আবু ত্বহা আদনানের সমালোচিত বক্তব্য প্রসঙ্গে

 



দেখুন, আমি আবু ত্বহা আদনানের সাধারণ একজন ভক্তও নই। স্পষ্ট করেই বলি, আমি তাকে কখনো টানা দুই মিনিটও শুনিনি— হ্যাঁ, দুই মিনিটও না!


আসলে, আমি ওয়াজই তেমন একটা শুনি না। মিজানুর রহমান আজহারী, আব্দুল হাই সাইফুল্লাহসহ আরও অনেকের নাম যাদের মুখে মুখে শোনা যায়, যাদের নিয়ে এক শ্রেণির মানুষ মুগ্ধতার সাগরে ভাসেন— আমি কখনোই তেমন মুগ্ধ হইনি। সত্যি বলতে, তাদের কারও প্রতিই আমার মধ্যে এতটুকু মুগ্ধতাও জাগে না।


এমনকি, শহীদ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (রহ.)-এর ওয়াজও কবে শেষবার টানা ১৫ মিনিট শুনেছি, সেটাও মনে পড়ে না।


২০১৮-১৯ সালের পর থেকে শুধু দুইজন মানুষের আলোচনা আমি কিছুটা সময় নিয়ে শুনেছি—

১. ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)

২. সাইয়েদ কামালুদ্দিন জাফরি (হাফি.)


এই দু’জন ছাড়া বাংলাদেশের আর কারও ওয়াজ বা বক্তব্য আমি সিরিয়াসলি শুনিনি বিগত ৫/৬ বছর। 


তার মানে কি আমি আবু ত্বহা আদনান বা আজহারীকে ঘৃণা করি? না, মোটেও না। তাদের প্রতি যেমন মুগ্ধতা নেই, তেমনি ঘৃণাও নেই।


আমি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে হেদায়েত, বরকত ও সাফল্যের দু'আ করি।


যে কাজের সঙ্গে তারা জড়িত— দ্বীনের দাওয়াত— সেই কাজের বরকতের জন্যও আল্লাহর কাছে দু'আ করি।


আমার মতো নিতান্তই অখ্যাত এবং অগুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি তাদেরকে না শুনলেও, বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ তো তাদের শোনে। আমি শোনার প্রয়োজন বোধ করি না। কারণ, আমি মূলত পড়তে পছন্দ করি। বই, প্রবন্ধ-নিবন্ধ-পত্রপত্রিকা পড়া— এটাই আমার আগ্রহের জায়গা।


তাই এত কথা বলার মানে হলো, যেখানে আমি আদনানের কথা শুনিই না, সেখানে তার ভক্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।


কিন্তু, গতকাল থেকে তার যে সমালোচনা শুরু হয়েছে, আল্লাহর কসম! এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাটাছাঁট করা ভিডিও। এগুলো মিথ্যাচার। নোংরামি।


একজন মানুষকে অপছন্দ করা স্বাভাবিক। সবাইকে তো সবার ভালো লাগবে না। লাগা উচিতও না।


তো, ভালো লাগবে না বা লাগে না, এজন্য কি তাকে নিয়ে মিথ্যা বলব বা ছড়িয়ে পড়া মিথ্যায় পার্টিসিপ্যাট করব?


কেউ যদি আমার দলের না-ও হয়, সেজন্য কি তাকে ঘৃণা করতে হবে?


আবু ত্বহা আদনান, “আলফা মেইল, সিগমা মেইল, বিটা মেইল” জাতীয় কোনো কথা বলেছেন কি না, কিংবা এমন কোনো তত্ত্ব নিয়ে কিছু লিখেছেন কি না— আমি জানি না।


এমনকি, যাদেরকে উদ্দেশ্য করে এসব বলা হচ্ছে, তাদের কারও মুখেও আমি কখনো এসব শুনিনি। (হয়তো বলতেও পারে। কিন্তু আমি শুনিনি বা পড়িনি)। তবুও, তাদের সবার নাম জড়িয়ে একসাথে সমালোচনা করা হচ্ছে। এইভাবে ফ্রেমিং করে নির্মমভাবে ব্যাশিং চলছে । 


মনে রাখবেন, আপনি যদি মুসলিম হয়ে থাকেন, ইসলাম যদি আপনার দ্বীন হয়ে থাকে, তা হলে আপনার শত্রুকেও আপনি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মোকাবেলা করতে পারেন না, জায়েজ নেই। ইসলাম আপনাকে শত্রুর সাথে ডিল করার উপায়ও শিখিয়েছে। কিন্তু মিথ্যাচার করে, অপবাদ দিয়ে, নিজের উইমেন কার্ড ইউজ করে অন্যকে হেয় করার অধিকার আল্লাহর দ্বীন আপনাকে দেয়নি।  


আবারও বলছি— শত্রুকে কীভাবে ডিল করতে হবে, ইসলাম তা-ও শিখিয়েছে। কিন্তু মিথ্যা অপবাদ দিয়ে শত্রুকেও ডিল করতে শিখিয়েছে কি না— আমার জানা নেই। 


কিন্তু আপনি যদি অমুসলিম, ইসলাম-বিদ্বেষী, বা ইসলাম-বিরোধী গোষ্ঠীর মতো মিথ্যা প্রপাগান্ডায় লিপ্ত হন— তাহলে তাদের সঙ্গে আপনার তফাৎ কী?


আমি খুব কষ্ট পেয়েছি আমাদের অনেক ভাইবোনদের অন্যায়ভাবে এই প্রপাগান্ডায় অংশ নিতে দেখে।


কয়েকদিন আগেও আরেকজনের বিরুদ্ধে একটা ছাপড়ি মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়েছিল। তখনও খেয়াল করেছি— আমরা একইভাবে ইনিয়েবিনিয়ে যুক্ত হয়েছিলাম সেই মিথ্যা প্রপাগাণ্ডায়।


কিন্তু ভাই, এতে করে আসলে কার কী উপকার হচ্ছে?

আদতে কিছু লাভ হচ্ছে কি? নিজের বা উম্মাহর কোনো উপকার হচ্ছে?


আবু ত্বহা আদনানের সমালোচিত বক্তব্য আমি শুনেছি। তিনি স্পষ্ট বলেছেন—

“এই যে আগামীকাল ভ্যালেন্টাইনস ডে...,[ এভাবেই ভিডিয়োটা শুরু। আমি তার ভিডিয়োটা নিচে দিচ্ছি। দেখে নিয়েন...]”


উনি কী বুঝিয়েছেন?

এক ভাই একটা উদাহরণ দিয়েছেন:

ধরা যাক, এলাকায় অনেক চুরি হচ্ছে। কেউ এসে বলল—

“ভাই, বাড়ির দরজা বন্ধ রাখুন। না রাখলে চুরি হলে চোরের পাশাপাশি আপনিও দায়ি হবেন।”

এই কথা কি চোরকে কিংবা চুরিকে উৎসাহ দেওয়া?


ঠিক তেমনি, আদনানের সমালোচিত বক্তব্যটি বেশ কয়েকবছর আগে দিয়েছে। যেখানে সে বলছেন—

“কোনো নারী যদি মাহরাম ছাড়া হোটেলে যায়, গায়রে মাহরামের সঙ্গে ফুচকা খায়, ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন করে, ইসলাম যেখানে মাহরাম ছাড়া হজই ফরজ করেনি, তুমি মাহরাম ছাড়া বয়ফ্রেন্ড/জাস্ট ফ্রেন্ড নিয়ে দিনভর ঘুরতে যাও, পরে ধর্ষণের শিকার হলে— ধর্ষকের পাশাপাশি তোমারও (সেই মেয়েরও) দায় আছে।”


কোথাও কি তিনি বলেছেন— “মাহরাম ছাড়া বের হলে ধর্ষণের শিকার হলে মেয়েই দায়ী?” না, বলেননি।

 মেয়েটার দায় আছে, আর মেয়েটাই দায়ি— দুটো বাক্যের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে। 


কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ কাটাছাঁট করে, হুদাই তার নামে অপপ্রচার করছি।


খেয়াল করে দেখুন, সে কিন্তু সকল মেয়েকেও বলেনি কিছু। খুবই স্পেসিফিক একটা অংশকে বলেছে। এখন আপনি হয়তো বলবেন, তাদের বলছে মানে কী? তারা তো স্বেচ্ছায়ই এসব করে, সম্মতিতেই করে। 


না, স্বেচ্ছায় করলেও কিছু কথা থাকে। নিউজপেপারগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে দেখুন— বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়ে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের শিকার। বয়ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা দেওয়ার পরে ধর্ষণের শিকার। এমন ঘটনা ঘটে না? এমন নিউজ হয় না? বন্ধুদের বিশ্বাস করে গেছে, কিন্তু পরবর্তীতে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ হয় না? 


যদি হয়েই থাকে, তা হলে ভিডিয়োটার আলোকেই তো বুঝা যায় যে, উক্ত প্রসঙ্গেই ত্বহা কথাগুলো বলছে। না কি অন্য কোনো ইস্যুতে বলছেন?


আরও একটা বিষয় খেয়াল করুন। বক্তব্যটা কিন্তু আজকের না। কয়েকবছর আগের। এখন, হুট করেই আজকে সেটা ভাইরাল হয়েছে কেন? কে করছে? কেন করছে? কোন উদ্দেশ্যে? আপনি এগুলো খেয়াল করবেন না? আপনি কেন এসব দ্বারা প্রভাবিত হবেন? 


এখন হয়তো বলবেন— আপনি কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এগুলো বলছেন না বা লিখেছেন না তাকে। কিন্তু, যদি প্রভাবিতই না হতেন, তাহলে আজকেই এটা বললেন কেন? দুই দিন আগে বা পরে বলা যেত না? 


আপনি যে প্রভাবিত, সেটা বুঝতে আরেকটা বিষয় খেয়াল করুন— যে ফটোকার্ডটি ছড়িয়েছে। আপনারা সেটাকেই পোস্ট করে লিখছেন। দেখুন, ফটোকার্ডে যেভাবে লেখা আছে, ত্বহা আদনান কি আদৌ সেটা বলছে? 


“যদি ফটোকার্ডে উল্লেখ করা কথাগুলো না দেখতেন, তাহলে কি একইভাবে আপনি ট্রিগার হতেন? আপনার আবেগ, আপনার জেদ—যেভাবে এখন তীব্রভাবে কাজ করছে, এই কথাগুলো না দেখলে কি সেভাবেই কাজ করত?


না, করত না। কারণ, ফটোকার্ডে যা লেখা আছে, সেটা যে কারও মনে নাড়া দেবে। দিতেই পারে। কারণ সেখানে পুরো দায়টাই চাপানো হয়েছে ধর্ষিতার ওপর— মাহরাম ছাড়া বের হলে কোনো ছেলে যদি কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করে, তাহলে দোষ ওই মেয়েটারই।”


অথচ এমন কথা সে বলেনি। 


মনে করেন, সে যা বলেছে, সেটার আংশিকটাও যদি কেটে আনি, সেখানেও সে এমনটা বলেনি।  মানে, এভাবে এক তরফা দায় দেয়নি মেয়েটাকে। 


আপনি যদি আগে পিছে না শুনে, শুধু আপনি তার সমালোচনার জন্যও কাটছাঁট করেন, সেখানেও কিন্তু সে এভাবে বলেনি। সেখানে বলেছে, দায় মেয়েটারও আছে।


আমি ওই কনটেক্সট বাদ দিলাম, সেটা বাদ দিলেও যদি এটাকেই একমাত্র বক্তব্য ধরি, তবুও এমন ট্রিগারড হতেন না।


এই ফটোকার্ড বানিয়েছেই আপনাকে উত্তেজিত করে দিতে বা রাগিয়ে দিতে। আর আপনি রেগেমেগে এলোপাতাড়ি বকেও গেলেন। তার সম্মানহানি করে গেলেন। উক্ত ফটোকার্ড ব্যবহার করে কয়েকটি বড়সড় রচনাও লিখে ফেললেন। তবু্ও বলছেন আপনি কারও দ্বারা প্রভাবিত না— হাউ ফানি!


যাই হোক ভাইবোনেরা, জুলুম করবেন না। তার বক্তব্যের প্যাটার্ন হয়তো আরও সুন্দর হতে পারতো। হয়তো আরও উত্তমভাবে বলা যেত। কিন্তু দিনশেষে, আপনি তো সেটারও সমালোচনা করেননি।


 আপনি ফটোকার্ডের মিথ্যা অপবাদ দেওয়া জিনিসটাকেই প্রচার করলেন। হাইপ তুললেন সেটা দ্বারাই। কখন কোন প্রেক্ষাপটে বক্তব্যটা দিয়েছেন, আপনি সেটাও বিবেচনা করলেন না— যেগুলো সাধারণত ইসলামফোবরা বিবেচনায় নেয় না। অথচ আপনি মুসলিম হয়েও আপনার মুসলিম ভাইয়ের এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেননি। এটা কি জুলুম নয় প্রিয় ভাই?


এছাড়াও, কনটেক্সট বাদ দিয়ে যদি আপনি কুরআনও পড়েন, ভুল বুঝবেন অনেক জায়গায়। আগেপিছে কেটে যদি কুরআনও পড়েন, সেখানে ভুল অর্থ পাবেন। যেমন, কুরআনের এক জায়গায় আছে— হে মুমিনগণ, তোমরা সালাতের নিকটবর্তীও হয়ো না৷ নেশাগ্রস্ত অবস্থায়।


এখন আপনি পরের অংশ কেটে দিয়ে বলতে পারেন— দ্যাখো দ্যাখো, আল্লাহ মুমিনদের নামাজের ধারেকাছেও যেতে বারণ করেছেন! তাহলে কেমন হবে বিষয়টা? কুরআনের আয়াত থেকে যদি এভাবে ভুল মিনিং বের করা যায়, তবে ত্বহা আদনানের বক্তব্য থেকে যাবে না কেন? 


এরপরও তো বললাম, আগেপিছে কেটে দিলেও তো, আপনি যেই উক্তিটি ভাইরাল করছেন বা করায় সহযোগী হচ্ছেন, সে আদতে তা বলেইনি!


সম্মানিত ভাইবোনেরা, জুলুম করবেন না। জানেনই তো, আল্লাহ জালিমকে কখনও ছাড় দেন না। নারী, পুরুষ, গরিব, ধনী, কালো, সাদা— যে-ই হোক, জালিমকে আল্লাহ শায়েস্তা করেনই। শাস্তি দেবেনই।


তাই অন্যায় করার আগে, বিশেষ করে মিথ্যাচার করার আগে সাবধান হোন।


আবার, আরেকটা হাদিস তো জানেনই। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য শুধু এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা কিছুই শুনে, তা-ই প্রচার করে বেড়ায়।


সূরা হুজুরাতে তো বলা হয়েছে, কোনো ফাসিক যখন কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, সেই সংবাদ-বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার সত্যতা যাচাই করে নেওয়া। 


আল্লাহ আমাদের সবার হেফাজত করুন। আমিন।


[কমেন্ট বক্সে ভিডিয়ো লিংকটি দিলাম। https://www.facebook.com/share/v/1ABqx3fp2n/

বক্তৃতাটা সে ১৪ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে বহু বছর আগেই দিয়েছে। যা ওপরেও বলছি। আপনি যদি নিজের বিবেকের কাছে সৎ হন, তা হলে ভিডিয়োটা দেখে আপনি অবশ্যই বুঝবেন, আপনি ন্যায় করছেন না অন্যায় করেছেন! যদি বিচার যা-ই হোক, তালগাছ আপনার হয়, আশা করি হা হা রিয়েক্টের পাশাপাশি গালি দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন।🤦‍♂️ ]

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ