শেখ মুজিবুর রহমান কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতেন?
প্রশ্নটি শুনে অনেকেই একটু অবাক হবেন। এ আবার কেমন প্রশ্ন! কিন্তু, একটু চিন্তা করুন, মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছাবন্দি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, কীভাবে দেশ স্বাধীন হয়েছে এগুলো তিনি জানতেন না।
দেশে ফিরে তাকে জানতে হতো। কার কাছ থেকে জানতেন? যারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, তার অবর্তমানে যারা দায়িত্ব পালন করেছে তাদের কাছে।
কিন্তু, দুঃখজনক ব্যাপার হলো, শেখ মুজিবুর রহমান ৯ মাসের যুদ্ধ সম্পর্কে জানার আগ্রহবোধ করতেন না। বরং মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসলে তিনি বিরক্ত হতেন!
তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী; বলা যায় যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়। তার মুখ থেকে আভ্যন্তরীণ কথা বের করা সাংবাদিকদের জন্য কষ্টকর ছিলো। তবুও বাংলাদেশ অবজারভারের প্রাক্তন নির্বাহী সম্পাদক আব্দুর রহিমকে হতাশ হয়ে বলেই ফেলেন- “বড়ই দুঃখের ব্যাপার। লীডারকে (শেখ মুজিব)মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসটা কখনো পুরোপুরি বলার সুযোগ পেলাম না। যখন বলতে গেছি, তিনি বললেন, রাখ রাখ আমার সব জানা আছে। কার কি ভূমিকা ছিল সবই আমি জানি। নতুন কথা আমাকে কি আর শোনাবে।” [আব্দুর রহিম, নিশাচরের নিশিদিন, পৃষ্ঠা ৪০]
.
১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিন তাজউদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে যান। এর আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে কানপড়া দেয়া হয়েছে যে, তাজউদ্দিন আহমদ এখন প্রধানমন্ত্রী, তার হাতে সব ক্ষমতা, আপনি প্রেসিডেন্ট, আপনার ক্ষমতা নেই।
তাজউদ্দিন আহমদ শেখ মুজিবের বাড়িতে গেলে তিনি তার সাথে কোনো কথাই বললেন না। দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকলেন। নেতার এমন আচরণ দেখে বেশ হতাশ গলায় তাজউদ্দিন বললেন,
“মুজিব ভাই, ভেবেছিলাম অতি আগ্রহ নিয়ে কত কথাই না আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, কত প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছি, সে কথা জানতে চাইবেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনার কানে অনেক কিছুই ঢালা হয়েছে, আমার বিরুদ্ধে। তবে আপনি নিজে থেকে আমার কাছে কিছু জানতে না চাইলে, আমি কিছু বলব না।”
কথার একপর্যায়ে শেখ মুজিব বললেন- “তুই আজই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে resign দিবি। আমি প্রধানমন্ত্রী হব। তুই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে ফেলবি।”
তাজউদ্দিন অবাক হয়ে শেখ মুজিবের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “আপনার প্রত্যকটি কথা পালিত হবে। আপনি এসে গেছেন, আমি এখন মুক্ত।” [বদরুদ্দীন উমর, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক তাজউদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা ৮৭-৮৯]
.
শেখ আবদুল আজিজ ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া ছাড়াও তিনি ১৯৭০ সালে পাকিস্তান আইনসভার সদস্য ও ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
সেই আওয়ামীলীগ নেতা শেখ আব্দুল আজিজ বলেন-
“সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও আমি অনেকবার বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনাসমূহ বলতে চেয়েছি। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘তোমাদের বলা লাগবে না, আমি সব জানি।' এ কথা বলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ইতিকথা এড়িয়ে গেছেন। আমার ধারণা বঙ্গবন্ধুর ‘ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স' ছিল। কারণ তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধ করেনওনি, দেখেনওনি। তিনি পাকিস্তানের কারাগারে আটক ছিলেন। অজানা কারণে তার মনে এ ধারণা হয়েছিল যে, তিনি যুদ্ধ করেননি। অন্যের কাছ থেকে যুদ্ধের কথা শুনবেন কেন?” [শেখ আব্দুল আজিজ, রাজনীতির সেকাল ও একাল, পৃষ্ঠা ৩০২]
আওয়ামীলীগের আরেক সংসদ সদ্যস এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর এম এ মোহাইমেন তার বইয়ে উল্লেখ করেন-
“দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তার গ্রেফতার হওয়ার পরে দেশ কিভাবে স্বাধীন হয়েছিল, কিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া হয়েছিল, সে সময় কে কি ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, কার অবদান কতটুকু ছিল এ সম্পর্কে তিনি কোনদিন কোন খবরই জানতে চাননি। এ ব্যাপারে কখনো কোন আলোচনাও হতে দেননি। বাহাত্তরের দশই জানুয়ারী থেকে পঁচাত্তরের পনরই আগস্ট পর্যন্ত রেডিও-টেলিভিশন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে বাহাত্তরের নয়ই জানুয়ারী পর্যন্ত এ সময়টুকু সম্পর্কে সর্বপ্রকার নিরবতা পালন করা হয়ে আসছিল, কারণ ঐ সময় তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত এবং আলোচনা হতে গেলেই তাজউদ্দিনের নাম মধ্যমণি হিসাবে এসে পড়ে যেটা তিনি সহ্য করতে রাজী ছিলেন না। স্বাধীনতা অন্যের হাত দিয়ে আসবে সেটা তিনি প্রসন্ন মনে গ্রহণ করতে রাজী ছিলেন না।” [এম এ মোহাইমেন, ঢাকা আগরতলা মুজিব, পৃষ্ঠা ১৩২-১৩৭]
.
১৯৭০ সালের ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করেছিলো। সেই উপলক্ষে এই দিনটি উদযাপন করা হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর ৭২-৭৩-৭৪-৭৫ সাল মোট ৪ বার সেই ঐতিহাসিক স্থানে, ঐতিহাসিক দিনটি উদযাপন করার সুযোগ ছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের।
কিন্তু, যখনই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃবৃন্দ তাকে বলতেন, তিনি এড়িয়ে যেতেন। সেই জায়গায় যেতে তার অনীহা, অথচ জায়গাটির নামকরণ হয় তার নামে!
মুজিব সরকারের প্রথম চিফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন আক্ষেপ নিয়ে তার বইয়ে উল্লেখ করেন-
“স্থানটির নামকরণ করা হল মুজিবনগর। মুজিবনগরে আমরা মুজিবকে কখনও নিয়ে যেতে সক্ষম হইনি। দিবসটির সাথে তার নিজের কোন সম্পর্ক ছিল না বিধায় একটা নিস্পৃহ কণ্ঠে জবাব আসত, ‘তোরা যা’। আমরা যেতাম এবং নেতাদেরকে বলতাম মুজিবনগরকে স্মরণে ধরে রাখার মতো করে গড়ে তোলা হোক। কিন্তু আমাদের বলা আর তাদের শোনা এ পর্যন্তই রয়ে যেত। বাস্তব ক্ষেত্রে সেখানে কিছুই করা হল না।” [শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, বলেছি বলছি বলব, পৃষ্ঠা ৪৮০]
.
শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক বন্ধু এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী মমিনুল হক খোকাও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শেখ মুজিবের অনাগ্রহ দেখে অবাক হন। তার বইয়ে উল্লেখ করেন-
“...একদিন মিঞাভাইকে (মুজিব) নিয়ে সকালে নাস্তা করছি সবাই, ভাবী (ফজিলাতুন্নেসা)আমাদের অন্তরীণের শেষ দিনটির কথা তুললেন। মিঞাভাই খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। এই একটা বিষয় আমার কাছে মাঝে মাঝে রহস্যময় মনে হতো, দীর্ঘ নয় মাস আমাদের কীভাবে কেটেছে তা তিনি মোটেও শুনতে চাইতেন না। এই প্রসঙ্গে ভাবী কিছু বলতে চাইলে হাত তুলে নিষেধ করতেন, বলতেন আমি জানি সব কিছু। ভাবী ক্ষুব্ধ হতেন।
মিঞাভাই অবশ্য মিয়ানওয়ালী জেলে নিজের বন্দীজীবন সম্বন্ধেও কিছু বলতেন না। এমন কি দেশে ফেরার অব্যবহিত পরেই ১৪ জানুয়ারী তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন, সেখানে মিয়ানওয়ালী জেলে তাঁর প্রতি পাকিস্তানিদের ব্যবহার ও বন্দীজীবন সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে ‘আমার দেশবাসী যে কষ্ট করেছে তার তুলনায় ও কিছু নয়' বলে সাংবাদিককে থামিয়ে দেন।” [মমিনুল হক খোকা, অন্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জল: বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি, পৃষ্ঠা ১৮৩-১৮৪]
.
শেখ মুজিবুর রহমান ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কতোটা জানতেন এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তার সময়েরই আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ। যারা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের কারো কথা তিনি শুনতেন না। তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল কারো কাছ থেকেই জানার চেষ্টা করতেন না, “আমার অবর্তমানে কীভাবে কী করেছো?”
.
মুক্তিযুদ্ধের এই অজানা ইতিহাস নিয়ে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে এমন একটি বই, যেটা পড়ে অনেকেই অবাক হবেন!
বইটিতে এমনসব প্রমাণ, দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে, যা দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামীলীগের মুক্তিযুদ্ধের মিথ্যাচারে ধ্বস নামাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে রাজনীতি করা আওয়ামীলীগের চেতনা-ব্যবসা উন্মোচন করার জন্য জুলাই বিপ্লব পরবর্তী এরকম একটি বইয়ের প্রয়োজন ছিলো।
৮০০+ পৃষ্ঠার বইটি পড়তে গিয়ে লিটারেলি অবাক হচ্ছি!
Comments
Post a Comment