দাড়ি ও রবিন্দ্রনাথ

 




এক সময় কেউ যখন আমাকে দাড়ির ব্যাপারে নাসিহা করতো, তখন আমি তাদেরকে মুখের ওপরই জবাব দিয়ে দিতাম এই বলে— দাড়ি তো রবিন্দ্রনাথেরও ছিল! 

এখন আমি বুঝি— আমার সেই কথা সত্য হলেও বুঝ এবং এপ্রোচটা অন্যায় এবং অপ্রয়োজনীয় ছিল। 

দাড়ি রবিন্দ্রনাথের ছিল বলে জবাব দেওয়া এই হতভাগাটা বুঝতে চাইতাম না যে, রবিন্দ্রনাথ দাড়ি রেখেছে বলেই দাড়ির গুরুত্ব হারিয়ে যায় না। দাড়ি রাখা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায় না। দাড়ি স্বয়ং আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম সাহাবায়ে আজমাইনেরও ছিল। 

আমি হতভাগা ছেলেটা নিজের দুর্বলতা, অপরাগতা এবং অক্ষমতাকে ঢাকার জন্য মুশরিক রবিন্দ্রনাথকে টেনে আনতাম। অথচ এই দাড়ি রাখা ও দাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, রবিন্দ্রনাথ নয়। রবিন্দ্রনাথ দাড়ি রেখেছে, এজন্য আমি রাখতে পারবো না বা রবিন্দ্রনাথের দাড়ি রাখার জন্য আমার দাড়ি রাখার সাওয়াবটা কমে যাবে—বিষয়টা তো তেমনও না। তবুও আমি কেন অযথাই রবিন্দ্রনাথ টেনে আনতাম?

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ ও সাহাবিদের আমল থাকার পরেও অযথা-অপ্রয়োজনীয় বস্তাপঁচা যুক্তি দিয়ে দাড়ি না রাখাকে জাস্টিফাই করাটা ছিল আমার অন্তরের একটা বড়সড় রোগ!

আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার কাছে কৃতজ্ঞ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তাঁর রহমত দিয়ে আমাকে বিগত এক দুই বছর ধরে এমন কিছু কিছু রোগ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। 

আমার দাড়ি যদিও এখন ছোটো, তথাপি আমি এখন দাড়ি বড়ো করেই রাখতে চাই। সেই চাওয়া থেকে প্রায়শই কিছুটা ছেড়ে দিই। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ছোটো করে ফেলি। এভাবে আমি বারবার হেরে যাই। এই আমলটা থেকে বারবারই পরাজিত হয়ে যাই।

আমি বুঝি, এটা ঠিক না। তবে এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিই— আমি তো আর ক্লিন শেইভ করছি না। কিংবা আমি তো আর দাড়িকে কামিয়ে ফেলছি না। বা স্রেফ স্টাইলের জন্যও রাখছি না। 

আমি মনে করি— দাড়ি না রাখার চেয়ে ছোটো করে রাখা হলেও ভালো। আমি আমার ঈমানের যেটুকু শক্তি আছে, সেটুকু শক্তির আলোকে সেই চেষ্টাটাই করছি।

২০২২ সালের শেষ দিক থেকে কয়েকবার দাড়ি বড়ো করে ছেড়ে দিয়ে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই লজ্জা লজ্জা অনুভব হয়। আয়নার সামনে দাড়ি-সমেত চেহারা নিয়ে দাড়ালে কেমন যেন একটুখানি অন্যরকম লাগে। তাই আমি পরাজিত হয়ে যাই। হেরে যাই। এই সত্য বলতে এবং স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। 

আমি মনে করি ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজের ভুলকে মহৎ প্রমাণ করার চাইতে সত্য স্বীকার করা ভালো। এতে নিজের পাশাপাশি অন্যানদেরও সংশোধন হওয়া সহজ হয়। ভুলকে ভুল বললেই তো পরিপূর্ণ শুদ্ধ হবার সুযোগ থাকে। তাই না? 

এখানে আরেকটা কথা, ২১-২২ সাল থেকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, শ্রদ্ধেয় দায়িত্বশীল, হাফেজ রাশেদুল ইসলাম রাশেদ ভাইকে দেখতাম পরিপূর্ণ হক আদায় করে দাড়ি রাখেন। মাদরাসা ছাত্রদের মতো করে (যদিও ভাই আলিম শ্রেণি পর্যন্ত মাদরাসায় পড়েছেন) তখন থেকেই সব সময় পাঞ্জাবি টুপি পরিধান করতে থাকেন।

তো ভাইকে দেখে দেখেও এক সময় নিজের ভেতর দাড়ি ছেড়ে দেওয়ার প্রবল আগ্রহ বারংবারই জেগেছে। এছাড়াও ইসলামী ছাত্রশিবিরের বর্তমান দাওয়াহ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ আবিদ ভাইসহ আরো কিছু ভাইদের সাথে একসঙ্গে থাকায়ও একটা আগ্রহ জাগতো।

 এমন আরো কিছু বন্ধুবর ভাই আছেন, যাদের নাম সঙ্গত কারণেই উল্লেখ করতে পারছি না— তাদেরকে দেখেও ইর্ষা হতো। শুধু দাড়ি না। তাদের বিভিন্ন আমল, তাদের উত্তম আখলাক, মুয়ামালাত, চিন্তাভাবনা, সবদিকেই তাদেরকে ঈর্ষা হতো। তাদেরকে দেখে নিজেকে একেবারে আদর্শ ভণ্ড বলেই মনে হতো! 

যদিও আমার ভেতর জাগ্রত হওয়া সেসব আগ্রহ (দাড়িসহ অন্যান্য বিষয়ও) আজতক আংশিকও বাস্তবায়ন করতে পারিনি। কিন্তু আমি ইরাদা রাখি— ইন শা আল্লাহ, আমি ধীরে ধীরে উন্নত মুসলিম হবো। পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী হবো। দীনের বিধিবিধানের ব্যাপারে ডিফেন্সিভ না হয়ে অফেন্সিভই হবো। 

আসলে মানুষের ভালো হওয়া, সফল হওয়া, আল্লাহর প্রিয় হবার এই যে এক জার্নি— এর তো শেষ নেই। আমি সেই লং জার্নিতেই আছি। হয়তো-বা কখনো কখনো ভয়ানকভাবে আমি আমার গন্তব্য থেকে ছিটকে যাই। কিন্তু পুনরায় উঠে দাঁড়াবার যেই কষ্টকর চেষ্টা, আমি সেই চেষ্টাটা তো নির্দ্বিধায় করি, এটাই আমার সান্ত্বনা! 

আমি এখনো অজস্র ভুল করি। অগণিত পাপ করি। গোপন পাপের পাহাড় জমে আছে আমার জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে। তবুও আমি যেসব ভুল করি বা করেছি, সে-সবকে শরিয়তের পোশাক পরিয়ে উত্তম হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যাবো না। এমনকী যাই-ও না, আলহামদুলিল্লাহ।

আমি ইনসান বলেই ভুল করবো। মানুষ বলেই আমার ভুল হবে। আমার সীমাবদ্ধতা আছে বলেই আমি মানুষ। কিংবা মানুষ বলেই আমার সীমাবদ্ধতা আছে এবং থাকবে। কিন্তু তাই বলে আমার দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাকে উত্তম প্রমাণের মতো হীন চিন্তা থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাকে নিস্তার প্রদান করুন। আ-মী-ন।


~রেদওয়ান রাওয়াহা

১০.০৭.২৪ ইং

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ