আন-নাহদার পতন: মুসলিম রাজনীতির পথভ্রষ্ট মানচিত্র




.আজ একটা খবর পড়লাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

 খবরটা একদিকে ইন্ট্রেস্টিং। আবার, অন্যদিকে বিশ্ব ইসলামি আন্দোলনের জন্য কষ্টদায়ক, পাশাপাশি শিক্ষনীয়ও বটে।


তিউনিসিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আন-নাহদা পার্টির নেতা, আলী লারাইদকে ৩৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত। অভিযোগ— ইরাক ও সিরিয়ায় জিহাদি পাঠিয়েছেন তিনি।


এর আগে এই পার্টির প্রধান, ড. রাশিদ ঘানুসিকেও তিন বছরের সাজা দিয়েছিল আদালত।


আন-নাহদা পার্টি ও রাশিদ ঘানুসি— ইসলামি আন্দোলনের সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে, এ নাম দুটো তাদের অচেনা নয়। যদিও, সবারই যে জানা থাকবে, তা না। একসময় আমারও ছিল না। পরে জানতে পেরেছি।


রাশিদ ঘানুসি— এক সময় ছিলেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার এক প্রতিশ্রুতিশীল মুখ। মুখে ইসলামি রাষ্ট্রের কথা, বুকে উম্মাহর ব্যথা, কর্মে খিলাফতের স্বপ্ন।


মনে হতো, এ মানুষটিই বুঝি ইতিহাস বদলে দিতে পারেন।


কিন্তু সময় বদলায়। মানুষও বদলায়।


ঘানুসি বদলে গেলেন। এই ধারার অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের মতো বাহ্যিক সুরত-সিফত তো আগে থেকেই বদলে ছিল, পরবর্তীতে চিন্তাভাবনায়ও আদ্যোপান্ত বদলে গেলেন তিনি।


ইসলামি চিন্তাকে আপাদমস্তক আধুনিকতার ফ্রেমে ঢোকাতে চাইলেন। তিনি হয়ে ওঠেছিলেন “মুসলিম পলিটিক্যাল সেক্যুলারিস্টদের আইডল”। 


সেক্যুলারিজমকে ইসলামের আলোকে জায়েজ দেখাতে ওঠেপড়ে লাগলেন তিনি। বললেন, “সেক্যুলারিজম আর ইসলাম একে অপরের বিরোধী নয়।”


এমনকি সম্ভবত এ-ওদাবি করলেন— মদিনা রাষ্ট্রও না কি এক ধরনের সেক্যুলার রাষ্ট্র ছিল!


ঘানুসি চেয়েছিলেন পশ্চিমাদের মন জিততে। তাই লিবারেলদের ভাষা আয়ত্ত করলেন। তাদের জনপ্রিয় চিন্তা— সেক্যুলারিজমের ইসলামাইজেশন করলেন। ভাবলেন— এভাবে হয়তো টিকে থাকা যাবে। তাদের সন্তুষ্ট করা যাবে। 


সেই চিন্তা থেকেই জামায়াতে ইসলামী ও ইখওয়ানুল মুসলিমিন ধাঁচের এই দলটির প্রাণপুরুষ— ইসলামি রাষ্ট্র বা খিলাফতের স্বপ্ন ছিল যার বুকের গভীরে— তিনি ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে না যেতেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন সেই স্বপ্ন থেকে। শুধু ব্যক্তিগত দর্শনই নয়, নিজের দল ও আন্দোলনের ভিত্তিমূলটাই আমূল বদলে ফেললেন।


তাঁর এসব চিন্তাকে কেউ কেউ আবার ‘পোস্ট-ইসলামিজম’ নামে চিহ্নিত করেন— যেখানে পরিপূর্ণ ইসলাম নেই, আছে স্রেফ রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার মেকি চাতুর্য।


বাংলাদেশেও জামায়াত-শিবিরের সাবেক-বর্তমান কিছু ভাই এবং চরমোনাইয়ের শেখ ফজলুল করিম মারুফ— এই চিন্তাধারা আমদানি করতে যথেষ্ট পরিমাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সেই চেষ্টা থেকে নানা-ধরনের বক্তব্য দেন, বিভিন্ন কিছু লিখেন।


তারা আন-নাহদা এবং রাশিদ ঘানুসিকে দেখে শিখছেন না।


যাদের তুষ্ট করতে এই কষ্ট, এই কাঠখড় পোহালেন রাশিদ ঘানুসি ও তার আন-নাহদা পার্টি— তিনি বা তার দল পারলেন না তাদের সন্তুষ্ট করতে।


চিন্তা করুন, ড. ঘানুসিরা এত উদার হলেন, এত সেকুলার হলেন, সেক্যুলারিজম ইসলামের জিনিস বলে চালিয়ে দিলেন, ইসলামের পবিত্র ব্যূহে আপসের বিষ ঢুকিয়ে দিলেন— তবুও কি তারা সেক্যুলারদের কাছে মকবুল ইনসান হয়েছেন? হলেন না তো। হওয়ার কথাও না।


এ তো কুরআনের সেই শাশ্বত সত্যের বাস্তব প্রতিফলন— “তারা তোমার প্রতি কখনোই সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের জীবনব্যবস্থা অনুসরণ করো।” (সূরা আল-বাকারাহ: ১২০)


ড. ঘানুসি ক্ষমতা হারালেন, মামলা খেলেন। কারাগারে গেলেন। আজকে শেষ পর্যন্ত তার সরকারের প্রধানমন্ত্রী পেলেন আদালতের রায়— ৩৫ বছরের কারাদণ্ড!


একজন মানুষ, যিনি জীবনের অধিকাংশ সময় ইসলামি আন্দোলনের জন্য দিলেন, তাদের হলো এই পরিণতি!


কেন?


কারণ, তিনি বা তারা আপস করেছিলেন। নিজের বিশ্বাস থেকে সরে এসেছিলেন।


অনেকে ভাবেন— জগৎটায় একটু বুঝেশুনে চললেই বুঝি রক্ষা পাওয়া যায়। সবার মন জিতলে সব ঠিক হয়ে যায়।


না ভাই, এভাবে হয় না। কখনোই হয়নি। কেউ পারেনি এভাবে।


রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুরু করে সাহাবায়ে আজমাইন এবং তৎপরবর্তীকালের মুজাহিদীন; কারো দ্বারাই এই আপসকামিতায় সাফল্য তো আসেইনি, এমনকি টিকে থাকাও সম্ভব হয়নি। সত্য বিষয় হচ্ছে— তারা ওই পথে অগ্রসরই হয়নি। 


উমর ইবনুল খাত্তাবের (রা.) একটি প্রসিদ্ধ কথা মনে পড়ে:


“আমরা তো একদা হীন ছিলাম, আল্লাহ আমাদেরকে ইসলাম দিয়ে সম্মান দিয়েছেন। এখন যদি আমরা অন্য কিছু দিয়ে সম্মান খুঁজতে যাই, তবে আল্লাহ আবার আমাদের অপমানিত করবেন।”


ঘানুসি এবং আন-নাহদা সেই ভুলটাই করলেন।


আর ইতিহাস? ইতিহাস কাউকে মনে রাখে না, যদি সে নিজেই ভুলে যায়— সে কে এবং কী ছিল!


আমাদের জন্য এই ঘটনা চোখ খুলে দেওয়ার মতো। আপনি যদি দ্বীনের সঙ্গে আপস করেন, শেষ পর্যন্ত খুব বেশি ভালো কিছু হয় না।


আপস করলে পাওয়া যায় শুধু হতাশা, বিচ্ছিন্নতা আর দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘ হয় ব্যর্থতা আর পরাজয়ের গ্লানি।আমাদের ব্যারিস্টার আর নেই।

Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ