জোব্বা-টুপি-পাগড়ি কি ইসলামী পোশাক?




পাঠকপ্রিয় লেখক ডাক্তার সামছুল আরেফিন তার “পোশাক ও আত্মপরিচয়ের সুই-সুতো” নামক প্রবন্ধে মুহাম্মদ আসাদের রেফারেন্সে এরকম একটা কথা বলেছেন যে, পোশাকেরও দর্শন আছে। পোশাকও কিছু কথা বলে।

তার এই কথার সাথে আমি সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় শতভাগ একমত। কারণ এটা সত্যিই যে, পোশাকও কিছু আদর্শ এবং চিন্তা চেতনা হাজির করে। পোশাকও নির্দ্বিধায় অনেক কিছুই বলে দেয়।

পোশাক কেবলই নীরিহ কিছু কাপড়-টুকরোর সেলাইয়ের সম্মিলন নয়। সব ধরনের পোশাকই, সব সময়ই কিছু কথা বলতে চায়। কিছু মূল্যবোধ হাজির করে এবং করতে চায়।

পরাজিতরা বিজয়ীদের সবকিছুতেই মুগ্ধ হয়। আকৃষ্ট হয়।পোশাকেও হয়৷ তাদের পোশাক, পলিসি এবং লাইফস্টাইলও অনুকরণ-অনুসরণ করতে চায়। এমনকী করেও।

তা না হলে এখন গণহারে সবাই যেভাবে একটু টাকা পয়সা হলে বা একটুখানি সেকুলার ধারায় শিক্ষিত হলেই সুটেড-বুটেড হয়ে যায়, সেটা হতো না।

ফতোয়া আর লুঙ্গি ছেড়ে (নারীরা শাড়ি আর সালোয়ার কামিজ ছেড়ে) জিন্স ও টাই-টুই পরে নিজেকে নান্দনিক ও আধুনিক হিসেবে প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যেত না।

পোশাক কথা বলে জন্যই স্বয়ং বাঙালিদের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাঙালি পোশাক হিসেবে পরিচিত লুঙ্গি পরে যাওয়া যায় না। ফতোয়া-লুঙ্গি পরে ক্লাস করা বা লেকচার দেওয়া যায় না। কেউ চাইলেও তাকে গ্রহণ করা হয় না। লুঙ্গি ফতোয়া বাদ দিন, স্বয়ং পাঞ্জাবি জোব্বাকেও কি পজিটিভলি দেখা হয়?

এই তো, কয় বছর আগের কথা। কুয়েটের ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা র‌্যাগডে উপলক্ষ্যে জোব্বা এবং মাথায় পাগড়ি পরিধান করে। এই পোশাক পরে তারা মিছিল করে পরবর্তীতে শহীদ মিনার চত্বরে ফটোসেশন করে।

কুয়েটের ছাত্ররা তাদের বিদায় অনুষ্ঠানে শখ করে জোব্বা পাগড়ি পরে অনুষ্ঠান করেছে, ক্লাস করেছে, ফটোসেশন করেছে বলে কী মহা তোলপাড়ই না করেছে আমাদের সেকুলার প্রগতিশীল গোষ্ঠী! মনে নেই তা?

পোশাক যদি আত্মপরিচয় ফুটিয়েই না তুলতো, পোশাক যদি স্বতন্ত্র পরিচয় হাজিরই না করতো, তাহলে তো এমন হবার কথা ছিল না। ঠিক না?

চিন্তা করেন, সেকুলার প্রগতিশীল গোষ্ঠী কি স্রেফ ভিনদেশী আরবের পোশাক বলেই সেগুলোর প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করেছে? পাগড়ি-জোব্বার প্রতি তাদের উন্মাদনা প্রকাশ ও প্রদর্শন কি কেবল তা আরবের পোশাক বলেই?

যদি বাঙালি পোশাক ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি দরদ থেকেই তারা এসব বলতো ও করতো— তাহলে তো শার্ট-প্যান্ট-টাই, স্যুট-কোট নিয়েও বলতো। কিন্তু কখনো বলেছে কি? খুব বেশি বলেনি। আর বলবেও না।

এই যে আপনি, যেই আপনি ইসলামিস্ট, সেই আপনিও কোনোদিন সেই প্রশ্ন তোলেননি— বাংলাদেশের মানুষ বা বাঙ্গালিদেরকে বাংলাদেশের জমিনে বসেও কেবলই শার্ট-প্যান্ট পরেই কেন অফিস-আদালত করতে হয়? আপনি প্রশ্ন তোলেননি— কেনই-বা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি-ফতোয়াকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কিংবা আনস্মার্ট হিসেবে চিত্রায়ণ করা হয়?

আপনি কেবলই প্রশ্ন তোলেন— জোব্বা-টুপি-পাগড়ি ও দাড়ি নিয়ে! আপনার কেবলই প্রশ্ন— দাড়ি টুপি পাগড়ি জোব্বা কি ইসলামি পোশাক?

এই পোশাক ইসলামি না হোক, অনৈসলামিক তো না। ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তিদের পোশাক তো এটাই ছিল! তাই না?

দেখুন, মুসলিম উম্মাহর দেড় হাজার বছরের সংস্কৃতিতে, বিগত পনেরশত বছরের মুসলিম সভ্যতায়, এই জোব্বা-টুপি-পাগড়ি-দাড়ি ও আলখাল্লা কিন্তু ইসলাম এবং মুসলমানদের নিদর্শন হিসেবেই গ্রহণীয় হয়ে আসছে। কেউ জোব্বা-পাগড়ি-টুপি পরলেই মানুষ সহজে বুঝে যায় যে, লোকটা মুসলিম।

মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অভিজাত ব্যক্তিবর্গরা— যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম-আলিম, সব জামানার সকল শ্রেষ্ঠ ফকিহ-মুহাদ্দিস- মুফাসসির, সবাই এই ধরনের পোশাকই ধারণ করেছে। স্বয়ং রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এটা (জোব্বা সদৃশ লম্বা জামা, পাগড়ি) পরেছেন। আর দাড়ির ক্ষেত্রে স্বয়ং রাসূল সা. নির্দেশনাও দিয়ে বলেছেন দাড়ি লম্বা করতে বিপরীতে মোছ খাটো করতে।

অপরদিকে ইসলামের বিগত ১৪/১৫ শত বছরের ইতিহাসে কোনো মূল্যবান ও মর্যাদাবান ব্যক্তিদের, যেমন— কোনো কালোত্তীর্ণ যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম, কোনো মুফাসসির, কোনো মুহাদ্দিসদের পোশাক কি শার্ট-প্যান্ট-জিন্স-টাই ছিল? দেখাতে পারবেন? যদি থেকেও থাকে, তাদের হার শতকরা কতো ছিল? ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্যদাবান ব্যক্তিরা জোব্বা পাগড়ি টুপি দাড়ি, এগুলো পরার পরেও আপনি জিজ্ঞেস করেন— এগুলো কি ইসলামের পোশাক নাকি!

আপনার কাছে জোবাইডেন কিংবা ইমানুয়েল মাখোঁদের পোশাকও ইসলামি পোশাক হিসেবে স্বীকৃতি পায়, কিন্তু যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের পরিধেয় পোশাককে ইসলামি পোশাক বলে মনে হয় না। কী আশ্চর্য আপনার বুঝ ভাই!

আপনার সামনে এতো এতো উদাহরণ, এত নজির থাকার পরেও যখন আপনি এই প্রশ্নগুলো  করেন, তখন আপনার মতো এমন মহা বুঝওয়ালা (!) ব্যক্তিদের বলতে ইচ্ছে করে— না, না, এগুলো ইসলামি পোশাক নয়। এগুলো হলো আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগে লুকিয়ে থাকা দৈত্য-দানব-জিন-ভূতদের পোশাক! বিপরীতে জোবাইডেন, ইমানুয়েল মাখোঁ, নেতানিয়াহুদের পোশাকই কেবল ইসলামী পোশাক।

~রেদওয়ান রাওয়াহা
১১.০৭.২৪

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ