জামায়াত-শিবির কীভাবে একাত্তর ইস্যুটাকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে পারবে?
জামায়াতের জন্য, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটা নির্মম বাস্তবতা হলো— বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এমনকি কমিউনিস্ট-সোশালিস্টরাও যদি বিলিন হয়ে যায়, তবুও একাত্তর জামায়াতের পিছু ছাড়বে না। ছাড়বে না বলতে ছাড়বে না। কোনো ক্রমেই না। যদি না একটা পূর্ণাঙ্গ ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত করতে পারে তারা।
বর্তমান যে রাজনৈতিক কাঠামো, যে তাগুতি ও কুফুরি ব্যবস্থা, এই ব্যবস্থায় জামায়াত শুধু ব্যবহৃতই হবে। আজ এই গ্রুপ থেকে তো কাল ওই গ্রুপ— জামায়াত একাত্তর ইস্যুতে ছোবল খাবেই। নির্মমতার মুখে পড়বেই।
আবার এই নির্মমতার কারণে আজকে কেউ সহানুভূতি প্রদর্শন করে পাশে দাঁড়াবে তো কালকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তখন অন্য কেউ এসে আবার নিপীড়ন চালাবে। আবার কেউ দু'চারটা সহানুভূতিমূলক কথাবার্তা বলবে। আবার পল্টি নেবে।
একটি পরিপূর্ণ ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত করা ছাড়া, এই অসহায়ত্ব জামায়াতের পিছু কখনোই ছাড়বে না। মাত্রাটা কমবে বা বাড়বে। এই আর কি!
কিন্তু, প্রশ্ন হলো, জামায়াত-শিবির বর্তমানে বিপ্লবী মানসিকতা কতখানি রাখে? কতটা শক্তিশালী পরিকল্পনা আছে একটা টেকসই ইসলামি বিপ্লব সাধনের জন্য?
হ্যাঁ, তারা ইসলামি হুকুমত কায়েমের জন্যই রাজনীতি করে কিংবা ময়দানে কাজ করে।
কিন্তু, তাদেরকে বুঝতে হবে— প্রচলিত কাঠামোয়, সাময়িকভাবে মুসলিম উম্মাহর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কিছু ফায়দা হাসিল করা গেলেও সেটা খুব বড়সড় কিংবা মজবুত কিছু অর্জন হবে না।
কত বছর পর একটি পরিপূর্ণ বিপ্লব সংঘটিত করা হবে বা করা যাবে, এটা নিয়ে কি তারা চিন্তা করে? বিভিন্ন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে?
শিবির থেকে আমি যদ্দুর দেখেছি কিংবা জানি— প্রচলিত ব্যবস্থায় নির্বাচন করে কয় বছর পর ক্ষমতায় আসা যেতে পারে বা আসবে, কতজন লোক কোন সেক্টরে ঢোকোনো হবে— এটা নিয়ে বিশ্লেষণ আছে বা হয়। কিন্তু, পরিপূর্ণ ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত করার কোনো দীর্ঘ মেয়াদি প্ল্যান, বিশ্লেষণ কিংবা শক্তিশালী চিন্তা ও দূরদৃষ্টি আছে কি-না?
দেখুন, নির্বাচনের মাধ্যমে ৫ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসা আর একটা বিপ্লব করা কিন্তু কস্মিনকালেও এক না। দুটোর পার্থক্য আকাশ আর জমিনের সমান। আশা করি আমরা সবাই বুঝি ও জানি।
প্রচলিত ব্যবস্থা, প্রচলিত কাঠামো, প্রচলিত নিয়মকে ভেঙেচুরে সম্পূর্ণ নতুন এক কাঠামো দাঁড় করানোই বিপ্লব।
আর আমরা তো ইসলামি বিপ্লবেরই স্বপ্ন দেখি। সে হিসেবে একটি পরিপূর্ণ ইসলামি বিপ্লব মানে হলো— তাগুতি কাঠামো ভেঙে আল্লাহর শাসনভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন। এই ধারণা তো আমরা শিখেছি সাইয়েদ কুতুব, সাইয়েদ মওদূদী, হাসান আল-বান্না প্রমুখের সাহিত্য থেকেই।
মওদূদী-সাইয়েদ কুতুব রহিমাহুমুল্লাহর সাহিত্যেই এই বয়ান, এই বিবৃতি, এই কথাগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
সেই বয়ান ও চিন্তাগুলোকে কীভাবে পরিপূর্ণতা দেবে তারা? অন্ততপক্ষে শহীদ সাইয়েদ কুতুব রহিমাহুল্লাহর ‘মা’আলিম ফিত তারিক’ তথা ইসলামি সমাজ বিপ্লবের ধারা বইটার যে মূল বক্তব্য— সেই বক্তব্য, সেটায় যেই পথ বাতলে দেওয়া আছে, সেটা কীভাবে চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এগুলো নিয়ে জামায়াতের মজলিশে শুরা কিংবা শিবিরের কার্যকরী পরিষদে কখনো আলোচনা হয় কি-না?
বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এগুলো নিয়ে ভাবার দরকার কি-না— এসব নিয়ে তাদের কেউ পরামর্শ দেন কি-না কিংবা তারাও চিন্তা করে কি-না এগুলো নিয়ে, জানি না।
কুতুবের ‘মা’আলিম ফিত তারিক’ কোনো গতানুগতিক আট-দশটা বইয়ের মতো কোনো বই নয়; এটি ছিল একটি বিপ্লবী ম্যানিফেস্টো। কিন্তু জামায়াত-শিবির কি কখনো সেটাকে বাস্তব রাজনৈতিক রূপরেখা হিসেবে গ্রহণ করেছে? না-কি বই পড়ে নস্টালজিয়াই সৃষ্টি করছে কেবল?
যদি চূড়ান্ত লক্ষ্য ইসলামি বিপ্লবই হয়— তাহলে সেই বিপ্লব বাস্তবায়নের বিষয়ে কি কোনো পরিকল্পনা আছে? আছে কি দীর্ঘমেয়াদি স্ট্র্যাটেজি? কিংবা বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে রোডম্যাপ?
আমার মনে হয়, গতানুগতিক কাজকর্ম কমিয়ে হলেও এগুলো নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিৎ। শুধু ইসলামি বিপ্লবের জন্যই অথবা সাইয়েদ কুতুবের মাইলস্টোন নিয়েই কয়েকটা সেশন তারা ওয়ার্কশপ চালাতে পারে।
আমি আবারও বলছি— বিপ্লব আর পাঁচ বছরের জন্য এমপি-মন্ত্রী কিংবা উপজেলা ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হওয়া এক জিনিস নয়। নির্বাচন আর বিপ্লব— দুটো এক নয়। কেন?
কারণ, একটিতে আপস থাকে, অন্যটিতে থাকে আদর্শের জন্য কেবলই আত্মত্যাগ। জামায়াত বারবার এই আপস ও আদর্শের মধ্যে টালমাটাল হয়েছে। একদিকে বিপ্লবের বুলি, অন্যদিকে প্রচলিত কাঠামোয় অতি রাজনীতি ও দৌড়ঝাঁপ— ফলে জনশক্তির মাঝে আদর্শিক বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
দেখুন, একাত্তর পরবর্তীতে জামায়াতসহ পুরো বাংলাদেশেই ইসলাম নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এই জমিন থেকে দ্বীন মুছেই যেত। কিন্তু সেই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে দ্বীনকে জিন্দা করায় পাইওনিয়রের ভূমিকা পালন করেছে জামায়াত।
পৃথিবীর ইতিহাসে পরাজিত গোষ্ঠী, এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, বিজয়ীর রোল-প্লে করতে পারে, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সম্ভবত এমন উদাহরণ খুব কমই আছে দুনিয়ায়।
ওই সময় বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম-সোশ্যালিজমের রমরমা রাজত্ব চলছিল। যুবকেরা সোশ্যালিজম-কমিউনিজম কায়েমের নেশায় বুদ হয়ে থাকত। জামায়াত, বিশেষত তার ছাত্র সংগঠন সেই কুফুরি ও খোদাদ্রোহীতা থেকে বিশাল একটা অংশ মেধাবী-শিক্ষিত যুবককে ফিরিয়েছে।
আজকে ইউনিভার্সিটিগুলোয় ছাত্রীদের বোরকা-নিকাব, ছাত্রদের দাড়ি-টুপি কিংবা গোড়ালির ওপর প্যান্ট, সালাত আদায়, কুরআন শেখার আয়োজন; এই যে দ্বীনকে ধারণ করার পুরো একটা চিত্র আমরা দেখতে পাই, এটা সম্ভবই হয়েছে প্রধানত জামায়াত-শিবিরের জন্য।
অন্যান্য ধারার মধ্যে তাবলীগও ভালো একটা ভূমিকা পালন করেছে। ভিত্তিটা গড়ে দিতে মাদরাসাগুলোর ভূমিকাও অনবদ্য।
কিন্তু, কথা হলো— সোশ্যালিজম-কমিউনিজমের পতনের পর জামায়াত-শিবির ওই অর্থে আর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক কাজই বাংলাদেশের মুসলমানকে উপহার দিতে পারেনি।
হ্যাঁ, গত ২/৩ দশকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ মোকাবেলায়ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বর্তমানে সেই ভূমিকাটাও কিছুটা নাজুক বৈকি!
কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্র মোকাবেলায় জামায়াত যেভাবে সাফল্য পেয়েছে, লিবারেলিজম মোকাবেলায় জামায়াত-শিবির সেই সাফল্যটা পায়নি।
সাফল্য পাওয়া তো দূরের কথা, বরং অনেকাংশেই তারা নিজেরাও আরও লিবারেল হয়েছে। লিবারেলিজমের মুখরোচক কথাবার্তায় ও চটকদার বাণীতে তারা আদর্শিকভাবে ধোঁকার শিকার হয়েছে। টেরও পায়নি। ধরতেও পারেনি।
এর দ্বারা কী ভয়ংকরভাবে ধোঁকা খেলে, শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতিরা পর্যন্ত সেক্যুলার-লিবারেল পলিটিক্সে যোগ দেয়।
কী ভয়ংকর অসুস্থতা ছড়িয়ে পড়লে পরে অজস্র কার্যকরী পরিষদ সদস্যরা পরবর্তীতে ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলন ছেড়ে সেক্যুলার ওয়েলফেয়ার স্টেইটের প্রতি ঈমানদার হয়ে ওঠে।
কতটা বাজেভাবে এগুলো ছড়িয়ে পড়লে বড়ো বড়ো নেতাদের ঘরে ঘরে ফামার মতো সন্তান তৈরি হতে পারে— চিন্তা করছেন কখনো?
এখন তো সেক্যুলারিজমের কুফুরি কিংবা জাতীয়তাবাদী ভ্রান্তি নিয়েও খুব বেশি শক্তিশালী বক্তব্য অথবা লেখাজোখাও চোখে পড়ে না।
লিবারেলিজমের দ্বারা এভাবে ধোঁকা খেলে, তারা না নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসবে, আর না ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত করতে পারবে— যার মাধ্যমে খোদার দ্বীনের একচ্ছত্র আধিপত্য এই জমিনে কায়েম করতে পারবে, যে জন্য তাদের সংগঠন প্রতিষ্ঠা।
এভাবে ধোঁকা খেতে থাকলে, মাঝেমধ্যে দুয়েকজন ভিপি নূর কিংবা মাহফুজ আলম উপহার দিতে পারবে জাতিকে। যারা পরবর্তীতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা করবে। জাতীয় সংগীত করবে। রঠা পূজা জারি রাখবে। অথবা মেহেন্দি সাফাদির সাথে গিয়ে গোপনে বৈঠক করবে।
যাই হোক, জামায়াত-শিবির যদি একাত্তরকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে চায়। তা হলে করণীয় দুটো—
১. হয় এই নাম পরিবর্তন করে রাজনীতি করা। এই রাজনীতি হবে প্রচলিত কাঠামোয় দ্বীনকে যদ্দূর প্রাসঙ্গিক রাখা যায়, সেটা। সেটা একটা ইসলামি দলের ব্যানারেও হতে পারে। মানে আপসকামী ইসলামি রাজনীতি চালানো। আবার চাইলে সেক্যুলার-লিবারেল ধারার একটা দলও হতে পারে।
২. অথবা পরিপূর্ণ একটি ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত করার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কোমর বেঁধে নেমে যাওয়া।
এক্ষেত্রে প্রচলিত কাঠামোয় দুই-একজন মন্ত্রী-এমপি হওয়া নিয়ে সন্তুষ্ট না থেকে অজস্র মানুষকে জীবন ও সম্পদের কুরবানির জন্য প্রস্তুত করানো লাগবে। এই প্রস্তুতিটা কমবেশি তাদের আছেও।
মাওলানা মওদূদী এগুলো প্রায় আশি বছর আগেই বলে গিয়েছেন। এটাকে তিনি বলেছেন, ‘একদল উন্মাদ লাগবে’। যাদের চোখে কেবল শরিয়াহ ও শহাদাহ।
উন্মাদরা প্রচলিত ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট থাকে না। খোদার দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজ করতে গিয়ে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ ধনীর দুলাল হলেও শাহাদাতের পর কাপনের কাপড় পায় না। পা ঢাকলে মাথা খুলে যায়, মাথা ঢাকলে পা উন্মুক্ত হয়ে যায়।
~রেদওয়ান রাওয়াহা
Comments
Post a Comment