⚪ সম্পাদনার ষোল কিসিম ⚪
নিজের লেখা নিজেই সম্পাদনা করতে হলে কিছু নির্দিষ্ট ধাপ ও কৌশল অনুসরণ করতে হয়, যা লেখার গুণগত মান বাড়াতে সাহায্য করে। নিচে প্রতিটি ধাপ বিস্তারিতভাবে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করা হলো:
১. লেখার মূল বক্তব্য নির্ধারণ
প্রথমেই নিজের লেখা পড়তে হবে এবং চিন্তা করতে হবে, লেখা কি ঠিক সেই বক্তব্যটি দিচ্ছে, যা আপনি পাঠককে বোঝাতে চাচ্ছেন? যদি মূল বক্তব্যটি স্পষ্ট না হয়, তাহলে লেখাটি সম্পাদনা করতে হবে।
উদাহরণ:
লেখার প্রথম খণ্ডে আপনি বলতে চাচ্ছেন, প্রকৃতি শান্তির প্রতীক। কিন্তু যদি ভাষা এত জটিল হয়ে যায় যে পাঠক বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তাহলে সেই অংশকে পুনর্লিখন করতে হবে।
ভুল: "প্রকৃতি যেন তার আপন সৌন্দর্যের ভাঁজে মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, যা তাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছায়।"
সঠিক: "প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের মাধ্যমে মানুষকে শান্তি ও নির্ভারতা দেয়।"
২. ভূমিকা পরিষ্কার রাখা
প্রথম অনুচ্ছেদে লেখার উদ্দেশ্য এবং মূল চিন্তাধারা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে কি-না, তা নিশ্চিত করুন।
উদাহরণ:
যদি আপনার গল্প বেদনাবিধুর হয়, তাহলে প্রথমেই সেটির ইঙ্গিত দেওয়া দরকার।
৩. শিরোনামের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা
শিরোনাম লেখার বিষয়বস্তু পুরোপুরি প্রকাশ করছে কি না তা দেখুন।
উদাহরণ:
ভুল শিরোনাম: "সন্ধ্যার সময়"
সঠিক শিরোনাম: "এক গোধূলির গল্প"
৪. অপ্রয়োজনীয় তথ্য বাদ দেওয়া
লেখায় অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় তথ্য ঢুকে যায়, যা মূল বক্তব্যকে দুর্বল করে দেয়। এসব অপ্রয়োজনীয় বাক্য, শব্দ বা তথ্য বাদ দিতে হবে।
উদাহরণ:
ভুল: "আমি বাসায় ফিরে এসে চায়ের কাপ নিয়ে বসেছিলাম, চায়ের মধ্যে চিনি না দিয়েই আমি তা খেতে শুরু করলাম। আমার পছন্দের বই পড়া শুরু করলাম।"
সঠিক: "আমি বাসায় ফিরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বই পড়তে বসলাম।"
৫. শব্দচয়ন যথাযথ রাখা
শব্দগুলো যেন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় তা নিশ্চিত করুন।
উদাহরণ:
ভুল: "সে খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছে।"
সঠিক: "সে তীব্র গতিতে দৌড়াচ্ছে।"
৬. পুনরাবৃত্তি এড়ানো
একই ধরনের বাক্য বা তথ্য বারবার উল্লেখ না করার চেষ্টা করতে হবে।
উদাহরণ:
ভুল: "রাতে অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল।"
সঠিক: "রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল।"
৭. লেখার টোন মিলিয়ে রাখা
লেখার টোন পুরো লেখাজুড়ে সমান থাকা উচিত। মাঝে মাঝে টোন পরিবর্তন হলে পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারে।
উদাহরণ:
যদি লেখার শুরুতে আপনি একটি সৌম্য এবং শান্ত টোন ব্যবহার করেন, তবে শেষ পর্যন্ত সেই টোন বজায় রাখতে হবে। হঠাৎ করে যদি টোন আক্রমণাত্মক হয়ে যায়, তবে তা অস্বস্তিকর হতে পারে।
৮. বাক্যের সংযোগ বজায় রাখা
প্রতিটি বাক্য এবং অনুচ্ছেদের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রেখে লিখতে হবে। যেন এক বাক্য থেকে পরবর্তী বাক্যে যাওয়ার সময় পাঠক কোন অসঙ্গতি অনুভব না করে।
উদাহরণ:
প্রথম বাক্যে যদি বলা হয়, "রাতের আকাশে চাঁদ ছিল," পরবর্তী বাক্যে হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তনের বিষয় উল্লেখ না করা যায়: "হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো।"
৯. সঠিক শব্দবন্ধ নির্বাচন করা
শব্দগুলো যেন উপযুক্ত শব্দবন্ধ হিসেবে একে অপরের সাথে মিলিয়ে ব্যবহার করা হয়।
উদাহরণ:
ভুল: "সে কঠিন পরিশ্রম করছে।"
সঠিক: "সে কঠোর পরিশ্রম করছে।"
১০. প্রচলিত ভুল এড়িয়ে চলুন
সাধারণ ভাষাগত ভুলগুলো এড়িয়ে চলুন।
উদাহরণ:
ভুল: " তুমি সেই গোলবৃত্তটির মতোন",
সঠিক: "তুমি সেই বৃত্তটির মতোন"
এখানে বৃত্ত মানেই গোল, আলাদাভাবে গোল লেখার প্রয়োজন নেই।
১১. বানান ও ব্যাকরণের দিকে নজর রাখা
লেখায় বানান এবং ব্যাকরণের ভুল থাকলে পাঠকের চোখে লেখার মান কমে যায়। প্রতিটি বাক্য ঠিক আছে কি না খতিয়ে দেখতে হবে।
উদাহরণ:
ভুল: "সে খুবি ভালো মানুষ।"
সঠিক: "সে খুবই ভালো মানুষ।"
১২. প্রমিত বাংলা বানান ব্যবহার করা
বানানের নির্ভুলতা বজায় রাখতে বাংলা একাডেমির প্রমিত বানান ব্যবহার করুন।
উদাহরণ:
"বড়ো" শব্দটির সঠিক বানান হবে "বড়"।
১৩. যথাযথ যতিচিহ্নের ব্যবহার নিশ্চিত করা
যতিচিহ্নের সঠিক প্রয়োগ লেখার অর্থ পরিষ্কার করে তোলে।
উদাহরণ:
ভুল: "হ্যাঁ বলো।" ( উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে বলতে বলা হচ্ছে; কিন্তু যতিচিহ্নের প্রয়োগ না থাকায় মনে হচ্ছে না এর বিপরীত "হ্যাঁ" বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে)
সঠিক: " হ্যাঁ, বলো।" ( এখানে কমা দেওয়ার ফলে কিছু বলতে নির্দেশ করা হচ্ছে, এমনটিই বোঝা যায় )
১৪. প্রমাণ নির্ভুল কি-না, তা যাচাই করা
যেকোনো তথ্য বা উদ্ধৃতি সঠিক কিনা তা যাচাই করুন।
উদাহরণ:
ইতিহাসভিত্তিক লেখা হলে সঠিক তারিখ এবং ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে হবে।
১৫. বিরতি দিয়ে আবার পড়া
লেখা সম্পাদনা করতে গেলে একবার লেখার পর কিছু সময় বিরতি নিন। এরপর আবার নতুন চোখে লেখাটি পড়ুন, পর্যালোচনা করুন । এতে ভুল বা অসঙ্গতি ধরতে সহজ হবে।
১৬. কাউকে পড়ে শোনানো বা উচ্চস্বরে পড়া
লেখাটি কারো সামনে পড়ে শোনালে বা নিজেই উচ্চস্বরে পড়লে কোথায় সমস্যা হচ্ছে তা বুঝতে পারবেন। এটি অত্যন্ত কার্যকরী কৌশল। লেখা শ্রুতিমধুর হলে সেটি আরও মনোগ্রাহী হবে।
এই ধাপগুলো অনুসরণ করলে আপনি নিজের লেখার ভুলগুলো সহজে ধরতে পারবেন এবং গুণগত মান আরও উন্নত করতে পারবেন। ইন শা আল্লাহ।
দ্র. এ বিষয়গুলো নিজের লেখা সংশোধনের জন্য অধিক কার্যকর। অন্যের লেখা সম্পাদনার জন্য আরও কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা প্রয়োজন, রচনা দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার ভয়ে বিষয়গুলো অনুল্লেখ রাখা হলো।
• এনায়েতুল্লাহ সালীম
• নয়। দশ। চব্বিশ।
Comments
Post a Comment