“জেন্ডার ভিক্টিমহুডের রাজনীতি”

 




পুরুষদেরকে সারাদিন গালি দিলেও পুরুষরা এসে জেন্ডার কার্ড ইউজ করে ভিক্টিম সাজে না। বলে না— পুরুষ জাতিকে ছোটো করা হচ্ছে, পুরুষ জাতির অসম্মান করা হচ্ছে বা এই টাইপের কোনো আজগুবি কথা। 

অথচ, পুরুষ শুধু গালি খায় না, মাইরও খায়। খুনও হয়। পুরো জীবনটাই ধ্বংস হয়ে যায় তাদের।


তার মানে কি নারীদের খুন হতে হয় না? হয়। কিন্তু তুলনাটা আশা করি বুঝেন এবং জানেন।


যুদ্ধে, দুর্যোগে, যেকোনো সংকটে ও সংঘাতে— সব সময়, সবচেয়ে বেশি যে বা যারা মারা যায়, আহত হয়, রক্তাক্ত হয়, তারা হলো এই পুরুষ জাতি।


এই যে জুলাই ম্যাসাকার গেলো, এই জুলাই ম্যাসাকারে শাহাদাত  বরণকারী প্রায় ৯৯.৫০% পুরুষই। এমনকি যারা গুলি খেয়েছে, যারা পঙ্গু হয়েছে, হসপিটালাইজড হয়েছে— তাদের মধ্যেও ৯৯%ই পুরুষ। 


এভাবে প্রত্যেটা দুর্যোগে, প্রত্যেকটা দুর্ভোগে, প্রত্যেকটা সংকটে পুরুষরাই জীবন বিলিয়ে দেয়। পুরুষরাই নিজেদের শক্ত বাহু দ্বারা দুনিয়াটাকে আগলে রাখে। 


পুরুষরাই নারীকে প্রটেক্ট করে। শুধু নারীকে না, পুরো মানবসভ্যতাকেই ধ্বংসের হাত থেকে হেফাজত করে। 

পুরুষ যদি ধর্ষক হয় বা অপরাধ করে, তবে আবার সেই পুরুষই এগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। অপরাধীদের শায়েস্তা করে। 


এই যে জুলাই অভ্যুত্থানের কথা বললাম, এই অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের মধ্যে প্রায় সবাই পুরুষ হওয়ার পরেও এটা নিয়ে কিন্তু কোনো পুরুষ বা কোনো ছেলে ওয়েবসাইট করেনি বা এই হ্যাশট্যাগে— #জুলাইবিপ্লবেপুরুষেরা— কোনো এক্টিভিজম করেনি।


কিন্তু, নারী বা মেয়েদের নিয়ে এই কাজটি আপনি পাবেন। ওয়েবসাইট পাবেন। মানে ফিমেইল জেন্ডার বেইজ এক্টিভিজম, হ্যাশট্যাগ, ওয়েবসাইট, সবই পাবেন। 


আচ্ছা, প্রশ্ন ওঠতে পারে— আমি কি পুরুষদের জন্য এসব নিয়ে ক্রেডিটবাজী করা বা মেইল জেন্ডার কার্ড ইউজ করে কোনো ওয়েবসাইট কিংবা হ্যাশট্যাগ চালু করা উচিত ছিল বলে মনে করি? না। মোটেও উচিত না বলেই মনে করি। 


কারণ, এগুলো পুরুষেরই কাজ। এটাই তার দায়িত্ব। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তাদেরকে এই দুনিয়ার প্রধান দায়িত্বশীল হিসেবে পাঠিয়েছেন। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে কেবল। 


পুরুষেরা, সংসার, সমাজ ও সভ্যতার প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্যই দুনিয়ার সব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। এবং এটা করতে তারা বাধ্য।


বিপরীতে নারীবাদীরা, নারী অধিকার নিয়ে, নারীর সমান-অংশগ্রহণ নিয়ে খুব লাফালাফি করলেও কখনোই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, দুঃসাহসিক অভিযানে, ভীষণ কষ্টদায়ক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলে না।


যেমন— কখনোই রাস্তায় সমানসংখ্যক নারী রিক্সাওয়ালা, সমানসংখ্যক নারী ট্রাকচালক, সমানসংখ্যক বাসের হেল্পার, সমানসংখ্যক রঙ্গমিস্ত্রী, সমানসংখ্যক সুবিশাল উঁচু উঁচু ভবনে ঝুলে ঝুলে কাজ করা শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে না।


 সমানসংখ্যক বাদ দিন— কোটাভিত্তিক নিয়োগের কথাও তখন আর বলে না। 


তবে, যেখানে এসির বাতাস আছে, আরামের চেয়ার আছে, মিডিয়ায় নিজেকে প্রদর্শনের উপায় আছে, সেখানে সমানাধিকার চায়। নারীর আলাদা কোটা হলেও চায় সেসব জায়গায়। 


তবে, এক্ষেত্রে ইসলামি লেভেল লাগানো ফেমিনিস্টরা আরও অধিক কিউট। এরা ইসলামের মোড়কে নারীবাদী দর্শন চাপিয়ে দেয় কিংবা দিতে চায়। তারা যেন উটপাখর মতো। 


উটপাখিকে যদি বলা হয়, উড়ো। তখন সে বলে, আমি পাখি না, উট।


এবার যদি বলা হয়, তাহলে বোঝা বহন করো। তখন বলে, আমি উট না, পাখি।


মানে, যেভাবে আর যেদিকেই যান— তার যুক্তি হাজির। সেজন্যই অনেকে বলে, গতানুগতিক ফেমিনিস্টদের তুলনায়, ইসলামের লেভেল লাগানো ফেমিনিস্টরা বেশি ভয়ংকর! 


যাই হোক, বলছিলাম গালাগালি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। একজন এভারেজ পুরুষ থেকে শুরু করে ফোকাসড কিংবা হাইলি এম্বিশাস পুরুষ— সবার জীবনই ঘেটে দেখুন, তারা কী পরিমাণ গালাগালি, হুমকি ধামকি কিংবা রিস্কে জীবন যাপন করে। 


যাদের পাবলিকলি সোশ্যাল মিডিয়া-একাউন্ট আছে, তাদের সবার কমেন্ট বক্স কিংবা ইনবক্সে গিয়ে দেখুন, কতরকম গালাগালি কিংবা হুমকি ধামকি পড়ে আছে সেখানে।


 বিপরীতে মেয়েদের একাউন্টের কমেন্ট বক্সগুলোও দেখুন, গালাগালি কিংবা হুমকি ধামকির তারতম্য কেমন, তা দেখতে পাবেন।


প্রমাণ হিসেবে, বিখ্যাত কিছু এক্টিভিস্টদের নাম বলি— রাজাকারপূত্র, মির্জা ফখরুল সাহেবের মেয়ের জামাই ফাহাম আব্দুস সালাম, বাম নাস্তিক ও রেড টেরর মেঘমল্লার বসু, মস্টরমইন্ড মহফুজ আলম, পিনাকি ভট্টাচার্য, ইলিয়াস, জুলকারনাইন সায়ের, শাহবাগী শাহেদ আলমসহ আরও যারা আছে, এদের কমেন্ট বক্সে ঘুরে ঘুরে দেখুন।


অন্যদিকে, বাম মেয়ে উমামা ফাতেমা, দিলশানা পারুল, বিএনপি নারী মানসুরা আলম, ফামা কিংবা আওয়ামী নেত্রী রিপাসহ আরও যারা আছে— এদের কমেন্ট বক্স গিয়েও দেখুন।


অবশ্যই দেখবেন, পুরুষদেরকেই গালাগালি কিংবা হুমকি ধামকি বেশি দেওয়া হচ্ছে। এসবের শিকার তাদেরই বেশি হতে হচ্ছে। 


 এই যে গালাগালির শিকার হচ্ছে তারা— এই কারণে কিন্তু তারা বলছে না যে, আমরা বাপের জাত, আমাদের সম্মান দিয়ে কথা বলুন। এমনকি তাদেরকে দেওয়া গালিকে তারা পুরুষ বিদ্বেষ হিসেবেও ট্রিট করছে না।


কিন্তু, আপনি যদি উমামা ফাতেমাদের গালি দেন, এমনকি কট্টর পুরুষ বিদ্বেষী এবং ইসলাম বিদ্বেষী তাসলিমা নাসরিনকেও যদি গালি দেন, তখন সেটা হয়ে যাবে নারী বিদ্বেষ! নারীর প্রতি অবমাননা। 


অথচ, বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে— পাবলিক স্ফিয়ারে আপনি যদি কারও বিরুদ্ধে কথা বলেন, আপনার এক্টিভিজম যদি কোনো দল বা মতাদর্শের বিরুদ্ধে যায়, তখন বিরোধীরা আপনাকে গালি দেবেই। হুমকি ধামকি দেবেই। এটাই এই অঞ্চলের কালচার। ভালো কালচার না অবশ্য, বাজে কালচার। এই বাজে কালচারের পতন কামনা করছি। 


তো এই যে গালাগাল, এটা কেউ নারী বিদ্বেষ কিংবা পুরুষ বিদ্বেষ থেকে করছে না। 


অথচ, একটা অংশ আছে, যারা নারীদেরকে গালিই দিলে সেটা নারী বিদ্বেষ বানিয়ে দেয়। কিন্তু নারী যদি হাজারো গালি দেয়, হাজারো অপমান কিংবা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, সেটা আবার পুরুষ বিদ্বেষ হয় না। 


কোনো নারীর বাড়াবাড়ির কারণে তাদের প্রতি রাগ দেখালে সেটাকে গোটা নারী জাতির প্রতি অসম্মান বানিয়ে দেয় বড়ো একটা অংশ। 


কিন্তু, পুরুষের প্রতি— এমনকি বৃদ্ধ পুরুষদের প্রতিও যদি এই বাড়াবাড়ির কারণে রাগ দেখান, সেটাকে কিন্তু পুরুষ জাতিকে অপমানের মতো ফাউল কথা হিসেবে চাউর করে দেওয়া হয় না। 


আমার কথা হলো, আপনি যদি মেন্টাল স্ট্রেস নিতে না পারেন— পুরুষ হোন বা নারী, আপনার উচিত না পাবলিক স্ফিয়ারে কোনো কথা বলা বা জটিল মতামত প্রদান করা কিংবা কোনো ক্রিটিক্যাল এক্টিভিজমে জড়িত হওয়া। 


আপনি পাবলিক প্লেসে আসবেন, পাবলিক স্ফিয়ারে কথা বলবেন, বক্তব্য দেবেন কিংবা লিখবেন, কিন্তু এসবের প্রতিক্রিয়াকে সহ্য করতে চাবেন না, খারাপ প্রতিক্রিয়াগুলোকে— যেটা অবশ্যই অনুচিত— নারীর প্রতি অসম্মান, নারী বিদ্বেষ বানিয়ে দেবেন, তা হতে পারে না। এটাও এক ধরনের ভণ্ডামি। এসব ভণ্ডামি বাদ দেওয়া উচিত। 


পাবলিক স্ফিয়ারের কথা বাদ দিন, যারা চাপ নিতে পারেন না, পারিবারিক পরিসরেও তাদের উচিত না জটিল কোনো বিষয়ে এনগেজ হওয়া। 


এখন, এর মানে কি আমি গালাগালিকে সমর্থন করছি? উৎসাহ দিচ্ছি? কিংবা গালাগালিকে পজিটিভলি নিচ্ছি?


না, এখানে আমি স্রেফ একটা ফ্যাক্ট তুলে ধরছি। 


আমার দৃষ্টিতে— গালাগালি করাটা আসলে খুবই খারাপ।  ইসলামের দৃষ্টিতে এটা আবার ফাসেকি। সামাজিক দৃষ্টিতে অভদ্রতা, অন্যায়। 


 সেজন্য আমি চাই— গালাগালি করা ব্যক্তিদের বয়কট করা হোক, জবাবদিহিতার মুখোমুখি আনা হোক। গালাগালিকে নিরুৎসাহিত করাই না শুধু, গালাগালিকে খুবই ঘৃণা করি আমি।


আমি চাই, এই দুনিয়া থেকে গালাগালি চিরতরে উৎখাত হয়ে যাক। চাই, গালাগালির বিরুদ্ধে আইন করা হোক। গালিবাজদের শায়েস্তা করা হোক।


কিন্তু, আবার এটাও চাই— গালিবাজদেরকে গালাগালির জন্য নির্দিষ্ট একটা জেন্ডার বিদ্বেষ বানিয়ে দেওয়ার মতো ভণ্ডামিও দূর হোক। 


জেন্ডার কার্ড ইউজ করে হিরো হওয়ার কিংবা ভিক্টিম সাজার মতো ভণ্ডামি বন্ধ হোক। 




~রেদওয়ান রাওয়াহা



Comments

Popular posts from this blog

কেমন ছিল শেখ মুজিবুর রহমান

“শবে-বরাত ও সংস্কৃতি : কিছু প্রশ্ন কিছু কথা”

ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের অপপ্রয়োগ