আমীরে জামায়াতের শহীদ পরিবার-সফর
ইতেকাফের নিবিষ্ট আত্মসমর্পণ শেষে আমীরে জামায়াত, ডা. শফিকুর রহমান, সরাসরি ছুটে গেছেন জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের পরিবারের কাছে। গিয়েছেন ২৮শে অক্টোবরের শহীদদের স্বজনদের সমীপেও।
এটি নিছক আনুষ্ঠানিক এক সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়; বরং এটি এক গভীর রাজনৈতিক প্রতীক, যা ইসলামী আন্দোলনের অন্তর্নিহিত দর্শন ও সংগ্রামের স্বরূপকে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করে।
ঐতিহাসিকভাবে আত্মত্যাগ ও রাজনৈতিক সংগ্রাম পরস্পরের পরিপূরক। প্রতিটি বিপ্লব তখনই স্থায়িত্ব লাভ করে, যখন তার শহীদদের স্মৃতি কেবল আবেগের পরিসরে সীমাবদ্ধ না থেকে রাষ্ট্রনৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তিতে প্রতিস্থাপিত হয়। ডা. শফিকুর রহমানের এই সফর— সেই দায়বদ্ধতারই সুস্পষ্ট স্বীকৃতি।
তিনি ইচ্ছে করলেই প্রথাগত রাজনৈতিক নেতৃত্বের মতো একটি আবেগঘন বিবৃতি দিয়েই কর্তব্য সম্পন্ন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে বরং শহীদদের রক্তের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন, কৃতজ্ঞতার সশ্রদ্ধ প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
শহীদদের আত্মত্যাগকে তিনি কেবল রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতেই দেখেননি; বরং একে রাষ্ট্রীয় নির্মাণের এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিপ্লবী সংগ্রামে আত্মত্যাগ তখনই প্রকৃত তাৎপর্য লাভ করে, যখন তা রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে অবস্থান নেয়।
ডা. শফিকের শহীদ-পরিবারবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিছক সমবেদনার বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং এটি রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা— "আমরা আপনাদের ভুলিনি, আপনাদের বুকের মানিকদেরও ভুলিনি। ভুলবও না।"
বিএনপি নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাকরণে জুলাই কিংবা জুলাই ম্যাসাকারে হারিয়ে যাওয়া সহস্র প্রাণের যে ইতিহাস অনুচ্চারিত থেকে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে এই সফরের মাধ্যমে তিনি সেই ইতিহাসকে আরও উচ্চকিত করেছেন।
আমাদের শহীদরা তাদের রক্তের বিনিময়ে কী প্রত্যাশা করেছিলেন? তারা কি শুধুই শোকের এক অনন্ত পরম্পরা তৈরি করতে চেয়েছিলেন, না-কি তাদের লক্ষ্য ছিল এক বৃহত্তর পরিবর্তন ও বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ?
শহীদ পরিবারগুলোরও বা প্রত্যাশা কী? তারা কি চান, তাদের সন্তানদের আত্মত্যাগ শুধুই স্মৃতির পাতায় লিপিবদ্ধ থাকুক? না-কি তারা চান, সেই আত্মত্যাগ রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দৃঢ়মূল হোক? প্রকৃতপক্ষে, আত্মোৎসর্গ তখনই প্রকৃত মর্যাদা পায়, যখন তা রাষ্ট্রীয় নীতির কেন্দ্রে প্রতিস্থাপিত হয়।
এই সফরের মাধ্যমে আমীরে জামায়াত ইমপ্লিসিটভাবে বার্তা দিয়েছেন— জামায়াতে ইসলামী যদি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তবে শহীদদের আত্মত্যাগকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেই সর্বোচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হবে। তাদের রক্তের ঋণ শুধুমাত্র শোকসভায় সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং রাষ্ট্রীয় নীতিতেই প্রতিফলিত হবে।
যদিও জনসমর্থন, রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় জামায়াতে ইসলামীর ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই সীমিত, তবুও ইতিহাস আমাদেরকে জানান দেয়— একমাত্র রাজনৈতিক শক্তিই চূড়ান্ত বাস্তবতা নির্ধারণ করে না; আদর্শিক দৃঢ়তাই চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়।
যদি কখনো ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় আসে, তবে জুলাই অভ্যুত্থান কেবল স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া এক অধ্যায় হবে না; বরং রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে বলে বিশ্বাস করি, ইন শা আল্লাহ।
আমীরে জামায়াতের এই সফর ছিল নেতৃত্বের এক শুদ্ধতম প্রকাশ। এটি নিছক আনুষ্ঠানিকতার চৌহদ্দিতে আবদ্ধ নয়; বরং এটি এক গভীর রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিফলন।
জনমানুষের প্রকৃত প্রতিনিধি, আমীরে জামায়াত, ডা. শফিকুর রহমানের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। তাঁর নেতৃত্বে অজস্র শহীদের রক্তে রঞ্জিত এই জমিনে ইসলাম এবং ইসলামী আন্দোলন আরও সুসংহত হোক।
শহীদদের আত্মত্যাগ যেন ইতিহাসের পাতায় ম্লান না হয়, বরং তা এক নতুন জাগরণের উৎস হয়ে উঠুক। আল্লাহ তাআলা আমাদের শহীদদের জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোকে সবর ও ইস্তিকামাতের পাহাড় বানিয়ে দিক। আমীন।
~রেদওয়ান রাওয়াহা
৩১.০৩.২৫
Comments
Post a Comment