গণতন্ত্র, শত্রুতা ও পারস্পরিক বিরোধিতা

 

০১.

গণতন্ত্রের ওপর পবিত্রতা আরোপ করা, এর সমালোচনাকে সহ্য করতে না পারা, অথবা গণতন্ত্রের সমালোচনা করলে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু বললে নিজেদের গায়ে নিয়ে আসা— এগুলো তীব্রতর প্রবলেমেটিক।


 আবার অন্যদিকে কেউ কেউ গণতন্ত্রের কথা আসলেই আব্রাহাম লিংকনের উদাহরণ টেনে আনেন, গণতন্ত্রের পক্ষের লোকদেরকে আব্রাহাম লিংকনের উম্মত সাব্যস্ত করেন। এটাও ঠিক না, অনুচিত। এগুলোও চরম মাত্রার ফালতু এবং পাতলা কথা। স্বয়ং ঈসা আ. এর জন্মেরও বহু পূর্ব থেকে গণতন্ত্র এই দুনিয়ায় এক্সিস্ট করতো। হাজার হাজার বছর পুরনো তন্ত্র হচ্ছে এই গণতন্ত্র। 


গণতন্ত্র নিয়ে বিখ্যাত বহু দার্শনিকও অনেক অনেক নেতিবাচক কথা বলেছেন। অনেক সমালোচনা করেছেন। যেমন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটো; এই এঁরাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন।


 ০২. 

সক্রেটিস গণতন্ত্রের একটি ত্রুটি উল্লেখ করেছিলেন এক উদাহরণের মাধ্যমে। তিনি বলেছিলেন, যদি কোনো দেশে দুজন প্রার্থী থাকে— একজন মিষ্টির দোকানদার, অন্যজন ডাক্তার— তাহলে কী হবে? মিষ্টির দোকানদার মানুষকে এই বলে নিজের দিকে কনভিন্স করার চেষ্টা করবেন, ‘ডাক্তার মানুষকে তিতা ওষুধ খাওয়ায়, আর আমি তোমাদের মিষ্টি খাওয়াব।’ এর ফলে ভোটারদের যদি যথাযথ জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা না থাকে, তারা মিষ্টির দোকানদারকেই ভোট দেবে। কারণ, মানুষের সহজাত প্রবণতা হলো আনন্দের পথে ঝোঁকা। 


তিনি বলেছিলেন, এটাই গণতন্ত্রের বিপদ— যদি জনগণ শিক্ষিত না হয়, তাহলে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হবে। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটোও গণতন্ত্র পছন্দ করতেন না। তাঁর বিখ্যাত উক্তি— গণতন্ত্র হলো নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা। যে ব্যবস্থার মাধ্যমে মন্দ ও অযোগ্য লোকেরা অনায়াসেই জাতির ঘাড়ে চেপে বসে, উত্তম ও যোগ্য লোকদের শাসনের সুযোগ পায়। 


অ্যারিস্টটলও গণতন্ত্রকে দরিদ্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন বলেই অভিহিত করেছিলেন। তাঁর মতে, যখন এই শ্রেণি ক্ষমতায় আসে, তখন তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে যায় নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করা, জাতির কল্যাণ নয়।


 তবে কথা হলো এই যে, বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পছন্দ করেন। আজকের যুগে গণতন্ত্র নামক পরিভাষা ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা খুবই জনপ্রিয় একটা ব্যবস্থা। কিন্তু কোনো কিছু জনপ্রিয় হওয়া মানেই যে নির্ভুল, এমনটা তো ভাবার কোনো ধরনের অবকাশ নেই।


 ০৩.

গণতন্ত্রের সাফল্য নিয়ে সক্রেটিস বলেছিলেন— এর সফলতা তখনই আসবে, যখন জনগণ শিক্ষিত ও সচেতন হবে। যদি তারা নিজেদের এবং রাষ্ট্রের কল্যাণ নিয়ে সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে না পারে, তবে গণতন্ত্র থেকে প্রকৃত সুফল পাওয়া সম্ভব নয়।


 সক্রেটিসের এই কথাকে সামনে রেখেই আমি বলতে চাই যে, আপনি যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মেনে নিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিই করতে চান, তাহলে আপনাকে আগে আপনার আইডিওলজির ওপর জনগণকে প্রশিক্ষিত করতে হবে বা জনগণের মানসিকতাকে সেরকমভাবেই গঠন করতে হবে। তাহলে হয়তো আপনি ক্ষমতায় এসে আপনার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করলেও করতে পারবেন।


 তবে এখানেও কথা থাকে, আপনি তো ক্ষমতায় আসবেন চার-পাচ বছরের জন্য। কিন্তু পরবর্তী মেয়াদে আপনার বিরোধী আদর্শের কেউ ক্ষমতা এলে তো আপনার আদর্শকে অক্ষুণ্ণ রাখবে না। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মেনেই সে বা তার আদর্শ বিজয়ী হয়েছে বা ক্ষমতায় এসেছে। সে তো তখন তার আদর্শকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাবে, আপনার-আমার আদর্শ না।


০৪.

গণতন্ত্রের আরেকটা দুর্বলতা হলো গণতন্ত্র আপনাকে পারস্পরিক শত্রুতা, বিরোধ, প্রতিহিংসায় উস্কানি দেবে। অজান্তেই আপনার মনে অযথা অহমিকা ও বিদ্বেষ আমদানি করবে। অন্তত আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে এটাই হচ্ছে এবং হবে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। 


গণতন্ত্রের টার্গেটই হচ্ছে অন্যকে পচিয়ে, অপমান করে, অন্যকে ছোটো করে, হেয় করে নিজের অর্জনকে বড়ো করে দেখানো বা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। গণতন্ত্রের মানেই হলো— যেকোনো মূল্যে অন্যের তুলনায় আমি ও আমার দলকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে হবে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে অন্যের ভুলগুলোকেই কেবল মানুষের সামনে তুলে আনতে হবে।


যেমন, গতপরশু ছাত্রদলের সভাপতি শিবিরের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ তুলে কঠিন একটা বক্তব্য দিয়েছে। এতে শিবিরের বহু ভাইদের মনে কষ্ট লেগেছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মনঃকষ্টের কারণ কী? মনঃকষ্টের তো কিছু নেই। ছাত্রদলকে কি প্রমাণ করতে হবে না যে, তারা শিবিরের চেয়েও শ্রেষ্ঠ?


 ছাত্রদল যদি শিবিরের সমালোচনা না করে প্রশংসাই করে, শিবিরের দোষ মানুষের সামনে তুলে না ধরে, তাহলে মানুষ ছাত্রদল করবে কেন? তাদেরও তো প্রমাণ করতে হবে যে, দ্যাখো, আমরাই কেবল দোষ করি না, শিবিরও দোষ করে। তার তো উদ্দেশ্য হচ্ছে এখন ছাত্রলীগ পরবর্তী শত্রুর—শত্রু, প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিযোগী, যা-ই বলি— সাথে ফাইট করা।


০৫.

 এখন বা এ সময়ে শিবিরই যেহেতু ছাত্রদলের সবচেয়ে বড়ো বা প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা প্রতিযোগী, সে তো শিবিরেরই বিরুদ্ধেই বলবে। এজন্যই বলবে, যেন ছাত্ররা শিবিরের দিকে না ঝুঁকে তাদের দিকেই ঝুঁকে। 


তবে, ছাত্রদল যদি তার শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বীকে সাথে যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে না পারে কিংবা না করে স্রেফ কিছু গৎবাঁধা কথা বলে বা কিছু বায়বীয় অভিযোগ সামনে আনে, তাহলে লড়াইয়ের ময়দানে সে স্বাভাবিকভাবেই তার জনসমর্থন হারাবে। মানুষ যাদের কথা এবং আচরণ বেশি সুন্দর পাবে, ভুল কথাবার্তাকেও যে বা যারা রঙচঙ মাখিয়ে মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারবে, তারাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এগিয়ে যাবে। 


কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেউ যদি হাসান মাহমুদ কিংবা ওবায়দুল কাদের স্টাইলে লড়াই করে, কিংবা লড়াই করতে করতে করতে আপনি ওবায়দুল কাদের অথবা সাদ্দাম হয়ে যান, তাহলে আপনি অটোমেটিকই পরাজয় বরণ করবেন। হয়ে পড়বেন পরাজিত। 


তবে দিন শেষে এইটুকু সবার মাথায়ই রাখা উচিৎ— আপনি গণতন্ত্র করবেন, আবার চাবেন কেউ আপনার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ না করুক বা কেউ আপনার বিরুদ্ধে কিছু না বলুক কিংবা একেবারে কেউই কারো বিরুদ্ধে না বলুক; এটা তো সঠিক চাওয়া হলো না। এই চাওয়াটাই হলো অগণতান্ত্রিক চাওয়া। 


[গণতন্ত্র নিয়ে আমার এই লেখাটাও পড়ে দেখতে পারেন: https://aamarangina.blogspot.com/2024/09/blog-post.html?m=1। ]

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ