখতে চায় যারা— যেমন তাবলিগ বা আহলে হাদিসের একটা অংশ কিংবা অন্য আরো যেসব গ্রুপ আছে— তাদের সাথে অযথা এবং অপ্রয়োজনীয় খোঁচাখুঁচি করা। এই কাজটা আমাদেরকে অনেক কষ্ট দেয়।
এটা যে শুধু আমাদেরকেই কষ্ট দেয়, তা না। বরং এটা মুসলমানদের ইমেইজকেও খারাপ করে, মুমিনদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি হয়।
আমরা যারা অফলাইনে, সাংগঠনিক পদ্ধতিতে কিংবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করি, আমাদেরকে এসবের জন্য মাঝেমধ্যে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
মুসলমানদের উচিৎ না অন্য মুসলিমকে দুশমন বানানো। আমাদের উচিৎ একে অন্যের সহযোগী হওয়া। নিজ নিজ জায়গা থেকে দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহ'র জন্য কাজ করা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদেরকে কবুল করুন।
~রেদওয়ান রাওয়াহা
Comments
Post a Comment